অতৃপ্ত প্রেম
Insatiable Love
তপন কুমার রনজিৎ।
Home » Medinikatha Journal » Tapan Kumar Ranjit » Insatiable Love
ভোগরাইয়ের কাছারিবাড়িতে সাজো সাজো রব ৷ কাছারিবাড়ি সংলগ্ন শ্যামসুন্দর জীউ মন্দিরের বহিরঙ্গে রঙের প্রলেপ ৷ মন্দিরের বিগ্রহ নব কলেবরে সজ্জিত ৷ মন্দির চত্বর ঝাঁ চকচকে ৷ কাছারির দক্ষিণ মাঠ পেরিয়ে রাসমঞ্চে আলোর রোশনাই ৷ এক মায়াবী মাদকতায় আচ্ছন্ন ভোগরাই মহলের প্রজাসাধারণ ৷
রানি রেনুকাদেবী রাজার সাথে এখানে এসেছেন বেশ কয়েকবার ৷ কিন্তু এবারে আসাটা এক ভিন্ন তাৎপর্য বহন করছে ৷ রানিমা একাই আসবেন, সব হিসেব পাওনা গণ্ডায় বুঝে নেবেন ৷
রাসমঞ্চ (ভোগরাই )। ছবিঃ তপন কুমার রণজিৎ
কমরদাগড়ের বাছাই করা একদল সৈন্য কাছারির চারিদিকে সদা প্রস্তুত ৷ দিন কয়েক হয়ে গেল সর্বসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ৷ নিরাপত্তা বলয় এতটা আঁটো সাঁটো যে মাছি গলবার জো নেই ৷
দোল পূর্ণিমার আগের দিন ৷ পঁচেটগড়ের রাজপ্রাসাদ থেকে পালকিতে উঠে বসলেন রাজমাতা ৷ কুলপুরোহিত প্রসাদি ফুল মাথায় ছুঁইয়ে দিলেন ৷ নির্দেশ পাওয়া মাত্র বেহারার দল এগিয়ে চলল ৷ পালকির সামনে চলেছে সুসজ্জিত হাতির দল ৷ দু'পাশে সদা জাগ্রত একদল লগদি ৷ পেছনে অশ্বারোহী রামপুরী যোদ্ধার দল৷
শ্যামসুন্দর জীউ মন্দির (ভোগরাই )। ছবিঃ তপন কুমার রণজিৎ
শ্রীচৈতন্যের শ্রীক্ষেত্রে যাওয়ার পথ ধরে ললাট এ পৌঁছালেন ৷ তারপর দক্ষিণে এগরা ৷ দক্ষিণ-পশ্চিমে বেহারার দল পালকি নিয়ে চলেছে ৷ পথে পথে আলংগিরি, মোহনপুর , গোমুণ্ডা হয়ে পালকি নাপোতে পৌঁছানো মাত্র ঊড়িষ্যাতে প্রবেশ করলেন রাজমাতা ৷ রাস্তার দু'পাশে প্রজাকুলের উপস্থিতি বুঝিয়ে দিল পঁচেট রাজের গুরুত্ব ৷
কমরদাগড়ে প্রবেশ করা মাত্র রাজমাতা পেলেন বিশেষ সম্মর্ধনা ৷ দ্বিপ্রাহরিক আহার শেষে মন্ত্রণাকক্ষে প্রবেশ করলেন রাজমাতা৷ উপস্থিত ছিলেন ময়ূরভঞ্জের রাজদূত, জামকুণ্ডার জমিদার, সাহাবন্দরের নায়েব, ভেড়িবারাঙ্গার পণ্ডা জমিদার এবং ভোগরাই কাছারির নায়েব ৷ রুদ্ধদ্বার মন্ত্রণাকক্ষ ৷ পরিকল্পনার বিন্দুমাত্র আঁচ পাওয়া গেল না ৷মুহূর্তের মধ্যেই দ্বার উন্মুক্ত হল ৷ অতিথিগণ ফিরে গেলেন যে যার গন্তব্যে ৷
কাছারিবাড়ি (ভোগরাই )। ছবিঃ তপন কুমার রণজিৎ
বসন্তের পশ্চিমা রোদে রাজমাতা রাঙা হয়ে উঠেছেন ৷ পালকি এগিয়ে চলল ভোগরাইয়ের কাছারিবাড়ির দিকে ৷ পঞ্চাশ জনের বিশেষ প্রশিক্ষিত অশ্বারোহী সেনা দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পালকির সামনে ও পেছনে যোগ দিল ৷ কমরদাগড় থেকে ভোগরাই কাছারিবাড়ি পর্যন্ত রাস্তার দু'পাশে প্রজাকুলের রাজমাতার উদ্দেশ্যে জয়ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠল ৷
ভোগরাইয়ের মাটিতে রাজমাতা রেণুকাদেবীর চরণ স্পর্শ করা মাত্র কিরাতগড়ের রাজা কার্তিক সিংহের হৃদয় কেঁপে উঠল ৷ জেগে উঠল পাশবিক শক্তি ৷ রাজামাতাকে রানি বানানোর সুপ্ত কামনা উদগ্র হয়ে উঠল ৷ হৃদয় কোন্দরে তুফান উঠল ৷ রাজামাতাকে রানিবেশে পঁচেটগড় রাজ যেদিন 'জাগরি কুণ্ড' দেখাতে নিয়ে এসেছিলেন সেদিন কার্তিক সিংহ সদ্যবিবাহিত রানিকে আড়চোখে দেখেছিলেন ৷ ততদিন থেকে রানির রূপে ঝলসে রয়েছেন কিরাতরাজ ৷ এবারে রাজা নেই ৷ সুবর্ণ সুযোগ ! ফন্দি আঁটতে থাকলেন রাজা কার্তিক ৷
ভোগরাই বাশুলি। ছবিঃ তপন কুমার রণজিৎ
রাজমাতা কাছারিবাড়ির পেছনে কুলদেবতা শ্যামসুন্দর জীউএর পুষ্করিণীতে স্নান সেরে , সন্ধ্যারতির জন্য মন্দিরে প্রবেশ করলেন ৷ মন্দিরের পূজারির সঙ্গে দোলের দিনের কর্মপন্থা স্থির করে বিশ্রামে গেলেন ৷
প্রভাতে দোলযাত্রার আয়োজন সম্পূর্ণ ৷ শুরু হল ভোগারাই বাশুলি মাতা ও বাবা চন্দনেশ্বরকে ভেট প্রদান করে মাঙ্গলিকী অনুষ্ঠান ৷ বিকেলে নগরকীর্তন সহযোগে নগর পরিক্রমা ৷ সন্ধ্যায় রাসমঞ্চে ভোগরাইয়ের প্রজাকুল মেতে উঠল দোল উৎসবে ৷ প্রথা অনুযায়ী দান ধ্যান শুরু করলেন ৷
দোলের পরদিন প্রভাতে ভোগরাইয়ের বাতাস ভারি হয়ে উঠল ৷ রাজমাতা বাশুলি মাতার দর্শণ শেষে সুবর্ণরেখার নদী ঘাট পঁতেইতে পৌঁছালেন ৷ ওপারে জামকুণ্ডা ৷ জমিদার সুদৃশ্য নৌকা নিয়ে হাজির ৷ নৌকাবিহার শেষে 'ভূবান্ধ' এ যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন ৷ চলছেন পালকিতে, নিরাপত্তার ঘাটতি নেই ৷ সাথে যোগ দিয়েছে জামকুণ্ডা জমিদারের লেঠেল বাহিনী৷ ঠাকুরভৌঁরি, কাঠকোটা, বনবাড়ি হয়ে ভুয়াবাঁধ থেকেই শবর, কিরাত প্রভৃতি আদিবাসীদের গ্রাম ৷ বনবাশুলি মন্দির৷ পশ্চিমমুখী ছোটোমাপের দেবালয়ে মাকড়া পাথরের বিচিত্র দর্শন বিভিন্ন মূর্তির সমাবেশ ৷ দর্শন শেষে রাজমাতা গঙ্গাধর শিবমন্দিরে পূজা দিলেন ৷ চললেন কিরাতসালে, 'জাগরি কুণ্ড' দর্শন শেষে ফিরবেন কাছারিবাড়িতে ৷
সিঁদুরমুড়ি মন্দিরের কাছে রাজমাতার পালকি থামা মাত্র, সুসজ্জিত হাতির পালের সমবেত বিকট বৃংহণ ধ্বনি জানান দিল বিপদ সংকেত ৷ দূর থেকে দৃশ্য হল শ'পাঁচেক কিরাতসৈন্য চারদিক থেকে ছুটে আসছে ৷ তড়িৎ গতিতে, রাজমাতার নিজস্ব লগদি সৈন্যবাহিনী পালকির চারিদিকে সুরক্ষা বলয় রচনা করল ৷ দ্বিতীয় বেষ্টনিতে জামকুণ্ডা জমিদারের লেঠেল বাহিনী ৷ তৃতীয় বেষ্টনিতে ভেড়িবারাঙ্গার পণ্ডা জমিদারের লেঠেল বাহিনী ৷ তৃতীয় বেষ্টনির চারিদিকে চক্রাকারে টহল দিতে লাগল কমরদাগড়ের প্রশিক্ষিত অশ্বারোহী বাহিনী ৷ সম্মুখ সমরে কিরাতসৈন্যের মোকাবিলা করতে এগিয়ে চলল রামপুরের বিশেষ অশ্বারোহী বাহিনী৷ তাদের ছোঁড়া তীর, বল্লমে একের পর এক কিরাত সৈন্য লুটিয়ে পড়ল মাটিতে ৷ কিরাতরাজ কার্তিক সিংহের ঝটিকা আক্রমণে পিছু হটতে শুরু করল রামপুরী সেনা ৷ প্রাণ গেল গুটি কয়েক সেনার ৷ খানিক বিপদ সামলে নিয়ে অসম সাহসী এই যোদ্ধা দল তিন দিক থেকে রাজা কার্তিককে ঘিরে ধরল ৷ বন্দী হলেন কিরাত গড়ের শেষ রাজা ৷ রাজমাতা রেনুকাদেবী দখল নিলেন কিরাতগড়ের ৷ কমরদাগড় থেকে সাহাবন্দর - এই বিস্তৃত অঞ্চল পাঁচেটগড়ের অধীন হল ৷ মারাঠাদের অধিকার সুরক্ষিত হল ৷ কিন্তু শবর, কিরাত তথা আদিবাসীদের শেষ আশ্রয়স্থল হারিয়ে গেল চিরতরে ৷ ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে গেল কিরাত গড় নামটি ৷ উত্তরপ্রদেশের রামপুরী সেনাদের দ্বারা এই জয় সম্ভব হয়েছিল বলে জায়গাটির নাম হল 'জয়রামপুর'
বাশুলি মন্দির। ছবিঃ তপন কুমার রণজিৎ
রাজমাতার নির্দেশে কিরাতরাজকে আনা হল 'জাগরিকুণ্ড'-এ ৷ রাজমাতা বন্দীর শেষ ইচ্ছা জানতে চাইলেন ৷ বন্দী হাসতে হাসতে সদর্পে ঘোষণা করলেন, 'মৃত্যুর আগে আপনাকে একবার রানি রূপে পেতে চাই ৷'
কর্ণগোচর হওয়া মাত্র রাজমাতা তাঁর আত্মরক্ষার ছুরিকা দিয়েই বন্দীর প্রাণ কেড়ে নিলেন ৷ তাজা রক্ত ফিনকি দিয়ে ছিটকে পড়ল গায়ে মাথায় ৷ হয়তো বন্দীর শেষ ইচ্ছে পূরণ হল ৷ বন্দীর দেহ নিক্ষেপ করা হল জাগরিকুণ্ডে।
সুবর্ণরেখা নদী ঘাট পঁতেই ওপারে জামকুন্ডা এপারে ভোগরাই। ছবিঃ তপন কুমার রণজিৎ
কিরাত, শবরদের শেষ আর্তনাদ পলাশের আগুন ঝরা পশ্চিমাকাশে সুবর্ণরেখার জলে মিলিয়ে গেল ৷ চাপা পড়ে রইল এক 'অতৃপ্ত প্রেমকাহিনী'৷
midnapore.in
(Published on 14.05.2023)