ছি-ছত্তর
সীমান্ত বাংলার গ্রামীণ খেলাধুলা - ২
Chhi Chattar - Rural sports in frontier Bengal
চিন্ময় দাশ।
Home » Medinikatha Journal » Chinmoy Das » Chhi Chattar
ছি-ছত্তর খেলাটি একান্তভাবেই প্রাঙ্গণের খেলা। এবং এই খেলা কেবলমাত্র বালক এবং কিশোর বয়সী ছেলেদের। মেয়েদের এই খেলা খেলতে দেখা যায় না। মেদিনীপুর জেলার পশ্চিম এবং দক্ষিণ এলাকাগুলিতেই ছি-ছত্তর খেলার প্রচলন দেখা যায়। অর্থাৎ জেলার জঙ্গল অধ্যুষিত এলাকার পাশাপাশি, প্রতিবেশী ওড়িশা এবং ঝাড়খণ্ডের সীমান্ত লগ্ন এলাকাতেও খেলাটির বিস্তার আছে।
জঙ্গল মহল এলাকার ভূমিভাগ উচ্চাবচ, মৃত্তিকা রক্তবর্ণ। শাল পিয়াশাল সেগুন মহুয়া কুসুম করম শিমূল পলাশ ইত্যাদি প্রাচীন সব বৃক্ষের ছায়ায় মোড়া। অধিবাসীদের সিংহভাগই সাঁওতাল মুণ্ডা লোধা শবর কোড়া ইত্যাদি আদিম নৃগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত জনজাতি তালিকাভুক্ত। দারিদ্র তাঁদের নিত্যসঙ্গী। জীবনযাত্রা জঙ্গল নির্ভর। খাদ্যাভ্যাস, পোষাক-পরিচ্ছদ, উৎসব-অনুষ্ঠান, খেলাধূলো অর্থাৎ সমগ্রা জীবনচর্যাতেই প্রকৃতি এবং অরণ্যের গভীর প্রভাব।
সামাজিক নৃবিদ্যার পণ্ডিত এবং সমীক্ষকগ্ণের অভিমত, ছি-ছত্তর নামের খেলাটি দুটি আদিম জনগোষ্ঠী বা দুটি পৃথক টোটেম-গোত্রের সম্প্রদায়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ এবং দাস সংগ্রহের প্রাচীন প্রথার ক্রীড়ারূপ মাত্র। পূর্বকালে দুই জনগোষ্ঠীর সংঘর্ষের পরিণতিতে, পরাভূত গোষ্ঠীর মানুষকে বন্দী করে এনে, দাস হিসাবে ব্যবহার করা হোত।
ছি-ছত্তর - সীমান্ত বাংলার গ্রামীণ খেলাধুলা
দাসত্ব থেকে মুক্তির আকাঙ্খায়, দাস হিসাবে নিযুক্ত ব্যক্তিটি পালিয়ে যাওয়ার জন্য সবরকম চেষ্টা করে থাকে। মালিক পক্ষ সদাসতর্ক এবং সচেষ্ট থাকে তাকে আটকে রাখবার। বলা হয়, ছি-ছত্তর খেলায় সেই একপক্ষের মুক্তিলাভ এবং অন্যপক্ষের আটক করে রাখবার প্রয়াস—এই পরস্পর প্রতিদ্বন্দী ও বিপরীত দুটি ক্রিয়ারই প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে।
উদাহরণ হিসাবে, সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর কথাই ধরা যাক। প্রোটো-অস্ট্রালয়েড (আদি-অস্ট্রেলিয়) জনগোষ্ঠীর বংশধর ভারতীয় উপমহাদেশের একটি অস্ট্রোএশিয়াটিক ভাষী এঁরা। মেদিনীপুর জেলা তথা সারা রাজ্যে এঁরা হলেন বৃহত্তম জাতিগোষ্ঠী। এঁরা ১২টি গোত্র এবং পদবীতে বিভক্ত। (বন্ধনী-র ভিতর প্রত্যেকের ‘টোটেম’ উল্লেখ করা হোল।) বাংলা বর্ণানুক্রম অনুসারে সাজালে, তালিকাটি এরকম —কিস্কু (কাঠ), চঁড়ে (সাপ), টুডু (বাঁশ), পাউরিয়া (হাঁস), বাস্কে (শালিক পাখি), বেদেয়া (কুমির), বেসরা (গিনিপিগ), মার্ডি বা মাণ্ডি (ছাগল), মূর্মু (কুকুর), সরেন (সাপ), হাঁসদা (হাঁস) এবং হেমব্রম (ঘোড়া)।
পূর্বকালে এই ১২টি গোত্র এবং টোটেম-এ বিভক্ত বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ সৃষ্টি হলে, পরাজিত গোষ্ঠীর লোকেদের বন্দী কর এনে, দাস হিসাবে নিযুক্ত করা হোত। সেকালের সেই দাস সংগ্রহ প্রথা অবলুপ্ত হয়ে গিয়েছে বহুকাল পূর্বেই। কিন্তু ছি-ছত্তর নামের খেলাটি আজও সেই প্রাচীন প্রথার সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। এবার হাজার বছরেরও প্রাচীন খেলাটির রীতি-নীতি প্রসঙ্গে যাওয়া যাক।
ছি-ছত্তর খেলার প্রধান আকর্ষণই হোল ছোটাছুটি এবং হৈ-হুল্লোড়। খেলাটির প্রথম পর্বে ছড়ার প্রাধান্য দেখা যায়। তবে, পরের পর্বে ছোটাছুটিরই পালা। তাতেই শিশুদের আনন্দ উচ্ছাস দেখা যায়।
এই খেলায় খেলোয়াড়ের সংখ্যায় কোনও নির্দিষ্টতা কিংবা বাধ্যবাধকতা নাই। সাধারণভাবে ১০ থেকে ১৫ জন খেলোয়াড়কে এই খেলায় অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়। প্রধানত এটি প্রাঙ্গণেরই খেলা। তবে, খেলুড়েরা যদি কম বয়স্ক শিশু হয়, তখন অঙ্গণেও এটি খেলা যায়। অবশ্য সেক্ষেত্রে অঙ্গণটিকে কিছু প্রশস্ত হতেই হয়।
সাধারণভাবে এটি শিশুদের খেলা। তবে, সামান্য বড় বালক-বালিকাদেরও খেলতে দেখা যায়। বয়সের যেমন কোনও নির্দিষ্টতা নাই, তেমনই লিঙ্গভেদও নাই খেলোয়াড়দের। কেবলই বালক, কেবলই বালিকা কিংবা বালক-বালিকাদের মিলিতভাবেও এই খেলার আয়োজন হয়ে থাকে।
একটি খোলা প্রান্তরে দশ-পনের জন খেলোয়াড় গোল হয়ে দাঁড়ায়। পরস্পরের হাত ধরা থাকে তাদের। সেকারণে, বড় মাপের একটি বৃত্ত রচিত হয়। একজন খেলোয়াড় এই বৃত্তের মাঝখানে থাকে, তার নাম—চিল। আর, বৃত্তাকারে দাঁড়ানো খেলোয়াড়রা হোল মোরগ-মুরগি।
খেলার মূল প্রতিপাদ্য হোল—বৃত্তের ঘারাটোপে আবদ্ধ থাকে চিল। তার একমাত্র প্রয়াস থাকে, মোরগ-মুরগিদের হাতে হাতে তৈরি শেকল ভেঙে বেরিয়ে, পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা।
শেকল ভাঙবার বীরত্ব দেখাবার জন্য, চিল প্রথমে তার সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে। হাতে হাত বাঁধা শেকল উঁচু করে তুলে ধরে তার তলা দিয়ে গলে বেরিয়ে যেতে চেষ্টা করে সে। মোরগরাও হাত শক্ত করে নীচের দিকে চেপে রাখে। যাতে চিল গলে যেতে না পারে।
অনেক শক্তি প্রয়োগ, অনেক কসরত করেও চিল বের হতে পারে না। অন্য খেলোয়াডরা তাকে বেরিয়ে পালাবার সুযোগ দিতে চায় না। এই পর্বে তুমুল হৈ-হুল্লোড় চলতে থাকে। তবে, সেটা একেবারেই কৌতুকের। পুরো পরিবেশ আনন্দ কোলাহলে মুখরিত হয়ে ওঠে।
চিল তখন অনন্যোপায় হয়ে, ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে। বৃত্তের লাগোয়া হয়ে ঘুরে ঘুরে ছড়া আওড়াতে থাকে। বিভিন্ন এলাকায় ছড়াও বিভিন্ন হয়। আমরা একটি ছড়া উল্লেখ করলাম এখানে-- খেলা খেলা ছি-ছত্তর। শিমূল মহুল শালপত্তর। শালপত্তর জোড়া জোড়া। আমি চড়ি পাগলা ঘোড়া। ঘোড়ার পিঠে মারব বাড়ি। ধূলা উড়বে কাঁড়ি কাঁড়ি। ঘোড়া ছুটবে তাড়াতাড়ি। হো-ও-ও।
ছড়া কেটে ঘুরবার সময়, চিল এক হাত দিয়ে মোরগদের মুঠোবাঁধা হাতগুলি ছুঁয়ে যেতে থাকে। সে সময়েই হঠাৎ করে কোনও একটা বাঁধন ছিঁড়ে দিয়ে, কিংবা হাতের শেকল উঁচু করে তুলে, তলা দিয়ে ছুটে বেরিয়ে যায়।
চিল বেরিয়ে গেলে, মোরগ-মুরগিদের হুল্লোড় শুরু হয়। চিৎকার চেঁচামেচি করতে করতে, সবাই চিলের পেছনে ছুটতে শুরু করে। যে খেলোয়াড় তাকে প্রথম ছুঁতে পারবে, সে-ই পরের দানে চিল হওয়ার সুযোগ পাবে।
ছি-ছত্তর খেলায় একদিকে আছে হৈ-হুল্লোড়ের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত শিশু মনের অনাবিল আনন্দ উল্লাস। অপর দিকে ছোটাছুটির কারণে শরীরচর্চার উপকারিতা লাভও হয় খেলোয়াড়দের।
সমাজবিজ্ঞানীগ্ণ ছি-ছত্তর খেলায় বন্দী হয়ে থাকা ‘চিল’কে পূর্বকালের বন্দী হয়ে থাকা দাস বিবেচনা করেন। সমগ্র খেলাটি বন্দী দাস-এর মুক্তিলাভের আকাঙ্ক্ষায় পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা এবং বিজয়ী জনগোষ্ঠীর লোকজনদের দাসকে আটক করে রাখা এবং বেরিয়ে গেলে ফিরিয়ে আনবার চেষ্টা হিসাবে বর্ণনা করেন।
M E D I N I K A T H A J O U R N A L
Edited by Arindam Bhowmik
(Published on 02.02.2025)
নিচে কমেন্ট বক্সে আপনার মূল্যবান মতামত জানান।