আলিপুর বোমা মামলার আসামী স্বাধীনতা সংগ্রামী পূর্ণচন্দ্র সেন, ক্যালকাটা প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি
Freedom fighter Purna Chandra Sen, accused in Alipore bomb case. Founder President of Calcutta Press Club
উমাশংকর নিয়োগী।
Home » Medinikatha Journal » Umasankar Neogi » Purna Chandra Sen
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার দাসপুর থানা একটি উল্লেখযোগ্য নাম । বেশকিছু শহিদ ও স্বাধীনতা সংগ্রামীর স্মৃতি বিজড়িত পুণ্যভূমির নাম দাসপুর। লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে অংশ নেওয়ার অপরাধে কারান্তরালে যাবজ্জীবন কাটিয়েছেন এমন মানুষও এই পবিত্র ভূমিতে জন্মেছেন। শহিদ প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্য , শহিদ ক্ষুদিরাম বসু ,শহিদ মোহিনীমোহন মণ্ডল সহ চেঁচুয়ার অসীম সাহসী ১৪ জন বীর ইংরেজদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে আত্মবলিদান দিয়েছেন। প্রভাংশুশেখর পাল, মোহিনীমোহন দাস ,স্বদেশরঞ্জন দাস, হৃষীকেশ পাইন, সুরেন্দ্রনাথ বাগ, কাননবিহারী গোস্বামী, মুরারি দিণ্ডা ,মানবেন্দ্রনাথ রায়, মৃগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য , পূর্ণচন্দ্র সেন প্রমুখ অনেকেরই জন্মভূমি দাসপুরের কোন না কোন গ্রাম। এঁদের মধ্যে অনেকে ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল আলোতে উদ্ভাসিত হলেও অনেকেই ইতিহাসের পাতায় কেবল নামেমাত্র পরিচিত হয়ে আছেন। এমনই একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী চাঁদপুরের পূর্ণচন্দ্র সেন।
আলিপুর বোমা মামলার আসামী স্বাধীনতা সংগ্রামী পূর্ণচন্দ্র সেন, ক্যালকাটা প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি | Freedom fighter Purnachandra Sen accused in Alipore bomb case, Founder President of Calcutta Press Club
দীনবন্ধু সেন দাসপুর থানার প্রথম রায়বাহাদুর খেতাব পান। এঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র যোগেন্দ্রনাথ পেশায় আইনজীবী ছিলেন। যোগেন্দ্রনাথের স্ত্রীর নাম কৃষ্ণভাবিনী। এঁদের চার পুত্র। মন্মথ, প্রমথ, পূর্ণচন্দ্র এবং গৌরীশংকর । মন্মথনাথও রায়বাহাদুর ছিলেন। ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে চাঁদপুরের পৈত্রিক বাড়িতে পূর্ণচন্দ্র জন্ম গ্রহণ করেন। পূর্ণচন্দ্রের পাঁচ ছয় বছর বয়সে যোগেন্দ্র তমলুক কোর্টে প্রাক্টিস শুরু করার ফলে সপরিবারে তিনি তমলুকে চলে আসেন। এখানে হ্যামিল্টন স্কুলেই পূর্ণচন্দ্রের লেখাপড়া আরম্ভ হয়। পরে ভাই গৌরীশংকরকেও এই স্কুলে ভর্তি করা হয়। তমলুকে থাকার সময়ে যোগেন্দ্র রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ হন। কয়েক বৎসর পর যোগেন্দ্রনাথ মেদিনীপুরে জজকোর্টে ওকালতি শুরু করেন। হোস্টেলে থেকে দুই ভাইয়ের পড়া চলতে থাকে হ্যামিল্টন স্কুলেই। মাঝে মাঝে স্কুল ছুটিতে দুইভাই মেদিনীপুরে আসতেন।
১৯০২ খ্রিস্টাব্দে প্রমথনাথ মিত্রের নেতৃত্বে কলকাতায় ‘অনুশীলন সমিতি’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ঐ বৎসরেই জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসু ও তাঁর ভাই সত্যেন্দ্রনাথ বসু মেদিনীপুর শহর ‘ বিপ্লবী গুপ্তসমিতি’ র গোড়াপত্তন করেন। ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে মেদিনীপুর শহরে এলেন ভগিনী নিবেদিতা। মৌলবি আব্দুল কাদেরের বাড়িতে একটি ব্যায়ামাগার স্থাপন করলেন নিবেদিতা। পরে পরে ডায়মন্ড স্পোটিং ক্লাব, বড়বাজার সন্তান সমিতি ,মীর বাজার মালতী আখড়া প্রভৃতি জায়গায় ব্যায়াম অনুশীলন কেন্দ্র গড়ে উঠে । বলা বাহুল্য এগুলি ছিল বিপ্লবীদের আঁতুড়ঘর । ক্ষুদিরাম বসু পূর্ণচন্দ্র সেন এই আখড়াগুলির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন।
১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে হ্যামিল্টন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করার পর মেদিনীপুর কলেজে পড়ার জন্য মেদিনীপুরে চলে আসেন। নানা কারণে ১৯০৪ খ্রিঃ এ কলেজে ভর্তি না হলেও পরের বছর কলেজে ভর্তি হন। আবাল্য দেশপ্রেমের পরিমণ্ডলে বড় হয়ে ওঠা পূর্ণচন্দ্রের অচিরেই জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসু, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, হেমচন্দ্র কানুনগোর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপিত হল। পড়াশোনা করা ব্যাপারটা ক্রমে তাঁর কাছে গৌণ হয়ে উঠতে থাকে। এ সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, “পড়াশোনাতো ছাই , গুপ্তসমিতির কাজে মেতে উঠলাম । পাড়ায় পাড়ায় ব্যায়ামাগার স্থাপিত হল সঙ্গে লাইব্রেরী । সত্যেনদের বাড়ির কাছে একটা তাঁতশালা স্থাপিত হল । নানারকম হাতে লেখা প্রচারপত্র ও পত্রিকা দেয়ালে সেঁটে দিতাম রাত্রির অন্ধকারে। ”
১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে তমলুকে ক্ষুদিরাম বসুর সঙ্গে পুর্ণচন্দ্রের পরিচয় হয়। তাঁর ছোট ভাই গৌরীশংকর হ্যামিল্টন স্কুলে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে ক্ষুদিরাম বসুর সাথে পড়তেন। খেলাধুলোয় ও কথাবার্তায় চৌকস ক্ষুদিরামের সঙ্গে তাঁর ভাই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। খেলার মাঠেই ক্ষুদিরামের সঙ্গে আলাপ হয় পুর্ণচন্দ্রের । এই বৎসরেই ক্ষুদিরামের ভগ্নীপতি অমৃতলাল রায় তমলুক থেকে মেদিনীপুরে বদলি হয়ে যান। ক্ষুদিরামও মেদিনীপুরে চলে আসেন , ভর্তি হলেন মেদিনীপুর কলিজিয়েট স্কুলে । এই বিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক দেশপ্রেমিক জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসুর সঙ্গে পরিচয় হতে বিলম্ব হয়নি তাঁর ।
বিপ্লবী জ্ঞানেন্দ্রনাথের ছত্র ছায়ায় বেড়ে ওঠা মেদিনীপুর শহরের বেশ কিছু যুবক দেশের স্বাধীনতা অর্জনের স্বার্থে আত্মবলিদান দিতে প্রস্তুত হলেন। পূর্ণচন্দ্র সহ এই দলে যাঁরা ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ক্ষুদিরাম বসু । একটি বিশেষ দিনে জ্ঞানেন্দ্র বসুর উপস্থিতে যে নজন যুবক নিজেদের হাত চিরে সেই রক্ত দিয়ে একে অপরকে রক্ততিলক পরিয়ে দিয়ে , দেশমাতৃকার পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনে প্রয়োজনে আত্মবলিদান দেবার শপথ নিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন পূর্ণচন্দ্র সেন। এই যুবাদের কীভাবে রিভলবারে গুলি ছুঁড়তে হয় তার শিক্ষা দিতেন হেমচন্দ্র কানুনগো ।
ক্যালকাটা প্রেস ক্লাবের ওয়েবসাইটের হোম পেজে তাঁর কথা।
১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে মেদিনীপুর শহরে আসেন অরবিন্দ ঘোষ। তিনি আত্মীয় সত্যেন্দ্রের বাড়িতে না উঠে উঠেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ মুখার্জীর বাড়িতে। অরবিন্দ ঘোষের সঙ্গে ক্ষুদিরামের সাক্ষাৎ করিয়ে দেবার দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছিল পূর্ণচন্দ্রের উপর। তিনি ক্ষুদিরামকে সঙ্গে নিয়ে সত্যেন্দ্রনাথ মুখার্জীর বাড়ি পর্যন্ত গিয়েছিলেন।
ইংরেজ সরকার যেসব পত্র পত্রিকায় তাদের সমালোচনা বের হত সেইসব পত্রপত্রিকার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। সরকারি অনুমোদন ছাড়া কোন লেখা বা পত্রপত্রিকা বের করা যাবে না এই ছিল ফরমান। ‘যুগান্তর’ পত্রিকার সম্পাদক ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর ‘ভয় ভাঙা’ ও ‘ লাঠ্যৌষধি’ নিবন্ধের জন্য এক বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। তখন এই পূর্ণচন্দ্র সেনকে যুগান্তর পত্রিকার পরবর্তী সম্পাদক ও মুদ্রাকর হিসেবে কলকাতা চিপ মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে বারীন্দ্র ঘোষ হাজির করেছিলেন। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড সে আবেদন না মঞ্জুর করে দেন।
১৯০৮ খ্রিস্টাব্দ ৩০ শে এপ্রিল , অসীম সাহসী অগ্নিযুগের দুই তরুণ ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকী মজফফরপুরে অত্যাচারী কিংসফোর্ডকে হত্যা করতে গিয়ে ব্যর্থ হলেন। প্রফুল্ল ধরা পড়ে আত্মহত্যা করলেন ,ক্ষুদিরাম ধরা পড়ে গেলেন। ২রা মে কলকাতা শহরে হানা দিয়ে বারীন্দ্রকুমার ঘোষ , পুর্ণচন্দ্র সেন সহ ৪১ জন কিশোর ও তরুণকে গ্রেফতার করে পুলিশ। শুরু হয় আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলা । ১৯১০ খ্রিস্টাব্দের ১৮ই ফেব্রুয়ারি রায় বেরল । প্রমাণ অভাবে আরো কয়েক জনের সঙ্গে পূর্ণচন্দ্র ছাড় পেয়ে গেলেন।
কিন্তু যাঁর রক্তে দেশমাতৃকার সেবার স্রোত নিরন্তর প্রবাহিত তিনি বসে থাকেন কী করে? ‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে কে বাঁচিতে চায় ! ’ দেশপ্রেমিক পূর্ণচন্দ্র সেন অল্প দিনের মধ্যে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সংস্পর্শে আসেন। দেশ সেবার কজে নিজেকে সতত নিযুক্ত রাখলেন। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশন হয়। এই সময় থেকে তিনি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের প্রাইভেট সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। বেশ কিছুদিন তিনি ঐ পদে বহাল ছিলেন। এই সময়ে তিনি গান্ধিজির ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন। কিন্তু তাঁর পথ বিপ্লবের রক্তে রাঙা পথ। তাই তাঁর নিজের কথায় “ একদা ১৯২৪ সালে এক ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ গভীর নিশীথে ( অধুনা বাংলাদেশের অন্তর্গত ) ঢাকা শহরের উপকণ্ঠে রমনার এক ভগ্ন মসজিদের অলিন্দে বসে বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স (বিঃ ভিঃ) বিপ্লবী দলের অধিনায়ক সত্যভূষণ গুপ্ত আমায় বিপ্লব মন্ত্রে দীক্ষা দিয়েছিলেন। আজও স্পষ্ট মনে পড়ে , অগ্নিঝরা কণ্ঠে বলেছিলেন, “দেশমাতৃকার পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের জন্য আবেদন নিবেদনের পথ আমাদের জন্য নয়। আমাদের পথ বিপ্লবের রক্ত রাঙা পথ, যে পথের সন্ধান দিয়ে গেছেন ক্ষুদিরাম দিয়ে গেছেন কানাইলাল।” বিপ্লবীদলে যোগদানের পরবর্তীকালে আমিও যখন মধুসূদন ভট্টাচার্য , শচীন চট্টোপাধায় ,সুবোধ চক্রবর্তী , রঙ্গলাল গাঙ্গুলী , অনাথ চক্রবর্তী , বিপদভঞ্জন চট্টোপাধ্যায় এবং আরো অনেক ছেলেকে রিক্রুট করেছিলাম । দলে টেনে এনেছিলাম ,তখন আমিও ওদের প্রত্যেকের সম্মুখে তুলে ধরে ছিলাম চিরস্মরণীয় শহীদ ক্ষুদিরাম , কানাইলালের ইতিহাস।”
তৎকালীন যুগে যে কটি মুষ্টিমেয় পত্রপত্রিকা জাতীয় অন্দোলনের সমর্থক ছিল তাদের সংবাদ সংগ্রেহের মত আর্থিক সংগতি ছিল না । এইসব পত্রপত্রিকার জন্য সংবাদ সংগ্রহ করে পূর্ণচন্দ্র সরবরাহ করতেন। পরে তিনি পেশায় সাংবাদিক হয়ে যান। ‘সারভেন্ট’ এবং ‘অমৃতবাজার’ পত্রিকায় সাংবাদিকের কাজ করেছেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের ‘ফরোয়ার্ড’ পত্রিকার প্রধান সংবাদদাতা ছিলেন তিনি। পরে ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দ থেকে ‘দি স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় সাংবাদিকতার কাজ করেন এবং নিজ কর্ম দক্ষতা বলে স্টেটসম্যান পত্রিকার সাব এডিটার হন। এখানেই তিনি তাঁর কর্মজীবন থেকে অবসর নেন। পূর্ণচন্দ্র সেন ক্যালকাটা প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। একটানা ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৫১ পর্যন্ত তিনিই ক্যালকাটা প্রেস ক্লাবের সভাপতির আসন অলংকৃত করেছিলেন।
আলিপুর বোমা মামলার আসামী স্বাধীনতা সংগ্রামী পূর্ণচন্দ্র সেন, ক্যালকাটা প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি | Freedom fighter Purnachandra Sen accused in Alipore bomb case, Founder President of Calcutta Press Club
দাসপুর থানার চাঁদপুর গ্রামে জন্মানো পূর্ণচন্দ্র সেনের ছবি ক্যালকাটা প্রেসক্লাবে সভাপতির চেয়ারের ঠিক উপরে দেওয়ালে আজও স্বমহিমায় রয়েছে।এটা আমাদের কম গর্বের নয়! ১৯১৯ - ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি কংগ্রেসের সদস্য ছিলেন।
পিতা যোগেন্দ্রনাথের দেশ সেবার আদর্শে আদর্শায়িত পূর্ণচন্দ্র পরবর্তী কালে দেশ সেবা ও কর্মজীবনের প্রেরণা পেয়েছেন তাঁর স্ত্রী কমলার কাছ থেকে । পূর্ণচন্দ্র ও কমলার তিন পুত্র দুই কন্যা। তাঁদের নাম রণধীর, প্রোজ্জলকান্তি, প্রদীপ্তশংকর, ললিতা ও নমিতা। এঁরা সবাই স্ব স্ব ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত । স্বাধীনতা সংগ্রামী পূর্ণচন্দ্র প্রয়াত হয়েছেন ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দের ৪ ঠা জুলাই। দীর্ঘজীবী পূর্ণচন্দ্র কেমন ছিলেন দেখতে ? প্রাবন্ধিক দ্বিজেন গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা থেকে তার উত্তর পাওয়া যেতে পারে। তিনি লিখেছেন, “ এই নিবন্ধ রচনার সময় (২৩ শে জানুয়ারি ১৯৭৭) তিনি বেঁচে আছেন । আছেন কলকাতার বালিগঞ্জ এলাকার ‘ডোভার লেন’ এ। একানব্বই চলছে। পাতলা চেহারা , পাঁচ ফুট নয়ের কাছকাছি , এখনও টকটকে ফর্সা রঙ । চোখা নাক মুখ, মাথায় টাকের চিহ্ন নেই । ব্যাকব্রাস করা ঈষৎ লম্বা চুল, দৃষ্টিতে জোর কম। এখনও প্রায় প্রতিদিন রিক্সা করে যান গড়িয়াহাটে বাজার করতে।এখনও সভা সমিতিতে যান।কোথাও সভাপতি,কোথাও প্রধান অতিথি, কোথাও সভার উদ্বোধক ।শহীদ বেদীতে মাল্যদান করেন। ”
পূর্ণচন্দ্র সেন চাঁদপুরের যে বাড়িতে জন্মে ছিলেন সেটি চুনসুরকি দিয়ে গাঁথা দোতলা অট্টালিকা। এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত বিপজ্জনক ভাবে দাঁড়িয়ে ছিল বাড়ির বেশকিছু অংশ । পাশ্চাত্য রীতির সঙ্গে দেশীয় রীতির মিশ্রণে অট্টালিকাটি নির্মিত করেছিলেন রায়বাহাদুর দীনবন্ধু সেন। সেন বংশের পারিবারিক দেবতা শ্রীধরজিউর পঞ্চরত্ন মন্দির ও শিবের আটচালা মন্দির দুটিও তিনি তৈরি করিয়ে ছিলেন । এ দুটি মন্দির এখনও দাঁড়িয়ে আছে, পূজা অর্চনা চলছে। চারিদিকে উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিল, সাধারণের প্রবেশাধিকার ছিল না । সিংহ দরজা ছিল। শোনা যায় এঁদের সম্মান জানাতে এক সময়ে বাড়ির সামনে দিয়ে কেউ পালকি চড়ে যেত না । বাড়ির চৌহদ্দি টুকু পায়ে হেঁটে পার হত। বাবুদের বাড়ি বলে পরিচিত ছিল সবার কাছে ,কেউ সেন বাড়ি বলত না।
আলিপুর বোমা মামলার আসামী স্বাধীনতা সংগ্রামী পূর্ণচন্দ্র সেন, ক্যালকাটা প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি | Freedom fighter Purnachandra Sen accused in Alipore bomb case, Founder President of Calcutta Press Club
জন্মস্থানের অমোঘ আকর্ষণে বহুবার পূর্ণচন্দ্র চাঁদপুরে এসেছেন , অবলীলায় সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশেছেন । সকলের খোঁজখবর রাখতেন এবং নিতেন । ছিপ নিয়ে মাছ ধরতে খুব পছন্দ করতেন তিনি। পুকুরপাড়ে অসীম ধৈর্য নিয়ে বসে থাকতেন বড় মাছ ধরার আশায়। বড় মাছ খেলিয়ে তোলাতে তাঁর খুব আনন্দ হত। দুঃখের ব্যাপার চাঁদপুরবাসী কেন , দাসপুর থানার কেউ এই স্বাধীনতা যোদ্ধাকে সম্মান জানানো বা সংবর্ধনা দেবার তাগিদ অনুভব করেননি ।এমনকি তাঁর জন্মভূমিতে একটি নামের ফলক পর্যন্ত নেই। পূর্ণচন্দ্র সেন গ্রামের পূর্ণচন্দ্র হয়েও গ্রামবাসীর কাছে উপেক্ষিত থেকে গিয়েছেন।
Medinikatha Journal (midnapore.in)
Edited by Arindam Bhowmik
(Published on 17.06.2023)
ঋণ স্বীকার:
তপনকুমার সেন
দ্বিজেন গঙ্গোপাধ্যায়
পরিব্রাজক পঞ্চানন রায়
প্রণব রায়
দুটি ছবি সুকান্ত সিংহের সৌজন্যে পাওয়া