বসন্তকুমার ও সতীশচন্দ্র: অপূর্ব মেলবন্ধন
Satish Chandra Samanta & Basanta Kumar Das: Tale of two friends
প্রকাশকান্তি দাস।
Home » Medinikatha Journal » Prakash Kanti Das » বসন্তকুমার ও সতীশচন্দ্র: অপূর্ব মেলবন্ধন
দুই বন্ধুর কথা। দু’জনেই মেদিনীপুরের, অধুনা পূর্ব মেদিনীপুরের। স্বাধীনতা সংগ্রামী এই দুই প্রতিনিধি কাঁথি ও তমলুক মহকুমার। বসন্তকুমারের সংগ্রামী ও রাজনৈতিক জীবনের মূল কেন্দ্র কাঁথি। আর সতীশ্চন্দ্রের তমলুক। এঁরা নিজ নিজ কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত গণ পরিষদের (Constituent Assembly) সদস্য, পরে লোকসভার। দিল্লী-বাসের ঠিকানা ৭নং ইলেক্ট্রিক লেন। এখানে ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত কেটেছে সতীশ্চন্দ্রের। আর বসন্তকুমারের ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৬৭ সাল। যদিও মাঝে পশ্চিমবঙ্গের বিধান পরিষদের সদস্য, অবশ্য এই ঠিকানায় যাওয়া-আসা নিয়মিত। মনে হতে পারে দিল্লী প্রবাসে পরিচয়, সম্পর্ক গভীর হয়েছে একসাথে থাকার সাথে সাথে। অতি সরল সমীকরণ। মনের মিল শুধু নয়, প্রকৃত বন্ধুত্বের স্থায়িত্ব নির্ভর করে আস্থা, শ্রদ্ধা ও প্রীতি পরস্পরের প্রতি— তার ওপর। অবশ্য মেদিনীপুরবাসীর নিজেদের প্রতি আকর্ষণ ও একজোট হওয়ার প্রবণতা বেশিমাত্রায় প্রকট বলে সাধারণের ধারণা। যাই হোক, প্রয়োজন এই দুই বর্ণময় ব্যক্তিত্বের রাজনৈতিক সংঘর্ষময় দিনগুলি দেখা। পরিচয় সূত্রের আঁচ পাওয়ার সম্ভাবনা। জীবনের আদিপর্বের কথা, দিল্লী প্রবাসের দিনগুলি ও শিক্ষাদীক্ষা ইঙ্গিত পারে তাঁদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বিবিধ বৈচিত্রের। এই প্রসঙ্গে লিপিবদ্ধ দু’জনের সংক্ষিপ্ত জীবনী।
বসন্তকুমার (দাস)
জন্ম খেজুরী থানার রমচক গ্রামে ১৮৯৮ সালে। মাতা সুধারানী দেবী ও পিতা ইন্দ্রনারায়ণ। গ্রামের প্রথমিক শিক্ষার পর মহকুমা শহর কাঁথি, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা স্বনামধন্য উকিল ক্ষীরোদচন্দ্রের তত্ত্বাবধানে ম্যাট্রিকুলেশন প্রথম বিভাগে কাঁথি হাইস্কুল থেকে। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ১৯১৪ সালে বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। বি.এসসি পড়াকালীন ‘অনুশীলন সমিতি’র সাথে যোগাযোগ বিপ্লববাদের স্পর্শ, কলেজ থেকে বহিষ্কার। পরে বোমার মামলায় জড়িয়ে ১৯১৬ সালে ২ বছরের জেল ও গৃহে অন্তরীণ। সুরেন্দ্রনাথ কলেজের (বঙ্গবাসী কলেজও হতে পারে) ছাত্র হিসেবে পরে গ্র্যাজুয়েশন (ডিগ্রি নিয়ে যদিও মতান্তর রয়েছে)। বিশ বছর বয়সে বিবাহ ১৯১৮ সালে। গান্ধিজির নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান ১৯২১ সালের শুরুতে। শিক্ষক হলেন কাঁথির জাতীয় বিদ্যালয়ের। যোগাযোগ জেলার অন্যান্য জাতীয় বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাথে। বরণ অহিংস সত্যাগ্রহীর জীবন। কংগ্রেসের কর্মাধক্ষ্য রূপে ১৯২১ সালের শেষভাগে ১ বছরের কারাবাস। স্বাধীনতা সংগ্রামের নানা পর্যায়ে বার বার কারাবরণ। ১০ বছরের বেশি কারাবাস, ‘ভারত-ছাড়ো’ আন্দোলনে টানা ৩ বছর।
বসন্তকুমার (দাস)
সুদীর্ঘ প্রায় ২৪ বছর নিবেদিত স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলনে। নিষ্ঠা, সততা ও নিরলস কর্মের দ্বারা চমকপ্রদ উত্থান। হলেন নিজ মহকুমার প্রথম সারির কংগ্রেস নেতা, পরে মেদিনীপুর জেলা কংগ্রেসের সম্পাদক এবং তিনের দশকের শেষভাগে প্রদেশ-কংগ্রেসের সহ-সম্পাদক। পরবর্তীকালে গণ পরিষদের সদস্য ১৯৪৭ সালে, প্রভিশনাল লোকসভার সদস্য এবং প্রথম ও তৃতীয় লোকসভার সাংসদ। মাঝে পশ্চিমবঙ্গের বিধান পরিষদের সদস্যও। সাংসদরূপে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন ভারত সরকারের। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য— Chairman of the Rehabilitation Finance Administration Advisory Board এবং Indian Central Jute Committee-এর সদস্য। নেতৃত্ব দিলেন ভারত সরকারের সোভিয়েত রাশিয়া দর্শনে কৃষিবিষয়ক প্রতিনিধি দলের, ১৯৫৬ সালে। তাঁর উদ্যোগী ভূমিকায় ১৯৪৭ সালে খেজুরীতে স্থাপিত ‘খেজুরী আদর্শ বিদ্যাপীঠ’ ও ‘সুভাষ শিল্পভারতী’। আবার ১৯৬১ সালে তাঁর নেতৃত্বে আত্মপ্রকাশ করে ‘খেজুরী আদর্শ বালিকা বিদ্যাপীঠ’। কাঁথি মহকুমার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি/সম্পাদকরূপে প্রগতি ও সমৃদ্ধিতে তাঁর প্রশংসনীয় ভূমিকা। সমান্তরালভাবে খাদি ও চরকা প্রচারে এবং সমাজসেবামূলক কাজে বিশেষ সাফল্য। জীবনের শেষভাগে অসামান্য রচনাত্মক প্রয়াস ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে মেদিনীপুর’ (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড) রচনা অভূতপূর্ব কৃতিত্বের সাক্ষ্য রাখে। স্বাধীনতা সংগ্রামের উপর ইংরেজি ও বাংলায় লেখা বইগুলি গুণীজন দ্বারা সমাদৃত। ১৯৮৪ সালে, ৮৬ বছর বয়সে জীবন পরিক্রমার পরিসমাপ্তি। সাক্ষী রইলো তাঁর কর্ম, রেখে গেলেন চার পুত্র, এক কন্যা, নাতি-নাতনি ও বিধবা স্ত্রীকে।
সতীশচন্দ্র (সামন্ত)
জন্ম ১৯০০ সালে মহিষাদল থানার গোপালপুর গ্রামে। পিতা ত্রৈলোক্যনাথ, মাতা কিশোরী দেবী। প্রাথমিক শিক্ষা মহিষাদল রাজ হাইস্কুলে, তারপর কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজে। ভর্তি হলেন শিবপুর বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং-কলেজে। দ্বিতীয় বর্ষে কংগ্রেসের ডাকে ১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান। উল্লেখ্য, স্কুল ছাত্রাবস্থায় ১৫-১৬ বছর বয়সে বিপ্লবী স্বামী প্রজ্ঞানন্দের (মহিষাদলে অন্তরীণ সে সময়ে) কাছে দেশপ্রেমের দীক্ষা ও সারাজীবন ব্রহ্মচর্য পালনের শপথ। আন্দোলনের শুরুতে মহিষাদল থানার কাঁকুড়দহ গ্রামে স্থাপিত জাতীয় বিদ্যালয়ে যোগ দিলেন। তখন প্রধান শিক্ষক শ্রীগুণধর হাজরা। তাঁর অকালে মৃত্যুর পর আরও দু’জন প্রধান শিক্ষক হন। পরে শ্রীসতীশচন্দ্র এই জাতীয় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। ইতিমধ্যে বড় করে শুরু তাঁর সমাজসেবামূলক প্রকল্প এবং রাজনৈতিক কার্যকলাপ।
সতীশচন্দ্র (সামন্ত)
যুবরাজ পঞ্চম জর্জের ভারত আগমন বর্জনে যোগদান করেন। গ্রেফতার ১৯২১ সালের শেষভাগে। ৬ মাসের সশ্রম কারাদণ্ড ও ১০০ টাকা জরিমানা। মহিষাদল থানার কংগ্রেস সম্পাদক হন ১৯২২ সালে ও ১৯২৪ সালে। তমলুক ও পাঁশকুড়া থানার সম্পাদক ছিলেন ১৯৩১ সাল থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত। ‘ভারত-ছাড়ো’ আন্দোলনে সতীশ্চন্দ্রের ভূমিকা চমকপ্রদ ও উল্লেখযোগ্য। তাঁর নেতৃত্বে ‘স্বাধীন জাতীয় তাম্রলিপ্ত সরকার’ ১৭ই ডিসেম্বর ১৯৪২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর স্থায়িত্বকাল ২ বছর। গান্ধিজির নির্দেশে প্রাত্যাহৃত হয় ১৯৪৪ সালের ১ লা সেপ্টেম্বর। সর্বাধিনায়ক সতীশচন্দ্র অবশ্য গ্রেফতার হন ১৯৪৩ সালের জুন মাসে। বার বার কারাবরণ নানা সময়ে। মোটামুটি ৭ বছর ছিলেন কারান্তরালে। ১৯৪৭ সালে গণো পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। পরে প্রভিশনাল লোকসভার সদস্য এবং ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত লোকসভার সদস্য পদ অলংকৃত করেন। অসাধারণ কৃতিত্বের অধিকারী ছিলেন তিনি। নানান সময়ে নানান গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন, হয়ে ওঠেন সবার প্রিয় ‘সতীশদা’। ৮৩ বছর বয়সে ১৯৮৩ আলে এই অকুতোভয় স্বাধীনতা সংগ্রামী, সমাজসেবী অকৃতদার সতীশ্চন্দ্র অমরলোকে যাত্রা করেন।
জীবনের ছবি তুলে ধরে বেশ কিছু কথা। বসন্তকুমার বয়সে দু’বছরের বড়। সতীশচন্দ্র বসন্তদা বলে ডাকেন আর বসন্তকুমার সতীশবাবু। অসহযোগ আন্দোলনে দুজনেই একই সালে যোগদান করেন, ১৯২১ সালে। জাতীয় বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা দুজনের। স্বাধীনতা সংগ্রামে এঁদের ভূমিকা আশ্চর্যজনকরূপে সমান্তরালভাবে বেগবান। শিক্ষকতার সুবাদে ও মেদিনীপুরের বিভিন্নপ্রান্তে সমাজসেবা ও স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনা করেন। কংগ্রেসের নেতারূপে দুজনের সাক্ষাৎ ও পরিচয় স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাশিত ছিল। বসন্তকুমার এক সময় হয়েছেন মেদিনীপুর জেলার কংগ্রেস সম্পাদক। সেক্ষেত্রে তমলুক, মহিষাদল প্রভৃতি জেলার অঞ্চলে কংগ্রেসকর্মী ও নেতাদের সাথে তাঁর যে যোগাযোগ ঘটবে তা সহজেই অনুমেয়। অনস্বীকার্য দুজনের পরিচয় জীবনের সংগ্রাম-মুখর দিনগুলিতে। বিস্ময়কর যোগ। তারুণ্যদীপ্ত জীবনের প্রারম্ভে দুজনের স্বদেশমুক্তির প্রতিজ্ঞার উদ্বোধন বিপ্লববাদের রোমাঞ্চিত চেতনার উন্মেষে। সতীশচন্দ্রের দীক্ষাগুরু বিপ্লবী সন্ন্যাসী প্রজ্ঞানন্দ, যুগান্তরের বরিশাল দলের কর্ণধার (বরিশাল রেভ্যুলিউশনারি অর্গানাইজেশন)। কলকাতায় কলেজে ছাত্র থাকাকালীন অনুশীলন সমিতির দ্বারা বিপ্লববাদে প্রভাবিত হন বসন্তকুমার। পরবর্তীকালে দুজনে হয়েছেন গান্ধিজির নেতৃত্বে অহিংস সত্যাগ্রহী। বরণ করেছেন কারাবাস বারবার, স্বাধীনতা সংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ে। অবশেষে একই সাথে ১৯৪৭ সালে গণ পরিষদের সদস্য, হয়েছেন প্রভিশনাল ও প্রথম লোকসভার নির্বাচিত সদস্য।
বসন্তকুমার (দাস)
দিল্লী প্রবাসের ঠিকানা ৭ নং ইলেক্ট্রিক লেন। সাহেবি বাংলো। সামনে বড় লন। চারিদিকের কাঁটাগাছের সীমানা। কাঠের বড় গেট। বাংলোয় চারটি ঘর, তিনটি বাথরুম, বড় ডাইনিং হল, স্টোর রুম, চাকরদের ঘর আর বেশ বড় বাগান। সতীশচন্দ্র থাকতেন ঢুকেই প্রথম ঘরে আর বসন্তকুমার থাকতেন সবচেয়ে শেষের ঘরে। এঁদের সঙ্গে থাকতেন আর একজন সাংসদ শ্রী উপেন্দ্রনাথ বর্মন। খাওয়া-দাওয়া যৌথভাবে। ব্যবস্থাপনা বসন্তকুমারের। তিনি সবার বসন্তদা। বসন্তকুমার ও সতীশচন্দ্র কাকভোরে বেরিয়ে পড়তেন প্রাতঃভ্রমণে। শীত কিংবা গ্রীষ্ম একই রুটিন। তারপরে সবাইমিলে চায়ের টেবিলে। দশটার মধ্যে খাওয়া-দাওয়া সেরে সবাই প্রস্তুত। যাত্রা লোকসভার গাড়িতে। অধিবেশন শুরু পৌনে ১১ টায়। চলত বিকেল ৫ টা বা সন্ধ্যে ৬ টা পর্যন্ত। কখনও বা রাত অবধি। অবশ্য মাঝে বিরতি। অধিবেশন শেষে গাড়িতে করে ফেরা। সন্ধ্যায় চায়ের আসর। অনেকে হাজির হতেন— যেমন বাঙালি আমলা, রাজনীতির লোক, সাংবাদিক প্রমুখ। সংসদের বিশেষ বিশেষ ঘটনা উঠে আসত আলোচনায়। চলত নানা রসিকতা। শোনা যেত সতীশচন্দ্রের আশুতোষ-মার্কা গোঁফের ফাঁকে উচ্চ হাসি, আর দাঁড়ি-গোঁফ কামানো মুখের ফাঁকে নিঃশব্দ মুচকি হাসি। সাড়ে ৯ টা কিংবা ১০ টার মধ্যে রাতের খাবার। যে যার ঘরে তারপর। প্রস্তুতি পরের দিনের জন্য। প্রয়োজন হলে রাত ১২ টা পর্যন্ত কাজ। বলা আবশ্যক, মেদিনীপুর সংক্রান্ত কাজে সবসময় দুজনার আলোচনা, যৌথ খসড়া কীভাবে এগোনো যায়। নিজ জেলার জন্য উভয়ের যুগ্ম প্রচেষ্টা। ছুটির দিনগুলিতে সকালের অনেকটা সময় যেত বাগানের কাজে। প্রায় দেখা যেত, সতীশচন্দ্র কোদাল দিয়ে মাটি কোপাচ্ছেন আর বসন্তকুমার পেছনে পেছনে চলেছেন আগাছা পরিষ্কার করতে করতে। তাঁরা তখন মাটির মানুষ, আনন্দে মাতোয়ারা। অভূতপূর্ব মনোরম যুগলবন্দি।
বসন্তকুমারের স্ত্রী তরঙ্গিনী দেবীকে সতীশচন্দ্র ডাকেন বৌদি বলে। প্রায় প্রতি বছর শীতের সময়ে আসেন দিল্লীতে। ছেলেদের সেই সময় স্কুল কলেজের ছুটি। বৌদির হাতের খাবার— সবাই খুশি। সতীশচন্দ্র আরও বেশি খুশি মেদিনীপুরের রান্না পেয়ে। ভালো খাবার, বিশেষ করে মুখরোচক তাঁর প্রিয়। সেবার ঘটল অঘটন। বসন্তকুমারের ছোট ছেলে প্রকাশকান্তি (প্রবন্ধের লেখক) বয়স ৮ কিংবা ৯ হবে, সকালে চায়ের টেবিলে গরহাজির। খবর নিয়ে জানা গেল— বেরিয়েছে খুব ভোরে, ঘণ্টা দুয়েক আগে। আশেপাশে, কাছাকাছি জায়গায় খোঁজ করেও পাওয়া যাচ্ছে না। মা তরঙ্গিনী দেবী আতঙ্কে সারা। বসন্তকুমার উদ্বিগ্ন ও গম্ভীর। সতীশচন্দ্র নিজে বেরিয়েছেন খোঁজ নিতে। না পেলে পুলিশে খবর দিতে হবে। জনৈক নন্দ মশাই সস্ত্রীক এই সময় এই ঠিকানায়। তিনিও সতীশাকাকাবাবুর (প্রাকাশকান্তি কাকাবাবু বলেন) সাথে। অনেক খোঁজা খুঁজির পরে কার্জন রোডের মোড়ে পাওয়া গেল প্রকাশকান্তিকে। হতভম্ব ছেলে, রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু সাহস হারায়নি। কান্নাকাটিও করেনি। সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। কাকাবাবু খোকার (এই নামে তিনি ডাকতেন) পিঠ চাপড়ে দিলেন। বুঝলেন হিন্দি কথা না জানার জন্য এই বিপত্তি। আশ্বাস, কয়েকদিন বাসার পাহাড়ি কাজের লোকটির সাথে কথা চালিয়ে গেলে মোটামুটি চলনসই হিন্দি রপ্ত হয়ে যাবে। সেদিন আর চা খাওয়া হল না। স্নান সেরে, খাওয়া-দাওয়া সেরে লোকসভার পথে। কিছুদিন পরে প্রকাশকান্তির সাংঘাতিক ধরনের অ্যালার্জি। সারা শরীর জ্বালা করে আর চুলকায়। কোনো ওষুধে সারছে না। কাকাবাবুর পরামর্শ। পুরানো দিল্লী থেকে ডাক্তার এলেন। তাঁর চিকিৎসায় সারলো। কাকাবাবু (সতীশচন্দ্র) সবসময় বিপদে আপদে পাশে। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ছাড়া এমন বন্ধুত্ব হয় না।
সতীশচন্দ্র (সামন্ত)
বিশেষ কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ বা করলেই নয়। দ্বিতীয় লোকসভার নির্বাচন। সবাই নিশ্চিত বসন্তকুমারের জয় নিয়ে। তাঁর জনপ্রিয়তা ও সততা সংশয়ের ঊর্দ্ধে। অত্যাশ্চর্য, হারলেন— অল্প ভোটের ব্যবধানে। সতীশচন্দ্র বিশ্বাস করতে পারছেন না। তিনি আবারও জয়ী। আবার ৭ নং ইলেক্ট্রিক লেনে। বসন্তকুমার আসতে পারলেন না। তিনি ঠিক করলেন বসন্তদার ঘরে আর কেউ থাকবে না। স্থির বিশ্বাস দাদা আবার ফিরে আসবেন। বিশ্বাস যে অমূলক নয়, তা প্রমাণিত। তৃতীয় লোকসভা নির্বাচনে বসন্তকুমারের অভাবনীয় সাফল্য। পশ্চিমবঙ্গের ভূতপূর্ব মুখ্যমন্ত্রী ড. প্রফুল্ল ঘোষকে বিপুল ভোটে হারিয়ে আবার তিনি সাংসদ। ইলেক্ট্রিক লেনের সেই শেষের ঘরে আবারও তিনি। সতীশচন্দ্রের অভ্যর্থনা। দু’জনে আগের মতো একসাথে। শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, বন্ধুত্বের অপূর্ব নিদর্শন। কিছুকাল পরে বসন্তকুমার অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। ব্যবস্থায় ও দেখাশোনার দায়িত্বে সতীশবাবু। কাঁথি থেকে এলেন স্ত্রী তরঙ্গিনী দেবী। প্রায় একমাস বাদে সুস্থ হলেন। সবাই খুশি। সব কিছু আবার আগের মতো। দু’জনে পড়লেন হলদিয়া নিয়ে। বন্দর গড়ে তুলতে হবে। বিভিন্ন রিপোর্ট খুঁটিয়ে দেখা। রাতের পরে রাত কাটে খসড়া তৈরিতে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে ঘোরা নিয়ম করে। নানা প্রশ্ন, খরচের খতিয়ান। বন্দরের জন্য জমিজমার হিসেব, যারা ঘর-বাড়ি হারাবে তাদের জন্য পুনর্বাসনের ব্যবস্থা, বন্দরে যে কেমিক্যাল হাব হওয়ার কথা তার বাণিজ্যিক দিক সর্বোপরি বন্দরের ভবিষ্যৎ ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে একটি প্রজেক্ট তৈরি করা এবং যুক্তি সহকারে তা উপস্থাপনা নিঃসন্দেহে একটি বিরাট কঠিন কাজ। মেদিনীপুরের দুই প্রবীণ সাংসদের প্রশংসনীয় অগ্রণী ভূমিকা, অভূতপূর্ব নিরলস প্রচেষ্টা। প্রকাশকান্তির সৌভাগ্য হয়েছিল সেই দিনগুলি চাক্ষুষ দেখার। তখন সে উচ্চ শিক্ষার জন্য দিল্লীর আইআরআই-এর ছাত্র। সেখান থেকে পিএইচডি জেনেটিক্সে ১৯৬৮ সালে। টানা ছ’বছর দিল্লী-বাস ১৯৬২ সাল থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত। সেই সময় আর এক অভিজ্ঞতা। এবারের বিষয়টি মেদিনীপুরের স্বার্থে। ড. অনিলকুমার গায়েন, (বিভাগীয় প্রধান, সংখ্যাতত্ত্ব বিভাগ, আইআইটি-খড়্গপুর) প্রায় আসতেন ও অতিথি হয়ে থাকতেন ৭ নং ইলেক্ট্রিক লেনে, বসন্তকুমারের অতিথি হয়ে। তাঁর বাড়ি খেজুরীতে, বসন্তকুমারের Constituency-এর অন্তর্গত। তাঁর স্বপ্ন মেদিনীপুরে বিদ্যাসাগরের নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা। সেই ব্যাপারে বারে বারে দিল্লীতে আসা। প্রকাশকান্তির সাথেও কথা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে হবে পঠনপাঠনের সাথে গবেষণা। মূল লক্ষ্য গ্রামীণ উন্নতি ও উপজাতি গোষ্ঠীর সর্বাঙ্গীন উন্নয়ন। এককথায় আর পাঁচটা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো নয়। প্রয়োজনে উপরমহলে তদ্বির করা। মেদিনীপুরের এই দুই সাংসদের বিশেষ সাহায্য প্রয়োজন। শুরু হল বসন্তকুমার ও সতীশচন্দ্রের দৌড়-ঝাঁপ। জমি পাওয়া থেকে শুরু করে সরকারি অনুদান ইত্যাদি নিয়ে প্রজেক্ট করা চলে ড. গায়েনের সহযোগিতায়। অনেক কাঠখড় পোড়ান। কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রণালয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনে তদ্বির— সেই সঙ্গে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীর দরবারে। রাজ্য-রাজনীতির পট পরিবর্তন। তবু চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। ড. গায়েনের মৃত্যুর কিছুকাল পরে ‘বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়’-এর আত্মপ্রকাশ। নেপথ্যের ইতিহাস রইলো অন্তরালে।
সুধী পাঠক, তৃতীয় লোকসভার প্রশ্ন-উত্তরগুলি দেখলে, দেখবেন সতীশচন্দ্র ও বসন্তকুমার যৌথভাবে প্রশ্ন রাখছেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। আলোচনাতেও একে অন্যের সাথে। পাটের দাম নিয়ে আধঘণ্টার উপর যে আলোচনা, তাতেও দু’জনের একত্র অংশগ্রহণ বিষয়টিকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। তাঁদের জোরালো বক্তব্য সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বাংলার কৃষকের সমস্যা ও সমাধানে তাঁরা দু’জনে সমানভাবে সরব। দেশের সীমানা সংক্রান্ত বিষয় ও নিরাপত্তা-প্রতিরক্ষার ব্যাপারে তাঁদের বক্তব্য বার বার লোকসভায় উপস্থাপিত হয়েছে। উপযুক্ত পুনর্বাসন বিশেষকরে পূর্ব-পাকিস্তান থেকে আগত ছিন্নমূল হিন্দুদের বিষয়ে— উভয়ে যৌথভাবে সচেষ্ট হন লোকসভায়। মেদিনীপুরের পাশাপাশি দূর্গাপুর ও আসানসোলেও শিল্প স্থাপনের প্রয়াস শিল্পের সম্ভাবনাকে আরও ত্বরান্বিত করে। প্রত্যাশিতভাবে উদ্ভাসিত তাঁদের অসাধারণ মেলবন্ধনের ছবি।
বসন্তকুমার (দাস)
এই প্রসঙ্গে একটি একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়ের উপস্থাপনা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। বিলেতে উচ্চ গবেষণার পরে প্রকাশকান্তি ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে সপুত্র দিল্লীর ৭ নং ইলেক্ট্রিক লেনে। ইতিমধ্যে বিশ্ব ইতিহাসে নতুন সংযোজন হয়েছে। পূর্ব-পাকিস্তানের অবলুপ্তির মধ্য দিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র ‘বাংলাদেশ’-এর জন্ম। বাংলার রাজনীতিতে আলোড়ন। নতুন রাজনৈতিক দল ‘বাংলা কংগ্রেস’-এর আত্মপ্রকাশ শ্রীঅজয় মুখার্জীর নেতৃত্বে। তিনি সতীশচন্দ্রের সহযোদ্ধা (স্বাধীন তাম্রলিপ্ত সরকার গড়ার সময়ে) ও সহকর্মী ও বসন্তকুমারের ঘনিষ্ঠ সুহৃদ। শ্রীসতীশচন্দ্র সে সময় সক্রিয় সাংসদ, বসন্তকুমার নন, স্বেচ্ছাবসর নিয়েছেন রাজনীতি থেকে। অসুস্থ সন্তানের স্বার্থে (প্রাণঘাতী সমস্যা) প্রকাশকান্তির দিল্লীতে থাকা প্রয়োজন। তিনি তখন চেষ্টা করছেন তাঁর নিজের পুরানো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (আইআরআই-দিল্লী) ‘পুল অফিসার’ হয়ে যোগদান। সমস্যা গজেন্দ্র গাদকার কমিশনের রিপোর্ট, আইআরআই-দিল্লীতে লোক নিয়োগের উপর বিধিনিষেধ। কেবল জাতীয় স্বার্থে ও মানবতার খাতিরে শিথিলতা। উপস্থিত বসন্তকুমার। এসেছেন ছেলে ও তাঁর পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে যেতে। সতীশকাকু (প্রকাশকান্তি কাকাবাবু বলেন) ও পিতা বসন্তকুমার সম্যক অবগত সমস্যার ব্যাপারে। কাকাবাবু জানেন, বসন্তকুমার শত অনুরোধেও কাউকে কিছু বলবেন না। এটা তাঁর নীতি বিরুদ্ধ। বসন্তদার সমস্যা অবশ্যই তাঁরও সমস্যা। খোকার জন্য তাঁকে কিছু করতে হবে। স্বতঃপ্রণোদিত একক উদ্যোগ। ডাইরেক্টর জেনারেলের সাথে কথা বললেন। আর তাতেই সমস্যার সমাধান। পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও বন্ধুত্বের বিরল উজ্জ্বল উদাহরণ।
সতীশচন্দ্রের সাংসদ জীবনের সমাপ্তি ১৯৭৭ সালে। দীর্ঘ ৩০ বছরের দিল্লী-জীবনের যবনিকা পতন। বসন্তকুমার স্থির-প্রতিজ্ঞ মেদিনীপুরের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস রচনায়। গঠন করলেন স্বাধীনতা সংগ্রামে মেদিনীপুর ইতিহাস সমিতি। সভাপতি শ্রীঅজয় মুখার্জী, কোষাধক্ষ্য শ্রীসতীশচন্দ্র এবং সম্পাদক শ্রীবসন্তকুমার, এছাড়াও আরও কয়েকজন কর্মপরিষদের সদস্য। আর্থিক সাহায্য লাভের জন্য বসন্তকুমার ও সতীশচন্দ্র সক্রিয় হলেন। দুই বৃদ্ধ একসাথে এক মহৎ কর্মযজ্ঞে। বিশেষ আর্থিক অনুদান ও অন্যান্য সাহায্য পেলেন জাতীয় কংগ্রেস থেকে। প্রদেশ কংগ্রেসও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল। অন্যান্য সংস্থাও বাড়িয়ে দিল সাহায্যের হাত। পূর্ণোদ্যমে চলতে লাগলো সমিতির কাজ। বসন্তকুমার গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে সংগ্রহ করলেন নানা অমূল্য তথ্য। অবশেষে ১৯৮০ সালের ১৪ই অগাস্ট প্রকাশিত ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে মেদিনীপুর’ (প্রথম খণ্ড)। মেদিনীপুরের তিন মহান স্বদেশপ্রেমিকের সার্থক নিরিলস প্রয়াস। সুহৃদয় পাঠক, মনে রাখবেন বসন্তকুমারের বয়স তখন ৮২, সতীশচন্দ্রের ৮০ আর ৭৯ অজয় মুখার্জীর। দেশের প্রতি অমলিন ভালোবাসা তাঁদের অনুপ্রেরণার উৎস। সুগভীর বন্ধুত্বের মেলবন্ধনে বিকশিত ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে মেদিনীপুর’ সমাদৃত এক আকরগ্রন্থ বিদগ্ধজনের কাছে।
সতীশচন্দ্র (সামন্ত)
বসন্তকুমার কলকাতায় দ্বিতীয় খণ্ড রচনায় আত্মমগ্ন। সতীশচন্দ্রের আবাস মহিষাদলের প্রজ্ঞানন্দ ভবন, উৎসর্গ তাঁর দীক্ষাগুরুর নামে। তখন সতীশচন্দ্র অসুস্থ। বন্ধুবর ছুটলেন মহিষাদলে। চোখের জলে ভাসলেন দু’জনে। প্রাণের বন্ধু, অকৃতদার, চির সংগ্রামী সতীশ্চন্দ্রের শেষ যাত্রা আসন্ন। প্রকাশকান্তিকে জানালেন আর কোনো আশা নেই। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বসন্তকুমারের প্রত্যাবর্তন। সতীশচন্দ্র যাত্রা করলেন অমৃতলোকে ৪ ঠা জুন ১৯৮৩ সালে। অপূর্ব মেলবন্ধনের চির বিচ্ছেদ। শেষযাত্রায় যোগ দিলেন বসন্তকুমার। সঙ্গে নাতি শ্যামলকান্তি ও সাংবাদিক সাহিত্যিক শ্রীনিমাই ভট্টাচার্য। সুগভীর সুদীর্ঘ বন্ধুত্বের যবনিকা পতন নিয়তির করাল আঘাতে। সাক্ষী রইলো ইতিহাস।
M E D I N I K A T H A J O U R N A L
Edited by Arindam Bhowmik
Published on 14.04.2024
নিচে কমেন্ট বক্সে আপনার মূল্যবান মতামত জানান।