লালজল, Laljal, Binpur, Jhargram

লালজল


Laljal


আনন্দরূপ নায়েক।



Home » Medinikatha Journal » Anandarup Nayek » লালজল



ঘড়ি দেখলাম, তিনটে পঞ্চাশ। হাতে সময় আছে খানিক। এই বিকেলেও গনগনে সূর্যের প্রচন্ড রোদ। শুকনো লু বইছে প্রবল। কালবৈশাখীর আভাস নেই। এখন পোড়াডি। বাঁকুড়া ঝাড়গ্রাম সীমানা পেরোচ্ছি। রাস্তার ধারের মহুল গাছটা দেখিয়ে স্বপনদাকে বললাম, 'মনে আছে, এই গাছের গা থেকে অর্কিড পেড়েছিলাম সেবার?' লালবাসা। লালজল বাসস্টপ।


লালজল, Laljal, Binpur, Jhargram
লালজল, Laljal

সামনে পাহাড়ের খাড়া চড়াই। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অশোক গাছটাকে আমি বছর দশেক ধরে চিনি। বসন্ত এলে ফুল ফোটে ডাল ভরে। প্রশ্ন এখন, 'সোজা যাবো না বাঁ দিক?' চার সেকেন্ডের ডিসিশন মেকিং। বললাম, 'বাঁ দিকেই যাই চলো'। পিচ রাস্তা থেকে পাথুরে মাটির একটা সরু জঙ্গলি পথ চলে গেছে পূব পানে। দুপাশে পাহাড়ি জঙ্গল ঘন হয়ে আসছে ক্রমে। শাল, মহুল, পিয়াল, শিরিষ, বেল, আসন, কুসুম, সেগুন, কেন্দু, কুরচি, করঞ্জা, অর্জুন, গামার, ছাতিম আর নাম না জানা অসংখ্য বুনো লতা গুল্ম বৃক্ষ।


লালজল, Laljal, Binpur, Jhargram
লালজল, Laljal

কোথাও কোনও লোকজন নেই। স্বপনদা বলল, 'ঠিক যাচ্ছি তো?' তারপর নিজেই উত্তর দিল, 'নাহ, ঠিকই আছে। মাটিতে গাড়ির টায়ারের দাগ দেখছি'। কিলোমিটার দুই দূরে ফাঁকা জায়গায় একটা কুসুম গাছের কাছে এসে বুঝলাম, এখানেই থামতে হবে। গ্রামের নাম লালজল। এখানকার ঝরনার জলে গুঁড়ো গুঁড়ো হেমাটাইট লোহা আর তামার আকরিক মিশে প্রস্রবনকে করেছে লাল। তাই এমনতরো লালজল নাম। এখন ঝরনা শুকিয়ে গেছে।


লালজল, Laljal, Binpur, Jhargram
লালজল, Laljal

গ্রামের দক্ষিণ পূর্বে সিংলহর পাহাড়, উত্তরে রানি পাহাড় আর পশ্চিমে দেওপাহাড়। এখানে উমানাথ ভট্টাচার্য্যের 'চারমূর্তি' ফিল্মের, ওই টেনিদার গল্পের কিছু অংশের শুটিং হয়েছিল, কোথায় যেন পড়েছিলাম।


লালজল, Laljal, Binpur, Jhargram
লালজল, Laljal

রামস্বরূপ সাধুর আশ্রম এখানে। মাটির বাড়ি, টিনের চাল। একটা বোর্ডে লেখা রয়েছে এ আশ্রমের প্রতিষ্ঠা ঊনিশশ আটান্ন সালে। পাতার সঙ্গে কথা হল খানিক। পাতা দেশওয়ালি। পঞ্চাশোর্ধ বয়স্ক মহিলা। শিলদার কাছে শুকজোড়া বলে গ্রাম আছে কোনও? সেখানেই তার আদি বাড়ি। পাতা একা থাকে আশ্রমে। দেবতার সামনে গিয়ে প্রণাম করলাম। সে প্রসাদ দিল। তরমুজ, শশা, আপেল, বাতাসা। জিজ্ঞেস করলাম, 'রাতেও তুমি একা থাকো? তোমার ভয় করে না?' সে বলে, 'কীসের ভয়? ঠাকুর আছে এখানে। কেউ ক্ষতি করে না।


লালজল, Laljal, Binpur, Jhargram
লালজল, Laljal

আমার মাথা তখন খারাপ ছিল। পাগল ছিলাম। অনেক বছর আগে ঘুরতে ঘুরতে এখানে এলাম। গাছের পাতা পাথরে ছেঁচে খেতাম। এখানেই পড়ে থাকতাম। গুহার ভিতরেও ঢুকেছি। তারপর মায়ের কৃপায় ভালো হয়ে গেলাম। গ্রামের লোকেরা ঠিক করল আমি এখানেই থাকব। সেই থেকে আছি'। পাতা তার অলৌকিক বিশ্বাস নিয়ে বেঁচে আছে। থাকবেও। যতদিন 'দেবতায় বিশ্বাস' থাকে মানুষের, ততদিন একাকী মহিলার ক্ষতি হয় না।


লালজল, Laljal, Binpur, Jhargram
লালজল, Laljal

সাধু রামস্বরূপ দেব শর্মার ছবি দেখলাম। পদ্মাসনে বসা, পেছনে দাঁড়িয়ে বাঘ। কথিত আছে, আশ্রম প্রতিষ্ঠার আগে রামস্বরূপ সাধু গুহার ভেতর ধ্যান করতেন। সঙ্গে থাকত বশীকৃত বাঘ। গায়ে ঘুরে বেড়াত খরিশ কিংবা কেউটে। মানুষ ও বন্যপ্রাণের আক্ষরিক সহাবস্থান। ঊনিশশ তিরাশি সালে তিনি এখানে বাসন্তীপুজো শুরু করেছিলেন। সেই থেকে প্রতিবছর বাসন্তীপুজোর সময় পাঁচদিন ধরে মেলা বসে। পঁচানব্বইতে সাধু রামস্বরূপ মারা যান। দেওপাহাড়ের নীচে এই আশ্রমের পাশে সমাধিস্থ করা হয় তাঁকে।


লালজল, Laljal, Binpur, Jhargram
লালজল, Laljal

লালজল দেবী পাহাড়ে বড় বড় পাথরের চাঁই। পাথরগুলো একটার পর একটা অদ্ভুতভাবে সজ্জিত। রূপান্তরিত শিলা বলেই এখানে ধস নামার প্রবণতা কম। পাথরের খাঁজে খাঁজে জন্মানো চেনা অচেনা লতা গুল্ম বুনো আগাছা। খুব সতর্কতায় পা ফেলে উঁচু উঁচু পাথর ডিঙিয়ে উঠছিলাম ওপরে। ভুল পা ফেললে মুহূর্তে দুর্ঘটনার সম্ভবনা।


লালজল, Laljal, Binpur, Jhargram
লালজল, Laljal

স্বপনদার হাতে আমার ফোন, ছবি তুলছিল। বলল, 'সাবধানে আসবেন। মনে থাকে যেন পায়ের লিগামেন্ট ছেঁড়া। আরও কিছু হলে বিপদ'। প্রায় দুশ মিটার মতো উঁচু এই পাহাড়। খানিক ওঠার পর সদ্য তৈরি হওয়া সবুজ রঙ করা সিমেন্টের ফাঁকা মন্ডপ। বাসন্তী পুজোর সময় প্রতিমা স্থাপিত হয় এখানে। আরও ওপরে উঠলে গুহা। সরু গুহামুখ, গাঢ় অন্ধকার চাপ চাপ হয়ে আছে।


লালজল, Laljal, Binpur, Jhargram
লালজল, Laljal

পাতার কাছে শোনা, গুহার সরু পথ ধরে হামাগুড়ি দিয়ে বুকে হেঁটে সাপের মতো এঁকেবেঁকে এগোলে ভেতরে দুটো প্রশস্ত জায়গা আছে। এখানে এককালে চিতাবাঘ ছিল। বাঘও কি থাকত এখানে? এই মুহূর্তে বাদুড়, শজারু, শেয়াল, হায়না কিংবা নেকড়ে থাকা বিচিত্র কিছু নয়। অথবা এসব জায়গা পাইথনের আদর্শ বাসঘর। কোবরা, ক্রেইট, ভাইপার যে অবশ্যই আছে, বলা বাহুল্য। অথবা কাঁকড়া বিছে, তেঁতুলে বিছে। অজস্র গিরগিটি দেখলাম। প্রচন্ড গরমের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ওদের রঙ এখন টকটকে লালের সঙ্গে ঝিম কালো।


লালজল, Laljal, Binpur, Jhargram
লালজল, Laljal

হাজার হাজার বছর আগে প্যালিওলিথিক নিওলিথিক যুগে এই লালজল গুহার মধ্যে গুহামানবরা থাকত। ঊনিশশ ষাট সালে প্রত্নতত্ব বিভাগের অনুসন্ধানে লালজল থেকে পাওয়া গিয়েছিল পাথরের হাত কুঠার, লাঙ্গল, পাথরের তিরের ফলা, সছিদ্র বলয় ইত্যাদি। লৌহপ্রস্তর যুগের নিদর্শনও মিলেছিল। প্রাচীন মানবের ব্যবহৃত জিনিস পাওয়া গেছে গুহার ভেতর থেকে। গুহার ভেতরের দেওয়ালে গুহামানবদের আঁকা নীলগাইয়ের একাধিক রঙে রঙিন ছবি আছে। এসব ছবি দেখিনি কখনও, বইতে পড়েছি।


লালজল, Laljal, Binpur, Jhargram
লালজল, Laljal

এ অঞ্চলে বহু প্রাচীন জীবাষ্ম পাওয়া গেছে। এখানকার গরুর জীবাষ্মের সঙ্গে শিবালিক পাহাড়ের প্রাচীন গরুর নাকি মিল পাওয়া যায়। পাহাড়ের ওপরটা পাথুরে সমতল। পাহাড়ের ওপরে উঠলে চারিদিকের নিসর্গ অপরূপ। সবুজ সবুজ আর সবুজের কত রকম শেড। এখনও অব্দি টিকে রয়েছে ভার্জিন বিউটি। এ সবের মাঝে সন্তর্পণে ক্রমে এগিয়ে আসছে কংক্রিটের উন্নয়ন। ঝাড়গ্রাম জেলার বিনপুর দুই ব্লকের ভুলাভেদা অঞ্চলের এই লালজল গ্রামে ঢোকার কংক্রিটের পাকা সড়ক হয়েছে আঠেরো সালেরই ফেব্রুয়ারি মাসে। সোলার ল্যাম্প চোখে পড়ল ক'জায়গায়। পঞ্চায়েত থেকে করে দেওয়া টাইলস বসানো হরিমণ্ডপ।


পাহাড়ের ওপর সবুজ রঙা সিমেন্টের বাসন্তী মন্দির, রাস্তার ধারে শান বাঁধানো কুঁয়ো, টিউবকল ছেড়ে ফিরে আসছি তখন পড়ন্ত বিকেল। কুরচি ফুলের গন্ধ ভাসছে বাতাসে। প্রাচীন গাছগুলোর ওপরে আশ্রিত অর্কিড। বিকেলের পড়ন্ত রোদে চকচক করে উঠছে অভ্র মেশানো বহু পুরাতন স্তরীভূত পাথরের অমসৃণ গা। হাজার হাজার বছরের প্রকৃতি ও মানুষের সহাবস্থানের ইতিহাস থেকে গেছে লালজলের পাথরের পরতে পরতে।




M E D I N I K A T H A J O U R N A L

Edited by Arindam Bhowmik

Published on 28.07.2024



নিচে কমেন্ট বক্সে আপনার মূল্যবান মতামত জানান।