শহীদ হরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, Martyr Harendranath Chakraborty, Midnapore Central Jail, মেদিনীপুর কেন্দ্রীয় কারাগার


শহীদ হরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী


(১৯১৬ - ৫ জুন, ১৯৩৪)


Martyr Harendranath Chakraborty



অরিন্দম ভৌমিক।





শহীদ রক্তে সিক্ত মেদিনীপুর। মেদিনীপুরের ভুমিপুত্ররা যেমন প্রাণ দিয়েছেন মেদিনীভূমির জন্য, তেমনই দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বীর বিপ্লবীদের রক্তেও সিক্ত হয়েছে এই মেদিনীপুরের মাটি। অগ্নিযুগের তেমনই এক বীর শহীদ হরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ওরফে হরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য মাত্র ১৮ বছর বয়সে শহীদ হয়েছিলেন মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলে। শহীদ হরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আমরা দেখে নেব সেই সময়ে চট্টগ্রাম এবং সংলগ্ন অঞ্চলের পরিস্থিতি -


শহীদ হরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, Martyr Harendranath Chakraborty, Midnapore Central Jail, মেদিনীপুর কেন্দ্রীয় কারাগার
শহীদ হরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী।


৬ ফেব্রুয়ারী ১৯৩২ সাল।


কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে চ্যান্সেলর গভর্নব স্যার স্ট্যানলী জ্যাকসনকে গুলিতে আহত করলেন ডায়োসেশন কলেজের ছাত্রী, বেণীমাধব দাশের কন্যা বীণা দাস। উনার ৯ বছরের কারদণ্ড হয়।


১৩ জুন ১৯৩২ সাল।


শুরু হয় ঐতিহাসিক ধলঘাট সংঘর্ষ, একদিকে বিরাট এক গুর্খা বাহিনী নিয়ে ক্যাপ্টেন ক্যামেরন। অন্যদিকে সূর্য সেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, নির্মল সেন, অপূর্ব সেন। নির্মল ও অপূর্ব আত্মাহুতি দিলেও সূর্য সেন ও প্রীতিলতা আত্মগোপন করতে সক্ষম হন। ক্যামেরণ নিহত হন।


২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৩২ সাল।


সামরিক পোশাকে সুসজ্জিতা প্রীতিলতার নেতৃত্বে পাহাড়তলী ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রান্ত হল। এর ফলে একজন বৃদ্ধা ইউরোপীয়ান মহিলা নিহত এবং ইনম্পেক্টর ম্যাকডোনান্ড সার্জেন্ট উইলিস এবং অপর ছ'জন ইউরোপীয়ান আহত হন। চট্টগ্রাম শহরের জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদারের কন্যা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক প্রীতিলতা আত্মঘাতিনী হন। মৃত্যুর আগের দিন তিনি তার মাকে মর্মম্পর্শী ভাষায় একটি চিঠি লিখে যান।


শহীদ হরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, Martyr Harendranath Chakraborty, Midnapore Central Jail, মেদিনীপুর কেন্দ্রীয় কারাগার
পাহাড়তলী ইউরোপীয়ান ক্লাব।


২ মার্চ ১৯৩২ সাল।


চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুষ্ঠন মামলার রায় প্রকাশ। বারো জনের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর। এঁরা হলেন গণেশ ঘোষ, অনন্ত সিংহ, লোকনাথ বল, আনন্দ গুপ্ত, ফণী নন্দী, সুবোধ চোধুরী, সহায় রাম দাস, ফকির সেন, লালমোহন সেন, সুখেন্দু দস্তিদার, সুবোধ রায় ও রণবীর দাশগুপ্ত। অনিল বন্ধু দাসকে তিন বছর সশ্রম কারাদন্ড ও নন্দলাল সিংহকে দু'বছর সশ্রম কারাদন্ড দেওয়া হয়। বাকি ষোলো জন আসামী মুক্তি পান। অথচ বেঙ্গল অর্ডিন্যান্স অনুসারে তাদের সকলকে আবার গ্রেপ্তার করা হয় এবং বিশেষভাবে ভাড়া করা একখানা জাহাজে অন্যান্য দণ্ডিত চোদ্দজন আসামীর সঙ্গে তুলে এক অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়।


২৯ জুলাই ১৯৩২ সাল।


তরুণ বিপ্লবী শৈলেশ রায় কুমিল্লার জাদরেল পুলিশকর্তা এলিসনকে প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে হত্যা করেন।


২৭ অক্টোবর ১৯৩২ সাল।


চব্বিশে সেপ্টেম্বর রাত্রে চট্টগ্রামের কাছে পাহাড়তলীতে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে ইনষ্টিটিউটে বিপ্লবী হামলার জন্য চট্টগ্রামের সমস্ত হিন্দু আদিবাসীর উপর আশি হাজার টাকা জরিমানা ধার্য করা হয়।


১৭ ফেব্রুয়ারী ১৯৩৩ সাল।


চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের নায়ক সূর্য সেন, জনৈক বিশ্বাসঘাতক নেত্র সেন-এর ষড়যন্ত্রে পটিয়া থেকে পাঁচ মাইল দূরে গেরালা নামক গ্রামে ধরা পড়েন। তখন তার মাথার দাম ছিল দশ হাঁজার টাকা। অবশ্য নেত্র সেনের পক্ষে পুরস্কারের টাকাটা পাওয়া সম্ভব হয় নি। কারণ কিরণ সেন নামক এক তরুণের এক ভোজালির কোপে তার মুন্ডু ধড় থেকে আলাদা হয়ে ভাতের থালায় গড়াগড়ি খায়।


২৯ মে ১৯৩৩ সাল।


গহিরা গ্রামে ফৌজী বাহিনীর সঙ্গে সংঘাতে দুই বিপ্লবীর মৃত্যু হয় এবং বিপ্লবী তারবেশ্বর দস্তিদার ও কল্পনা দত্ত বন্দী হন।


১৪ আগস্ট ১৯৩৩ সালে।


সূর্য সেন ও চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। পরদিন আনন্দবাজার পত্রিকার খবর ছিলঃ “অদ্য দ্বিপ্রহর ১২ ঘটিকার সময় স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল হইতে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের মামলার রায় প্রদত্ত হয়। ট্রাইব্যুনাল সূর্য সেনকে ১২১ ধারা অনুসারে দোষী সাব্যস্ত করিয়া প্রাণদন্ডে দণ্ডিত করেন"।


এই রায় মেনে নিতে পারেনি বিপ্লবীরা। গোপনে আলোচনা শুরু হয়। সূর্য সেনের ফাঁসির দিন ঠিক হয়েছে পরের বছর অর্থাৎ ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি। বিপ্লবীরা ঠিক করলেন ১২ জানুয়ারি মাস্টারদার ফাঁসির আগেই এই রায়ের প্রতিশোধ নিতে হবে। মাস্টারদা যেন ফাঁসির আগেই জানতে পারেন প্রতিশোধের খবর। কিন্তু কিভাবে-কোথায় বদলা নেবেন সেই নিয়ে কোন স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারলেন না বিপ্লবীরা।


তবে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি বিপ্লবীদের। বছরের শুরুতেই খবর এলো যে জানুয়ারি মাসের ৭ তারিখ, পল্টন ময়দানে ১০ ইউরোপিয়ানদের ক্রিকেট খেলা হবে। বিপ্লবীরা সিদ্ধান্ত নিলেন যে পল্টন ময়দানেই ৭ তারিখ প্রতিশোধ নেবে তাঁরা। এই অভিযানের জন্য চার জনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়, নিত্যরঞ্জন সেন , হিমাংশু চক্রবর্তী , কৃষ্ণ চৌধুরী এবং হরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী


৭ জানুয়ারি ১৯৩৪ সাল।


নিত্যরঞ্জন সেন, হিমাংশু চক্রবর্তী, কৃষ্ণ চৌধুরী এবং হরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী সাধারণ দর্শকের মতন ময়দানে পৌঁছে যান। কৃষ্ণ এবং হরেন্দ্র মাঠের উত্তর দিক থেকে অফিসারদের গ্যালারির দিকে এগোতে থাকেন। অন্যদিকে নিত্যরঞ্জন এবং হিমাংশু দক্ষিণ দিক থেকে এগোতে থাকে। সঙ্গে তাঁদের হাত-বোমা এবং রিভলবার। গ্যালারির কাছাকাছি আসার পরে কৃষ্ণ ইশারা করেন, তৎক্ষণাৎ চারজন একসঙ্গে আক্রমণ করেন। বোমা-গুলির শব্দ এবং বন্দেমাতরম ধ্বনিতে কেঁপে উঠে পল্টন ময়দান।


শহীদ হরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, Martyr Harendranath Chakraborty, Midnapore Central Jail, মেদিনীপুর কেন্দ্রীয় কারাগার
পল্টন ময়দান, ঢাকা।


প্রকাশ্য দিবালোকে এই ধরণের আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিলনা ইংরেজরা। আক্রমণে নিহত হন পুলিশ সুপার মিঃ পিটার ক্লিয়ারি এবং আহত হন অনেক অফিসার। রক্ষীদের গুলিতে ঘটনাস্থলেই শহীদ হন নিত্যরঞ্জন সেন এবং হিমাংশু চক্রবর্তী। আহত অবস্থায় কৃষ্ণ চৌধুরী ও হরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে গ্রেপ্তার করা হয়।


কৃষ্ণ চৌধুরী ও হরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে আনা হয় মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলে। কিন্তু এই খবর বাইরে প্রকাশ করা হয়নি। বিচারে তাঁদের ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। পল্টন ময়দানের ঘটনার ৫ মাস পরে ১৯৩৪ সালের ৫ জুন মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলে কৃষ্ণ চৌধুরী ও হরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ফাঁসি হয়।


হরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর পরিবার সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য আমার কাছে ছিল না। একসময় আমার সঙ্গে যোগাযোগ হয় "বীরকন্যা প্রীতিলতা ট্রাস্ট"-এর সম্পাদক শ্রী পঙ্কজ চক্রবর্তী মহাশয়ের সঙ্গে। চট্টগ্রামের পটিয়ার ধলঘাট থেকে পঙ্কজবাবু আসেন শহীদভূমি মেদিনীপুর দেখতে। আমার অনুরোধে তিনি বাংলাদেশ ফিরে গিয়ে হরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর পরিবার সম্পর্কে তথ্য পাঠান।


শহীদ হরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, Martyr Harendranath Chakraborty, Midnapore Central Jail, মেদিনীপুর কেন্দ্রীয় কারাগার
শহীদ ক্ষুদিরামের জন্মভিটায় "বীরকন্যা প্রীতিলতা ট্রাস্ট"-এর সম্পাদক শ্রী পঙ্কজ চক্রবর্তী।


১৯১৬ সালে জন্ম চট্টগ্রামের বাগদণ্ডীতে জন্মগ্রহণ করেন হরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। তাঁর পিতার নাম কালিকুমার চক্রবর্তী। চট্টগ্রাম বিপ্লবীদলের সদস্যরূপে বিভিন্ন দায়িত্বপূর্ণ কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁর প্রপিতামহ ছিলেন কানুরাম ব্রহ্মচারী এবং পিতামহের নাম ছিল লোকনাথ ন্যায়রত্ন। কালিকুমার চক্রবর্তীর চার পুত্রের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ পুত্র হলেন হরেন্দ্রনাথ। প্রথম দুই পুত্র যোগেন্দ্র এবং সত্যেন্দ্র শিশুবয়সেই মারা যায়। তৃতীয় পুত্র জ্ঞানেন্দ্রমোহনের বংশধরেরা বর্তমানে বাগদণ্ডীতে রয়েছেন। তাঁদের একটি বংশতালিকা তৈরী করে ছবি আকারে এই প্রবন্ধের সঙ্গে দিলাম।


শহীদ হরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, Martyr Harendranath Chakraborty, Midnapore Central Jail, মেদিনীপুর কেন্দ্রীয় কারাগার
বংশতালিকা।


মেদিনীপুরে, বহু বিখ্যাত মানুষের মূর্তি রয়েছে এবং বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক নতুন মূর্তি প্রতিষ্ঠা করাও হচ্ছে। সারা দেশ জুড়ে সেইসব বিখ্যাত মানুষের মূর্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বহু মানুষ এবং সংস্থা রয়েছে। কিন্তু যারা মেদিনীপুরের মাটিতে বলিদান দিয়েছেন বা তাঁদের কাজের মাধ্যমে বিশ্বের দরবারে মেদিনীপুরের নাম উজ্জ্বল করেছেন, তাঁদের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য কেউ নেই ? তাহলে নতুন প্রজন্ম কি শিখবে ? কোথা থেকে পাবে দেশের জন্য কিছু করার অনুপ্রেরণা ? নতুন প্রজন্মের কাছে আঞ্চলিক ইতিহাস তুলে ধরতে না পারলে আমরা উন্নতি নয় অবনতির দিকে এগোবো। মেদিনীপুরবাসীর কাছে অনুরোধ শহীদ হরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী এবং শহীদ কৃষ্ণকুমার চৌধুরীর মূর্তি মেদিনীপুর শহরে প্রতিষ্ঠা করা হোক।




M E D I N I K A T H A J O U R N A L

Edited by Arindam Bhowmik

Published on 07.01.2025
Updated on 05.06.2025



তথ্যসূত্র এবং টিকা -

১. সবার অলক্ষে, ভুপেন্দ্রকিশোর রক্ষিত-রায়, ১৩৬৩ বঙ্গাব্দ, বেঙ্গল পাবলিশার্স প্রাইভের লিমিটেড, ৯৩ পৃষ্টা।

২. সূর্য আবার উঠবে, সুনীলচন্দ্র দেববর্মা, ১৩৯৪ বঙ্গাব্দ, প্রকাশক: শ্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়, ১২৯ পৃষ্ঠা।

৩. ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম, শ্রী স্বপন মুখোপাধ্যায়, পুনশ্চ, ১৯৬০, ১৭৬ পৃষ্টা।

৪. পুলিশ সুপার মিঃ পিটার ক্লিয়ারির নাম কিছু বইতে মিঃ ক্রলিয়ারী হিসেবে উল্লেখ রয়েছে।

৫. বিপ্লবী ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীর লেখা "জেলে ত্রিশ বছর, পাক-ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম" বইতে উল্লেখ করা হয়েছে যে কৃষ্ণ চৌধুরীর ফাঁসি বহরমপুর জেলে হয়েছে। কিন্তু এই তথ্য ঠিক নয়।

৬. নিত্যরঞ্জন সেন নামটি কিছু বইতে নিত্যগোপাল দেব, নিত্যগোপাল ভট্টাচার্য উল্লেখ রয়েছে।

৭. হিমাংশু চক্রবর্তী নামটি কিছু বইতে হিমাংশু ভট্টাচার্য, হিমাংশুবিমল চক্রবর্তী উল্লেখ রয়েছে।

৮. কৃষ্ণকুমার চৌধুরী নামটি কিছু বইতে কৃষ্ণ চৌধুরী, কৃষ্ণগোপাল চৌধুরী উল্লেখ রয়েছে।

৯. হরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী নামটি কিছু বইতে হরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য উল্লেখ রয়েছে।

১০. ৭ জানুয়ারির ঘটনায় যে পল্টন ময়দানের কথা বিভিন্ন বইতে উল্লেখ করা হয়েছে সেই ময়দান সম্ভবত চট্টগ্রামে নয় কারণ চট্টগ্রামে ঐ নামে কোন ময়দান ছিলনা বা এখনো নেই। পল্টন ময়দান রয়েছে ঢাকায়। সম্ভবত চট্টগ্রামের অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি এড়িয়ে ঢাকার পল্টন ময়দানেই ক্রিকেট খেলার আয়োজন হয়েছিল।


নিচে কমেন্ট বক্সে আপনার মূল্যবান মতামত জানান।