গৌরাঙ্গপুর, Gourangapur, কাশীজোড়া, পাঁশকুড়া, পুরুষোত্তমপুর, Panskura, Purba Medinipur

আমার গ্রাম গৌরাঙ্গপুর


My village Gourangapur


দেবাশিস মাইতি।



Home » Medinikatha Journal » Debashis Maity » আমার গ্রাম গৌরাঙ্গপুর



ছোট্ট একটা গ্রাম আমাদের এই গৌরাঙ্গপুর। এই নামে গ্রাম আর‌ও আছে। অনেক কাল আগে আমাদের এই গ্রামটি কাশীজোড়া পরগণার অধীনে ছিল। কাঁসাই নদী আর তার শাখা প্রবাহ গৌরীকে একত্রে একসময় লোকে জোড়াকাঁসাই নামে ডাকত। সেই জোড়াকাঁসাই নাম থেকেই কাশীজোড়া পরগণা নামটির উৎপত্তি। কাশীজোড়া পরগণা আসলে ছিল মুঘল আমলের একটি প্রশাসনিক বিভাগ। এখনকার দিনে যেমন জেলা ঠিক তেমনি সে যুগে পরগণা ছিল আধুনিক জেলার মত‌ই একটি প্রশাসনিক একক। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য মেদিনীপুর জেলার ১১৫টি পরগণার মধ্যে কাশীজোড়া পরগণা ছিল বৃহত্তম পরগণা। এই পরগণার ই একটি ঐতিহ্যবাহী গ্রাম তথা জনপদ হল গৌরাঙ্গপুর। গ্রামটি বর্তমানে পাঁশকুড়া ১নং ব্লকের পুরুষোত্তমপুর গ্রাম প‌ঞ্চায়েতের অন্তর্গত। গ্রামটির জে.এল. নং ৩৪৬ আয়তন ৭২.৩১ হেক্টর।


গৌরাঙ্গপুর, Gourangapur, কাশীজোড়া, পাঁশকুড়া, পুরুষোত্তমপুর, Panskura, Purba Medinipur
স্বদেশী যুগের কংগ্রেস ঘর

এই জনপদটির র নাম গৌরাঙ্গপুর কীভাবে হল, কীভাবে একটা ছোট্ট জনবসতি থেকে ধীরে ধীরে আজকের গ্রামে রূপান্তরিত হল তার স্পষ্ট জানা যায় না। তবে বিশিষ্ট আঞ্চলিক ইতিহাস লেখক সুধাংশু শেখর ভট্টাচার্য জনশ্রুতির ওপর ভিত্তি করে বলতে চেয়েছেন ১৫১০ সাল নাগাদ শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু নীলাচলে গমনকালে এই অঞ্চলটিকে পদধূলায় ধূলিত করেছিলেন এবং পার্শ্ববর্তী একটি দিঘীতে অবগাহন করে দেহের ক্লান্তি দূর করেছিলেন। সে কারণেই নাকি গ্রামটির নাম হয় গৌরাঙ্গপুর আর দিঘীটি পরিচিতি পায় চৈতন্যদিঘী নামে।


গৌরাঙ্গপুর, Gourangapur, কাশীজোড়া, পাঁশকুড়া, পুরুষোত্তমপুর, Panskura, Purba Medinipur
শতাব্দী প্রাচীন বুয়া হরির থান

গৌরাঙ্গপুর গ্রামটির পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলি হল আটবেড়িয়া, চন্ডীপুর, ফকিরগঞ্জ, রাধাকৃষ্ণপুর, সীতারামপুর প্রভৃতি। গ্রামের দক্ষিণ পাশে স্থানীয় জোড়াপুকুর বাসস্টপেজ হল গৌরাঙ্গপুর এবং এই গ্রামগুলির তৎসহ দূরবর্তী অঞ্চলগুলির সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম।



গ্রামে হিন্দু -মুসলিমের‌ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান থাকলেও মাহিষ্যরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। এছাড়াও আছে বেশকিছু উৎকল ব্রাহ্মণের বসবাস। গ্রামে আছে ব্রাহ্মণ সমাজের হরিমন্দির এবং মাহিষ্য সমাজের শীতলামন্দির। শীতলা দেবীই এই গ্রামটির গ্রাম্যদেবী।গ্রামটির প্রায় প্রত্যেকটি পরিবার বিষ্ণুভক্ত। প্রায় প্রত্যেকটি পরিবারে আছে হরিমন্দির। এছাড়াও আছে ৩০০ বছরের পুরোনো লক্ষীজনার্দ্দনজীউ মন্দির আছে রাধাগোবিন্দ জীউ এর মন্দির। আছে গোবিন্দের ঘাট। গ্রামের শীতলা মন্দিরকে কেন্দ্র করে ফি বছর দেশের পূজা পালিত হয়। পরিবারগুলি পদবী অনুযায়ী বিভিন্ন পাড়ায় বিভক্ত। যেমন মাইতি, কর, দুয়ারী, ধাড়া, শাসমল, দোলাই, দাস, মন্ডল, ঘোড়াই প্রভৃতি। কর এবং মাইতি বংশ হল এই গ্রামের সবচেয়ে প্রাচীন দুটি বংশ।


গৌরাঙ্গপুর, Gourangapur, কাশীজোড়া, পাঁশকুড়া, পুরুষোত্তমপুর, Panskura, Purba Medinipur
গৌরাঙ্গপুর মসজিদ

গ্রামের বেশীরভাগ পরিবার কৃষিজীবী। ধান চাষ ই প্রধান। একসময় গ্রামে দুঃস্থ মহিলাদের রুজি রোজগারের জন্য ছিল সরকারি গম ভাঙা চাকি কেন্দ্র। কর এবং মাইতি বংশ হল এই গ্রামের সবচেয়ে প্রাচীন দুটি বংশ।



গ্রামটির ক্লাব সংস্কৃতি এখানকার কৃষ্টি জগতকে বাঁচিয়ে রেখেছে এবং অধিবাসীদের বিনোদনের খোরাক জোগাচ্ছে। দুটি ক্লাব এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি হল গৌরাঙ্গপুর অ্যাথেলেটিক ক্লাব(কলতলা) এবং আর একটি হল গৌরাঙ্গপুর আমরা সবাই যা চৈতন্যদিঘী'র পাড়ে অবস্থিত। দুটো ক্লাব‌ই প্রতি বছর শ্যামা পূজা এবং সরস্বতী পূজার আয়োজন করে এবং সেইসঙ্গে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। এছাড়াও স্থানীয় নবজাগরণ সংঘের পরিচালনায় প্রতি বছর শ্মশান কালী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। গ্রামে একসময় বাণীসংঘ নামে একটি পাঠাগার এবং প্রবাহ নামে একটি সাহিত্যগোষ্ঠী ছিল।


গৌরাঙ্গপুর, Gourangapur, কাশীজোড়া, পাঁশকুড়া, পুরুষোত্তমপুর, Panskura, Purba Medinipur
গৌরাঙ্গপুর স্বাস্থ্যকেন্দ্র

গ্রামে এক সময় টোল ভিত্তিক পড়াশোনার বন্দোবস্ত ছিল। পরবর্তীতে ১৯০৮ সালে ঈশ্বরচন্দ্র মাইতি একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন যা ঈশ্বরচন্দ্র নিম্নবুনিয়াদী বিদ্যালয় নামে পরিচিত। এই বিদ্যালয়ের‌ই সংলগ্ন স্থানে ২০১৪ সালে একটি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপিত হয়।



স্বদেশী যুগের কংগ্রেস ঘরটি স্বাধীনতার পরবর্তী কালে বহুবছর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হত। ২০১৩ সালের কাঁসাই নদীর বন্যায় ঘরটি বিধ্বস্ত হয় এবং লুপ্ত হয়ে যায়। কয়েক বছর আগে মুসলিম বসতির দিকে একটি নতুন স্বাস্থ্যকেন্দ্র নির্মিত হয়েছে ।


গৌরাঙ্গপুর, Gourangapur, কাশীজোড়া, পাঁশকুড়া, পুরুষোত্তমপুর, Panskura, Purba Medinipur
ব্রাহ্মণ সমাজের হরিমন্দির

গ্রামের বর্তমান গুণীজন ব্যক্তিদের মধ্যে মণিলাল মাইতি উল্লেখযোগ্য। তাঁর উদ্যোগে ১৯৭১ সালে সুশীল ধাড়ার সুপারিশে গৌরাঙ্গপুর গ্রুপ ইলেকট্রিক সাপ্লায়ের অফিসটি চালু হয় এছাড়াও ১৯৭৩ সালে কৃষিকার্যের সুবিধার্থে গভীর নলকূপ স্থাপিত হয়।


গৌরাঙ্গপুর, Gourangapur, কাশীজোড়া, পাঁশকুড়া, পুরুষোত্তমপুর, Panskura, Purba Medinipur
মাহিষ্য সমাজের শীতলা মন্দির

ব্রিটিশ আমলে স্বাধীনতা আন্দোলনের জোয়ার এই গ্রামটিকেও ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। অনুকূল কর, অতুল কর, অমর কর, অনুকূল পন্ডা, অচ্যুতানুজ পন্ডা, গুণধর গাঁতাইত প্রমুখরা সে যুগে স্বদেশী স্বেচ্ছ্বাসেবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। স্থানীয় কংগ্রেসঘরে তারা সমবেত হতেন।এ অঞ্চলের প্রখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন ইন্দুমতী ভট্টাচার্য ।স্বাধীনতার পরবর্তী সময় থেকে ভারতীয় গণপ্রজাতন্ত্রের পঞ্চায়েত রাজ অনুসারে গ্রামটি পুরুষোত্তমপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের স্বায়ত্তশাসনের আওতাধীন।




M E D I N I K A T H A J O U R N A L

Edited by Arindam Bhowmik

(Published on 28.04.2024)


তথ্যসূত্র:

১. পরগণা কাশীজোড়া - ভট্টাচার্য, সুধাংশু শেখর
২. পাঁশকুড়ার জনপদ - ভট্টাচার্য, সুধাংশু শেখর


নিচে কমেন্ট বক্সে আপনার মূল্যবান মতামত জানান।