"রহৈন" কৃষি উৎসবের সূচনা
Rahain - Inauguration of the agricultural festival
ধ্রুব মাহাত।
Home » Medinikatha Journal » Dhruba Mahata » "Rahain" Inauguration of the agricultural festival
'রহৈন' ১২ মাসে ১৩ পার্বণের অন্যতম একটি কৃষি উৎসব রূপে পরিগণিত কুড়মি জনজাতির মানুষের কাছে। প্রতিবছর ১৩ জ্যৈষ্ঠ শুরু হয় ঐতিহ্যবাহী কৃষি পদ্ধতির এক প্রাচীন প্রথা 'রহৈন'। চলে সাত দিন ব্যাপী। পশ্চিমবঙ্গের ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া জেলা সহ সমগ্র ছোটনাগপুর মালভূমির বিস্তীর্ণ এলাকায় 'রহৈন' পালিত হয়ে আসছে সুপ্রাচীনকাল থেকেই। এতদঞ্চলে বসবাসকারী কৃষিজীবী আদিবাসী কুড়মি সম্প্রদায় মানুষেরা তা পালন করে থাকে ধুম - ধামের সাথে। এখানকার মানুষেরা কৃষিকাজ শুরু করার আগে গ্রাম্য দেব-দেবী ও ভূমি বা ক্ষেত্রস্থল বরণ করে থাকে।
"রহৈন" কৃষি উৎসবে সূচনা | Rahain - Inauguration of the agricultural festival
"রহৈন" কৃষি উৎসবে সূচনা | Rahain - Inauguration of the agricultural festival
ঐদিন বাড়ীর পুরুষদের সাথে মহিলারাও তাল মিলিয়ে চাষের শুভ কাজে যোগ দেন। মহিলারা ঐ দিন সূর্যোদয়ের আগে থেকেই কাজে লেগে পড়েন, প্রথমে তারা বাড়ীর বাইরের দেওয়ালের চারিদিকে গোবরের দাগ কেটে দেয়, যাতে বাড়িতে বিষাক্ত পোকামাকড় বা সাপ ঢুকতে না পারে। তারপর তারা শুদ্ধতার জন্য ঘরের প্রতিটি কক্ষে ও উঠোনে গোবর জল দিয়ে নাতা দেয়। আবার মঙ্গল কামনার জন্য বাড়ীতে প্রতিটি দরজার সামনে, উঠোনে, তুলসী থান বা ঠাকুর পিঁড়হায় আলপনা দেয়, তারপর স্নান সেরে তুলসী মঞ্চে মা মনসা ও মা শীতলার উদ্দেশ্যে প্রসাদ নিবেদন করে।
"রহৈন" কৃষি উৎসবে সূচনা | Rahain - Inauguration of the agricultural festival
সন্ধ্যার সময় প্রত্যেকটি বাড়ীর একজন করে মহিলা নতুন অথবা পরিষ্কার কাপড় পরে দল বেঁধে জমি থেকে ছোট ছোট মাটির টুকরো ঠেকায় (ঝুড়ি) ভরে মাথায় করে নিয়ে আসে নিজেদের বাড়ীতে, কোথাও কোথাও আবার নাচ-গান করতে করতে মাটি আনতে যায়, এবং নিয়ে আসা মাটির ঝুড়িটি ঠাকুর পিঁড়হায় রেখে সন্ধ্যা প্রদীপ দেওয়া হয়। অসৌচ অবস্থায় সকলে এই রীতি পালন থেকে বিরত থাকে। তারপর নিয়ে আসা মাটির ঢেলা বা টুকরো গুলোকে ছোট ছোট টুকরো করে তুলসী মঞ্চ বা ঠাকুর পিঁড়হা ও বাড়ির প্রতিটা কোণে গুঁজে রেখে দেয়, যাতে কোন রূপ অশুভ শক্তির প্রভাব বাড়িতে না পড়ে। পরবর্তী সময়ে যদি বাড়ীতে বারি উঠে বা মনসামঙ্গল গানের অনুষ্ঠান হয় তখন ঐ মাটি জলে গুলে তিলক দেওয়া হয়। পুরুলিয়ার কোথাও কোথাও গরমের সময় গায়ে ঘামাচি হলে রহৈন মাটি মেখে স্নান করে ঘামাচি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য। আবার ঐ দিন রহৈন ফল (বুনো ফল) খায় অনেকে, তাদের মতে যদি সাপে কামড়ায় তাহলে ফলের গুনে বিষ লাগে না এইসব বিশ্বাসও বর্তমান।
আমন ধানের চাষের প্রক্রিয়া শুরু হয় জৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি থেকে। গ্রামের মানুষের বিশ্বাস যে পয়লা রহৈন থেকে শেষ রহৈন এর মধ্যে জমিতে তলার জন্য বীজ ধান ছড়ালে রোদে - জলে ঐ চারা বলিষ্ঠ ও নীরোগ হয় সাথে ফলনও ভালো হয়, আদিকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত গ্রামের চাষিবাসী মানুষের এটাই রীতি ও প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে যা তারা এখনো পর্যন্ত বংশানুক্রমে মেনে আসছে।। আগেকার দিনে বৃষ্টির জলের উপর চাষবাস নির্ভর করতো এবং তা ছিল এক ফসলি, তাই ফলন যাতে ভালো হয় সেই জন্য তারা চারা ফেলা থেকে শুরু করে কিছু নিয়ম-নীতি মেনে চলতো।
"রহৈন" কৃষি উৎসবে সূচনা | Rahain - Inauguration of the agricultural festival
রহৈন চলাকালীন বাড়ীর কোন একজন পুরুষ যিনি লাঙ্গল করতে সক্ষম, সকালে স্নান করে খালি পেটে বাড়ি থেকে হাল(লাঙ্গল)- জোঁয়াল ও গুঁড়ি, সিঁন্দুরের তিলক দেওয়া একটি ছাকনা (ছোট ঝুড়ি) ও ধান নিয়ে জমিতে গিয়ে জমির কিছুটা অংশে লাঙল দিয়ে কর্ষণ করে ছাকনায় ধান ভরে ভুমি লক্ষ্মীকে স্মরণ করে জমিতে বীজ ধান ছড়িয়ে দেওয়া হয় একে "বীজ পুন্যা" বলে। বিশ্বাস আছে যে ঐ দিনগুলিতে চারার জন্য বীজ ধান ফেললে গাছ হিষ্ট - পুষ্ট হয় এবং রোগ ও পোকামাকড়ের উপদ্রব থেকে অনেকটা রক্ষা পায়। আষাঢ় মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত বর্ষা নেমে আসে ফলে চারা গুলি রোয়ার উপযুক্ত হয়ে ওঠে। এই চিত্র প্রায় সব গ্রামেতেই লক্ষ্য করা যায়।
রহৈন ফল।
এইভাবে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ-পশ্চিমে বিভিন্ন জেলা সহ ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলে রহৈনের মধ্য দিয়ে উৎসবের আকারে আমন ধানের চাষ শুরু হয়ে আসছে পূর্বপুরুষের আমল থেকে। বর্তমান যুগকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগ বলা হয় এবং ব্যবহারিক জীবনে এর প্রয়োগ প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই ব্যাপক হারে দেখা যাচ্ছে এবং কৃষি ক্ষেত্রও এর প্রভাব মুক্ত নয়। এখন প্রত্যন্ত গ্রামেও দেখা যাচ্ছে যে আগের মতো গরু ও কাড়ায় টানা লাঙ্গল সে রকম ভাবে ব্যবহার হচ্ছে না প্রয়োজনে ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার, হার্ভেস্টারের ব্যবহার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে এই প্রথা আর কতদিন ধরে রাখা যাবে সেটাই ভাবনার বিষয়।
midnapore.in
(Published on 04.06.2023)