শিলদা, রানি, কিশোরমণি, রাজা, Bengal, Shilda, Rani, Kishoremani, Medinipur, Midnapore

শিলদার রানি কিশোরমণি

‘রাজা’ নামে উল্লেখ করা হোত এই রানিকে



চিন্ময় দাশ।



Home » Medinikatha Journal » Chinmoy Das » Rani Kishoremani of Shilda


গোড়ার কথা :


রাজকীর্তির বিচারে, মেদিনীপুর জেলার তিনজন রানির কথা প্রথমেই আসে। প্রথমজন হলেন মহিষাদলের রানি জানকী দেবী। দ্বিতীয় হলেন জলামুঠা পরগণার রানি সুগন্ধা দেবী। এবং তারপরেই যাঁর নাম করতে হয়, তিনি হলেন শিলদা পরগনার রানি কিশোরমণি দেবী। দীর্ঘ ৪২ বছর রাজত্ব করেছেন তিনি।


শিলদা, রানি, কিশোরমণি, রাজা, Bengal, Shilda, Rani, Kishoremani, Medinipur, Midnapore
শিলদার রানি কিশোরমণি

কিশোরমণি ছিলেন তাঁর বংশের শেষ শাসক। তাঁর প্রয়াণের পর, রাজবংশটি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। সেকারণে, রানির কথা আলোচনার পূর্বে, এই রাজবংশটির কিছু কথা জেনে নেওয়া যায়।


শিলদা রাজবংশের তেমন কোন প্রাচীন ইতিহাস নাই। এমনকি, অষ্টাদশ শতকের একেবারে শেষ ভাগে পৌঁছবার আগে পর্যন্ত, শিলদা রাজবংশের সম্পর্কে তেমন কোনও ইতিহাস কারোরই জানা ছিল না। এই রাজবংশ সম্পর্কে প্রথম বিবরণ পাওয়া যায় ইং ১৭৮৭ সালে।


ইংরেজ শক্তি ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর, রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থাপনা হিসাবে প্রথমে পাঁচ-সালা বন্দোবস্ত প্রচলন করে। পরে দশ-সালা বন্দোবস্ত। দশ-সালার সময়ে, সেই সময়কালের সমস্ত জমিদারকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে, নিজেদের পূর্ব বিবরণ সহ একটি প্রতিবেদন পেশ করতে হতো। বন্দোবস্তের ফয়সালা হত সেই বিবরণের ভিত্তিতেই।


শিলদা, রানি, কিশোরমণি, রাজা, Bengal, Shilda, Rani, Kishoremani, Medinipur, Midnapore
শিলদার রানি কিশোরমণি

সেই সময়ে শিলদায় জমিদার ছিলেন মানগোবিন্দ মল্ল। কোম্পানিকে দাখিল করা তাঁর বিবরণ থেকেই, এই রাজবংশের পূর্বের ইতিহাস অবগত হওয়া যায়।


মানগোবিন্দ জানিয়েছিলেন, তাঁর পূর্বপুরুষ ছিলেন জনৈক মেদিনী মল্ল। মেদিনী মল্ল যে সময় এই এলাকায় আসেন, তখন ঝাটিবনি (ওরফে শিলদা) পরগনায় রাজত্ব করতেন বিজয় সিংহ নামে খয়রা জাতিভুক্ত একজন রাজা। মেদিনী মল্ল বিজয় সিংহকে পরাজিত করে, তাঁর রাজ্যটি অধিকার করেছিলেন। তিনিই ছিলেন শিলদার রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা।


মেদিনী মল্ল রাজত্ব করেছেন দীর্ঘ ৪১ বছর। মেদিনীর পর তাঁর পুত্র মঙ্গলরাজ মল্ল রাজা হয়েছিলেন। তিনি রাজত্ব করেছিলেন আরও দীর্ঘকাল, টানা ৫৭ বছর। মঙ্গলরাজের পুত্র গৌরহরি। ৬৭ বছর ছিল তাঁর রাজত্বকাল।



এই গৌরহরির তিনজন পুত্র। তাঁদেরই অন্যতম ছিলেন মানগোবিন্দ মল্ল। গৌরহরির মৃত্যুর পর, তিনিই রাজা হয়েছিলেন। নিজের শাসনকালে, কোম্পানি সরকারের দপ্তর থেকে ‘রায়’ উপাধি লাভ করেছিলেন তিনি। ১৮০৬ সালে মানগোবিন্দের মৃত্যু হয়।


এদিকে ঘটনা হোল, গুনে গুনে সাতজন রানি ছিল মানগোবিন্দের। কিন্তু পুত্রসন্তান ছিল না রাজার। সেকারণে, মানগোবিন্দের মৃত্যুর পর, তাঁর অন্যতম রানি কিশোরমণি দেবী রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন।


রানির মৃত্যুর পর শিলদা রাজ্যের বিপর্যয় :


কিশোরমণি দেবী রাজত্ব করেছিলেন টানা ৪১ বছর। মেদিনীপুর জেলায় কোনও রানির এই ইতিহাস নাই। মানগোবিন্দ মারা গিয়েছিলেন ১৮০৬ সালে। ৪২ বছর রাজত্ব করবার পর, ১৮৪৮ সালে কিশোরমণি প্রয়াত হন।


শিলদা, রানি, কিশোরমণি, রাজা, Bengal, Shilda, Rani, Kishoremani, Medinipur, Midnapore
শিলদার রানি কিশোরমণি

রাজা মানগোবিন্দের পুত্র সন্তান ছিল না। সেকারণে, কিশোরমণি দেবী তাঁর জীবদ্দশায়, নিজের দেওয়ানের পুত্র জনৈক শ্রীনাথ চন্দ্র পাত্রকে ‘দত্তকপুত্র’ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। রানি প্রয়াত হলে, শ্রীনাথ চন্দ্র জমিদার হয়েছিলেন।


সেই সময় মানগোবিন্দের জ্ঞাতি জনৈক জগন্নাথ মল্ল জমিদারি দাবী করে, শ্রীনাথের বিরুদ্ধে আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন। সেই মামলায় জগন্নাথ মল্লই জয় লাভ করেছিলেন এবং শিলদা রাজ্য তাঁর অধিকারে গিয়েছিল।


তবে, রাজ্যসুখ বেশি কাল ভোগ করতে পারেননি তিনিও। আইন আদালত করে জমিদারি অধিকার করলেও, তাঁর সেই অধিকার টিকেছিল মাত্র ৯ বছর।


শিলদা, রানি, কিশোরমণি, রাজা, Bengal, Shilda, Rani, Kishoremani, Medinipur, Midnapore
শিলদার রানি কিশোরমণি

আমরা বলেছি, সাতজন রানি ছিলেন মানগোবিন্দের। তাঁদেরই একজনের কন্যার বিবাহ হয়েছিল বাঁকুড়া জেলার ফুলকুসমা পরগ্ণার জমিদারবড়িতে। রাজধানি ছিল রসপালগড়। জনৈক মুকুন্দ নারায়ণ দেও ছিলেন সেই কন্যার পুত্র। তিনি মানগোবিন্দের দৌহিত্র হিসাবে, শিলদা পরগনার জমিদারির উত্তরাধিকার নিয়ে, জগন্নাথের বিরুদ্ধে আদালতে আবেদন দাখিল করেন। সেই মোকদ্দমার রায় মুকুন্দ নারায়ণের পক্ষে গিয়েছিল। তাতে তিনিই জমিদারির আইনসঙ্গত অধিকারী সাব্যস্ত হন এবং ১৮৫৭ সালে জগন্নাথকে রাজ্যচ্যুত করে, শিলদা জমিদারি অধিকার করেছিলেন।


কিন্তু এই নতুন জমিদার বংশও বেশিদিন শিলদার অধিকার রক্ষা করতে পারেননি। তার প্রথম কারণ, জমিদাররা অবস্থান করতেন ফুলকুসমার রসপালগড়ে। যা শিলদা থেকে অনেকখানি দূরত্বে অবস্থিত। মুকুন্দ নারায়ণ শিলদায় আসেননি। রসপালগড় থেকেই জমিদারি পরিচালনা করতেন। ফলে, কর্মচারী নির্ভর হওয়ার অনিবার্য ফলশ্রুতি দাঁড়িয়েছিল অদক্ষ পরিচালনা। এবং সমগ্র শিলদা জমিদারি বিপুল দেনার দায়ে, নিলামে উঠে যায়।


সেসময় মেদিনীপুর শহরের জমিদার ভোলানাথ দত্ত, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিষ্ঠিত ‘মেদিনীপুর জমিদারি কোম্পানি’ ইত্যাদি বিভিন্ন জমিদার নিলাম থেকে শিলদা জমিদারির বিভিন্ন অংশ বন্দোবস্ত নিয়ে নেয়। রানি কিশোরমণীর মৃত্যুর সাথে সাথে মেদিনী মল্ল প্রতিষ্ঠিত রাজবংশটি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। নিলামের পর, শিলদা জমিদারিটিও ধ্বংস হয়ে যায়।


রানির কথা :


মেদিনীপুর জেলায় ৪ দশকেরও বেশি সময় জমিদারি পরিচালনা করেছেন, এমন অন্য কোনও রানির নাম জানা যায় না। একমাত্র কিশোরমণী দেবীই ছিলেন এই কৃতিত্বের অধিকারী।


শিলদা, রানি, কিশোরমণি, রাজা, Bengal, Shilda, Rani, Kishoremani, Medinipur, Midnapore
শিলদার রানি কিশোরমণি

এই মহীয়সী রমণী তাঁর জমিদারি শাসনকালে, সুশাসক হিসাবে বিশেষ খ্যাতির অধিকারী হয়েছিলেন। পানীয় জল এবং সেচের জলের প্রয়োজনে প্রজাদের জন্য কয়েকটি বিশালাকার দীঘি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি।


মানগোবিন্দের পত্নী হয়ে, কিশোরমণি যখন শিলদায় এসেছিলেন, এই রাজবংশে তখন শৈবধারায় দেব আরাধনার রীতি প্রচলিত ছিল। রানি কিশোরমণি সেই ধারা রক্ষা করেছিলেন। নিজের হাতে গুনে গুনে বারটি শিবালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। এই দ্বাদশ শিবালয়ের মধ্যে, চারটি ছিল রাজবাড়ির বাইরে, শিলদার কয়েকটি পাড়ায়। বাকি আটটি শিব মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নিজের মহালের বিভিন্ন মৌজায়। যাতে প্রজাবর্গও সহজে শিবপূজার আয়োজন করতে পারে। সুখের কথা, এই বারটি শিব মন্দিরই এখনো বিরাজিত আছে।



কোম্পানি সরকারের বড়লাট লর্ড কর্ণওয়ালিশ ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ প্রচলন করেছিলেন। সেই আইনের অঙ্গ হিসেবে, সরকারি দপ্তরে রাজস্ব জমা দেওয়ার বিধি অনুসারে, ‘সূর্যাস্ত আইন’ প্রচলিত হয়েছিল। বহু রাজা জমিদার সেই আইন লঙ্ঘন করে, শাস্তিপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। রানি কিশোরমনি দেবী কখনোই এই বিধির উল্লঙ্ঘন করেননি। অপরদিকে, রাজস্ব বা খাজনা আদায়ের জন্য, প্রজা নিপীড়নের কোন ইতিহাস নাই এই রানির। উপরন্তু রানি ছিলেন প্রজাবৎসল, দক্ষ প্রশাসক, ধর্মপরায়ণা একজন বিদূষী মহিলা।


সেসবের কারণেই, একজন রমণী হয়েও ‘রাজা’ আখ্যা পেয়েছিলেন তিনি। কিশোরমণির প্রতিষ্ঠিত কিশোরকিশোরী মন্দিরে সংস্কৃতে লেখা একটি প্রতিষ্ঠালিপি আছে। পূর্ববর্তী পুরাবিদ প্রণব রায় সেটির পাঠোদ্ধার করে, তাঁর গ্রন্থে বলেছেন—“ ‘রাজা’ কিশোরমণি এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা। “।


রানির হাতে যে ১২টি শিব মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার একটি মন্দির আছে, বিনপুর থানার রাজপাড়া গ্রামে। সেই মন্দিরে একটি প্রতিষ্ঠালিপিতে কিশোরমণি দেবীকে রাজা হিসাবে উল্লেখ করা আছে। (একটি ছবি দেওয়া হোল।)


শিলদা, রানি, কিশোরমণি, রাজা, Bengal, Shilda, Rani, Kishoremani, Medinipur, Midnapore
শিলদার রানি কিশোরমণি

কোন কালই কোনখানেই একজন রমণীকে রাজা হিসেবে উল্লেখ করা বা আখ্যায়িত করা হয়েছে, এমন উদাহরণ দেখাই যায় না। অন্তত আমরা এমন কোনও নিদর্শন আজ পর্যন্ত পাইনি।



বারোটি শিব মন্দির প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি, দুটি বিষ্ণু মন্দিরও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কিশোরমণি। শৈব পরিবারের বধু হয়েও, রানী স্বয়ং বৈষ্ণবধর্মে অবগাহন করেছিলেন। গৌড়ীয় বৈষ্ণবীয় রীতিতে দেবসেবার জন্য, রাজবাড়ির বাস্তুর চৌহদ্দির মধ্যেই দু-দুটি বিষ্ণু মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। একটি কিশোরকিশোরী মন্দির, এবং সেই মন্দিরের অদূরেই রাধাকৃষ্ণ নামের দ্বিতীয় মন্দির।


কিশোরকিশোরী মন্দিরটি ১৭৪২ শকাব্দ বা ইং ১৮২০ সালে নির্মিত হয়েছিল।


শিলদা, রানি, কিশোরমণি, রাজা, Bengal, Shilda, Rani, Kishoremani, Medinipur, Midnapore
শিলদার রানি কিশোরমণি

সপ্তদশ শতকের গোড়ার দিকে চৈতন্যদেব প্রবর্তিত গৌড়ীয় প্রেম ধর্মের প্রভাবে, এই জেলার বিপুল অংশের সাধারণ প্রজাবর্গের সাথে, রাজা-জমিদার-ভূস্বামীগণ গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। সেসময় এই জেলায় এমন কোনও রাজবাড়ি, জমিদারবাড়ি, এমনকি বড় মাপের ভূস্বামী পরিবার ছিল না, যাঁরা নতুন করে রাধাকৃষ্ণ বা বিষ্ণু মন্দির গড়ে তোলেননি।


কিশোরমণি এবং শ্রীনাথের শাসনকালে উপযুক্ত আড়ম্বরের সাথে দুটি মন্দিরে সেবাপূজা বহাল ছিল। কিন্তু জগন্নাথ এবং মুকুন্দ নারায়ণের সময়কাল থেকে মন্দিরে সংকটের সূচনা হয়েছিল। সমগ্র জমিদারি নিলাম এবং ভিন্ন ভিন্ন জমিদারের হাতে চলে যাওয়ার পর মন্দিরের পুজার্চনায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। কালে কালে জল- তুলসীর সেবাপূজা টুকুও বন্ধ হয়ে যায় মন্দিরে। ধীরে ধীরে সেবাইতদের মতো, পুরোহিত ঠাকুরও মন্দির থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। অবহেলায় অনাদরে পরিতক্ত মন্দিরটি একটু একটু করে বিনষ্ট হতে শুরু করেছিল।।


শিলদা, রানি, কিশোরমণি, রাজা, Bengal, Shilda, Rani, Kishoremani, Medinipur, Midnapore
শিলদার রানি কিশোরমণি

একদিন মহাড়ম্বরে ঢাকঢোল পিটিয়ে যাঁদের পূজা হতো, শত শত প্রজা হাজির থাকতেন যে পার্বণগুলিতে, গর্ভগৃহের অন্ধকারে পড়ে থাকত সেই বিগ্রহ গুলি।


এক যুগেরও কিছু বেশি কাল আগের কথা। ‘তরুণ সঙ্ঘ’ নামে শিলদার একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান সেই সময়ে এগিয়ে এসেছিলেন মন্দিরটির পরিত্রাতার মতো। নতুন করে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা এবং পুরোহিত নিয়োগ করে, মন্দিরে পুজার প্রচলন করেছে সংস্থাটি।


শিলদা, রানি, কিশোরমণি, রাজা, Bengal, Shilda, Rani, Kishoremani, Medinipur, Midnapore
শিলদার রানি কিশোরমণি

এই মন্দিরে বিগ্রহের নাম কিশোরকিশোরী। দুই দেব-দেবীর এই নাম প্রসঙ্গে দু-একটি কথা বলে নেওয়া যেতে পারে। এখানে শ্রীকৃষ্ণ এবং রাধারানী উভয়েরই কিশোর বয়সের মূর্তি কল্পনা করা হয়েছে। একাদশ থেকে পঞ্চদশ-- এই পাঁচ বছর হল জীবনের কিশোরকাল। যা নবজৌবন হিসেবে চিহ্নিত। এখানে ‘গোবিন্দম’ গ্রন্থের দুটি পংক্তি উল্লেখ করা যেতে পারে—


“কোটিতে প্রিয় ঘটি পাটনের ডোর।

ত্রিভঙ্গভঙ্গিম অঙ্গ নবীন কিশোর।।"


অপরদিকে, নওল কিশোরী রাধিকার রূপ হল বর্ণনার অতীত। ‘কিশোরী’ সম্পর্কে কবি রামেশ্বর ভট্টাচার্যের ‘শিবায়ণ’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে—


“কিশোরী কালেতে কত কান্তি কলেবর।

উপমা করিতে কিছু নাই চরাচর।"


যাইহোক, কষ্টিপাথরের কৃষ্ণ এবং মূল্যবান অষ্টধাতুর রাধিকা—রানির প্রতিষ্ঠিত সুদর্শন দুটি মূর্তিই হয়ে গিয়েছে। ক্লাব কর্তৃপক্ষ নতুন করে পূজার প্রবর্তন করার সময়, বর্তমান ধাতু নির্মিত মুর্তিগুলি প্রতিষ্ঠা করেছেন।


পুরোহিত প্রসঙ্গে দু-চারটি কথা :


অনেকগুলি দেবালয় থাকবার কারণে, শিলদা গঞ্জে অনেকগুলি নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ পরিবারের বসত গড়ে উঠেছিল। এরকমই একটি পরিবারে নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ ছিলেন জনৈক রাজ্যধর ভট্টাচার্য। নিজেদের কালী মন্দির আছে এই পরিবারের। রানীর প্রতিষ্ঠিত শান্তিনাথ শিবের মন্দিরেও এই পরিবার পৌরহিত্য করেন। রাজ্যধরের পুত্র প্রণবানন্দ চক্রবর্তীকে বর্তমানে কিশোরকিশোরী মন্দিরেপুরোহিত নিযুক্ত করা হয়েছে।


রানীর মন্দির গুলির স্থাপত্য রীতি :


শিলদা নগরীতে রাজবংশের হাতে তৈরি মোট ছটি মন্দির-- চারটি শিবের মন্দির, এবং দুটি বিষ্ণু মন্দির।


শিলদা, রানি, কিশোরমণি, রাজা, Bengal, Shilda, Rani, Kishoremani, Medinipur, Midnapore
শিলদার রানি কিশোরমণি

কিশোরকিশোরী মন্দিরটি আট-চালা হিসেবে নির্মিত হয়েছে। উঁচু পাদপীঠের উপর মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত। রাধাকৃষ্ণের মন্দিরটি দক্ষিণমুখী। সেটি নির্মিত হয়েছে দালান-রীতিতে।।


বিশাল আকারের একটি রাসমঞ্চ নির্মাণ করিয়েছিলেন রানি। রাজবাড়ীর মূল ফটকটি দ্বিতল বিশিষ্ট। উপরের তলে নহবতখানা। নিচে হাতিশাল-ঘোড়াশাল এবং প্রহরীদের বাসকক্ষ। এই ফটকের একেবারে মুখোমুখি রাসমঞ্চটি অবস্থিত। যদিও বহু পূর্বকাল থেকে, রাস উৎসব আর অনুষ্ঠিত হয় না। তখন থেকেই অলংকৃত এই মঞ্চটি সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত এবং ধ্বংসের সম্মুখীন।।


শিলদা, রানি, কিশোরমণি, রাজা, Bengal, Shilda, Rani, Kishoremani, Medinipur, Midnapore
শিলদার রানি কিশোরমণি

শিবালয় চারটি আট-চালা এবং পঞ্চ-রত্ন রীতিতে নির্মিত। সেগুলি বর্তমানে স্থানীয় অধিবাসীগণের উদ্যোগে পরিচালিত হচ্ছে। প্রতিটিতেই গাজনের আয়োজন হয়। কিন্তু একই এলাকায় থাকার কারণে, চারটি মন্দিরে চার মাসে চারবার পৃথক গাজনের আয়োজন হয়। এমন দৃষ্টান্ত অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলায় আর দেখা যায় না।


রাজবাড়ী এবং কাছারিবাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। সেখানে সম্প্রতি রাজ্য সরকারের সরকারি দপ্তর নির্মাণ করা হয়েছে। তবে, দুটি মন্দির, মূল ফটক এবং রাসমঞ্চটি এখনো টিকে আছে কোনরকমে।


শিলদা, রানি, কিশোরমণি, রাজা, Bengal, Shilda, Rani, Kishoremani, Medinipur, Midnapore
শিলদার রানি কিশোরমণি

এগুলি কেবল রাজকীর্তি নয়, এই পুরাবস্তুগুলি আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য। এগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা আমাদের কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। আমাদের অভিমত, যতদিন এগুলো রক্ষার দিকে রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকার, কিংবা কোনও অসরকারি প্রতিষ্ঠান এদিকে দৃষ্টিপাত না করছে, ততদিন তরুণ সঙ্ঘ এগুলি বাঁচিয়ে রাখবার দায়িত্ব গ্রহণ করুক। এটি তাদের সামাজিক দায়িত্ববোধের উজ্জ্বল নিদর্শন হয়ে থাকবে।




M E D I N I K A T H A J O U R N A L

Edited by Arindam Bhowmik

(Published on 13.04.2025)


আলাপচারিতা -

শ্রী নিমাই চন্দ্র নাদ, শ্রী গৌরাঙ্গ নাদ, শ্রী কৌশিক নাদ, শ্রী সুরজিৎ লাহা, শ্রী প্রণবানন্দ চক্রবর্তী-- শিলদা।

যেতে চাইলে -

মেদিনীপুর, খড়গপুর, ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া, মানবাজার, কিংবা বাঁকুড়া থেকে শিলদা আসবার সরাসরি বাস পাওয়া যাবে। সবগুলি মোটরেবল রাজপথ।


নিচে কমেন্ট বক্সে আপনার মূল্যবান মতামত জানান।