দুই জননেতা : বসন্তকুমার ও মাস্টারমশাই নিকুঞ্জবিহারী মাইতি | Satish Chandra Samanta & Nikunja Bihari Maiti

দুই জননেতা : বসন্তকুমার ও মাস্টারমশাই


Basantakumar Das & Nikunja Bihari Maiti


প্রকাশকান্তি দাস।



Home » Medinikatha Journal » Prakash Kanti Das » দুই জননেতা : বসন্তকুমার ও মাস্টারমশাই



খেজুরী সমগ্র মেদিনীপুরে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছে। তার সুমহান ঐতিহ্য, বন্দরের খ্যাতি এবং বরণীয়-স্মরণীয়দের পদধূলি এই পূণ্যভূমিতে আজও গর্বের সাথে চর্চিত। রত্নগর্ভা খেজুরী। তার কোলে জন্ম নিয়েছে কৃতি সন্তানগণ, করেছে তাকে মহীয়সী। সংস্কৃতি ও সাহিত্য থেকে শিক্ষাজগতে, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে ও রাজনীতি মঞ্চে তাঁদের স্বার্থহীন উজ্জ্বল অবদান জ্যোতিষ্মান আলোকবর্তিকা। দুই জ্যোতিষ্ক স্মরণীয় বরণীয় জননেতা বসন্তকুমার ও মাস্টারমশাই।


দুই জননেতা : বসন্তকুমার ও মাস্টারমশাই নিকুঞ্জবিহারী মাইতি | Satish Chandra Samanta & Nikunja Bihari Maiti
বসন্তকুমার (দাস)

মাস্টারমশাই হলেই শ্রদ্ধেয় নিকুঞ্জবিহারী মাইতি। তাঁর কর্মজীবন শুরু নন্দীগ্রাম হাইস্কুলের প্রধানশিক্ষক রূপে। পরে কলাগেছিয়ায় প্রতিষ্ঠিত বাংলার প্রথম জাতীয় বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষকের পদ অলংকৃত করেন। হয়েছেন জনপ্রিয় ‘মাস্টারমশাই’, শিক্ষকতার অমূল্য পরিচিতি। আদর্শ গান্ধিবাদী স্বাধীনতা সংগ্রামী, সমাজসেবক ও সফল রাজনীতিবিদ হয়েও থেকেছেন প্রিয় ‘মাস্টারমশাই’। জন্ম ১৮৯২ সালে খেজুরীর কলাগেছিয়া গ্রামে। পিতা-মাতার কনিষ্ঠ পুত্র। পিতা বিশ্বনাথ দেশপ্রেমিক ও আদর্শ শিক্ষক। মাতা সাবিত্রী দেবী। শৈশব হতেই পিতার আদর্শ ও দেশপ্রেমে অনুপ্রাণিত। গোপীনাথপুর মধ্য বাংলা বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা, পরে কাঁথি হাইস্কুল থেকে ১৯১১ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। বয়স তখন তাঁর ১৯ বছর। মুর্শিদাবাদের বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে স্নাতক হলেন এবং কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রি লাভ করলেন ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্যে। অবশ্য স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পূর্বে ১৯১৫ সালে নন্দীগ্রামের কালীচরণপুরে অহল্যাদেবীর সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। তিনি তখন ২৩ বছরের যুবক। নন্দীগ্রাম হাইস্কুলের প্রধানশিক্ষকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন ১৯১৮ সালে। ২৬ বছর বয়সে শুরু হল শিক্ষক-জীবন। একবছর পরে ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগের হৃদয় বিদারক হত্যাকাণ্ড, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ‘নাইটহুড’ পরিত্যাগ এবং গান্ধিজীর পাঞ্জাব যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে ব্রিটিশ সরকার। স্বভাবতই তিনি বিষাদগ্রস্ত ও উদ্বেলিত। সেইসময় গান্ধিজী খিলাফৎ আন্দোলনের শরিক হলেন। গান্ধি আদর্শে অবিচল ও সমর্থক নিকুঞ্জবিহারীর অভিনব পদক্ষেপ। খিলাফৎ আন্দোলনের সমর্থনে নন্দীগ্রামে সম্মেলন আয়োজন করলেন এবং গঠন করলেন খিলাফৎ কমিটি নন্দীগ্রাম থানায়। অব্যবহিত পরে কংগ্রেসে যোগদান। অংশগ্রহণ করলেন ১৯২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কলকাতায় কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশনে। গান্ধিজীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনের ঢেউ সারা ভারত জুড়ে। প্রতিষ্ঠিত হল কলাগেছিয়া গ্রামে (তাঁর জন্মভূমি) বাংলার প্রথম জাতীয় বিদ্যালয় (উদ্বোধন ১ লা মার্চ, ১৯২১)। তিনি পদত্যাগ করলেন লোভনীয় বেতনের নন্দীগ্রাম হাইস্কুলের প্রধানশিক্ষকের পদ। যোগ দিলেন জাতীয় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদে ২৯ বছর বয়সে। সবসময়ের কংগ্রেস কর্মীরূপে সংগঠনের কাজে আত্মনিয়োগের জন্য দশমাস পরে ওই পদ ছাড়লেন। তখন তিনি বছর ৩০ এর প্রাণবন্ত যুবক। গান্ধি আদর্শে অনুপ্রাণিত এক যুবকের কংগ্রেস কর্মীরূপে স্বার্থহীন দেশসেবায় আত্মনিবেদন।


খেজুরীর আরেক মহান দেশপ্রেমিক বসন্তকুমার। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অকুতোভয় সৈনিক, গণপরিষদের সদস্যরূপে সংবিধান রচনার অন্যতম কারিগর ও পরিণত বয়সে মেদিনীপুরের স্বাধীনতা সংগ্রামে অনবদ্য অবদান সমন্বিত পুস্তক রচনায় তাঁর খ্যাতি দেশজোড়া। জন্মেছেন ১৮৯৮ সালে খেজুরীর রামচক গ্রামে, নিকুঞ্জবিহারীর জন্মস্থান কলাগেছিয়া থেকে অল্প কয়েক মাইল ব্যবধান। তিনিও পিতা-মাতার কনিষ্ঠ সন্তান। পিতা ইন্দ্রনারায়ণ— কবিরাজ, সংস্কৃতজ্ঞ ও একনিষ্ঠ বৈষ্ণব। মাতা সুধারানী দেবী। শৈশব অতিবাহিত প্রগতিশীল শিক্ষার বাতাবরণে। প্রাথমিক শিক্ষা পরিবার প্রতিষ্ঠিত গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। জ্যেষ্ঠভ্রাতা ক্ষীরোদচন্দ্র (১৬ বছরের বড়) খেজুরীর প্রথম স্নাতক ও কাঁথির স্বনামধন্য উকিল। তাঁর তত্ত্বাবধানে প্রথমে কাঁথির মডেল স্কুলে ও পরে কাঁথি হাইস্কুল থেকে ১৯১৪ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন বসন্তকুমারের ১৬ বছর বয়সে। ভ্রাতার অনুপ্রেরণায় ভারতের অন্যতম প্রসিদ্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে সম্মানের সঙ্গে আইএসসি করেন এবং বিএসসি পড়াকালীন বিপ্লবী সংগঠন ‘অনুশীলন সমিতি’-র সাথে তাঁর যোগাযোগ ঘটে। কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হলেন ও নিজগৃহে অন্তরীণ। পরে মেছুয়া বাজারের বোমার মামলায় জড়িত থাকার সন্দেহে তাঁকে দেওয়া হল ২ বছরের কারাদণ্ড। সাল ১৯১৬। ১৮ বছরের নবীন যুবকের কারাবাস। কারাবাসের পরে আবার অন্তরীণ নিজগৃহে (রামচক গ্রামে)। বিশ বছর বয়সে বিবাহ নন্দীগ্রামের বৃন্দাবনচকের তরঙ্গিণী দেবীর সাথে। স্নাতক ঐ সময় সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে। এবার পথ পরিবর্তন। সিদ্ধান্ত গান্ধিজীর কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলনে যোগদানের। হলেন গান্ধিবাদী অহিংস সত্যাগ্রহী। সময় ১৯২০ সালের শেষের দিকে, মতান্তরে ১৯২১ সালের শুরুর দিকে। প্রথম পদক্ষেপ ইংরেজি গোলামি শিক্ষার বিরুদ্ধে জেহাদ। যোগ দিলের কাঁথির সদ্য প্রতিষ্ঠিত (৭ই মার্চ ১৯২১ সাল) জাতীয় বিদ্যালয়ের অন্যতম শিক্ষকরূপে। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ শিক্ষক জীবনের শুরু। কালক্রমে তিনি হলেন সবার প্রিয় ‘মাস্টারমশাই’।


দুই উদীয়মান দেশপ্রেমিকের জীবন নির্মাণপর্বের ছবি থেকে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট। বসন্তকুমার নিকুঞ্জবিহারীর বয়ঃকনিষ্ঠ (৬ বছরের ছোট)। উভয়ে মাতা-পিতার কনিষ্ঠ সন্তান। তাঁদের শৈশবের বাতাবরণ পারিবারিক শিক্ষার আলোকে আলোকিত। দুজনে একই স্কুলের কৃতী ছাত্র। কলেজের শিক্ষা বসন্তকুমারের কলকাতায়, আর নিকুঞ্জবিহারীর মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে। তিনি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেছেন। কিন্তু বসন্তকুমারের গ্রাজুয়েশনের পরে শিক্ষার সমাপ্তি। দুজনের বিবাহ শিক্ষালাভকালে নন্দীগ্রামে। উভয়ে খেজুরী ও নন্দীগ্রামের গর্ব। বিপ্লববাদের সংস্পর্শে বসন্তকুমারের যাত্রা শুরু দেশমাতৃবন্দনায় মাত্র ১৮ বছর বয়সে এবং কারাবাসও। এক প্রস্ফুটিত যৌবনের আহুতি দেশমাতৃকার বেদীমূলে। পরিবর্তিত পথও পন্থার দিশা। হলেন কংগ্রেস কর্মী, যোগ দিলেন কাঁথি জাতীয় বিদ্যালয়ে অন্যতম শিক্ষকরূপে। সেই থেকে গান্ধিবাদী অহিংস সত্যাগ্রহীরূপে অসযোগ আন্দোলনে। বয়স তখন প্রায় ২৩। অন্যদিকে নিকুঞ্জবিহারীর গান্ধিবাদে আস্থা ও ভালোবাসা শুরু থেকে। নন্দীগ্রামের প্রধানশিক্ষক থাকাকালীন হয়েছেন কংগ্রেস কর্মী। পরে কলাগেছিয়ার জাতীয় বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষকের পদে, অসহযোগ আন্দোলনের প্রথম পদক্ষেপ। হলেন কিছুকাল পরে সর্বসময়ের কংগ্রেস কর্মী। তখন তাঁর বয়স ৩০ ছুঁই ছুঁই।



গান্ধিজীর মত ও পথ এবং আদর্শে বিশ্বাসী দুই কংগ্রেসী ছিলেন অকুতোভয় স্বাধীনতা সংগ্রামী ও নিরলস অহিংস সত্যাগ্রহী। দেশবাসীর অকুণ্ঠ ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা লাভে হলেন কিংবদন্তী। তাঁদের জীবন সংগ্রাম কঠিন অনুশাসনে ও সত্যের দ্বারা পরিচালিত। বারবার কারাবাসের কঠোর নির্যাতনেও সংকল্প ও লক্ষ্যে তাঁরা থেকেছেন হিমালয়ের মতো সুদৃঢ় ও অচঞ্চল। অসহযোগ আন্দোলন— আইন অমান্য আন্দোলন (লবণ সত্যাগ্রহ) ও ভারত ছাড়ো আন্দোলন (করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে) স্বাধীনতা সংগ্রামের এই তিন পর্যায়ে তাঁদের রোমাঞ্চকর ভূমিকা দৃষ্টান্ত স্বরূপ। দুই দেশপ্রেমিকের জীবন সংগ্রামের নানা কথায় স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমিকায় এই আলোচনা সমৃদ্ধ।


অসহযোগ আন্দোলন ক্রমশ গতিবান। দেশের বিভিন্নপ্রান্তে অভূতপূর্ব সাড়া। এই রাজনৈতিক বাতাবরণের মাঝে ইংল্যান্ডের যুবরাজের ভারত পরিদর্শন। কলিকাতা আসার কথা ১৯২১ সালের ২৪ শে ডিসেম্বর। কংগ্রেসের হরতাল পালনের ঘোষণা। ব্যাপক ধরপাকড়। ১০ই ডিসেম্বর গ্রেফতার হলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, দেশপ্রাণ বীরেন্দ্রনাথ শাসমল, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু প্রমুখ। ডিসেম্বরের শেষের দিকে গ্রেফতার হন মেদিনীপুরের অন্যান্য কংগ্রেস নেতা কর্মী। নিকুঞ্জবিহারী ও বসন্তকুমারও গ্রেফতার হলেন। কারাদণ্ড ১ বছরেরও বেশি। নিকুঞ্জবিহারীর প্রথম কারাবাস ও বসন্তকুমারের দ্বিতীয়বার কারাদণ্ড। কারামুক্তির পরে উভয়ে সম্মুখীন হলেন পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের। ১৯২২ সালের ডিসেম্বরে গয়া কংগ্রেসে ‘নিখিল ভারত স্বরাজ্য দল’-এর আত্মপ্রকাশ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বে এবং দেশপ্রাণ বীরেন্দ্রনাথ শাসমল দলের বঙ্গীয় শাখার সম্পাদক পদে। মেদিনীপুরের কংগ্রেস কর্মীদের মধ্যে গভীর প্রতিক্রিয়া। বিতণ্ডা শুরু পরিবর্তন পন্থী ও পরিবর্তন বিরোধীদের মধ্যে। দুজনের সিদ্ধান্ত দলাদলির মধ্যে না থাকার।


গান্ধিজীর প্রদর্শিত গঠনমূলক কর্মবিস্তারে বসন্তকুমার ও নিকুঞ্জবিহারী সচেষ্ট হলেন। অস্পৃশ্যতা বর্জন, সামাজিক সম্প্রীতি বৃদ্ধি, পল্লী উন্নয়ন, চরকা ও খদ্দরের প্রচার ইত্যাদি ছিল মূল কর্মসূচী। বসন্তকুমার ছিলেন কাঁথি জাতীয় বিদ্যালয়ের অন্যতম শিক্ষক ও কংগ্রেস কর্মী। তাঁর কর্মকাণ্ড প্রধানত নিয়ন্ত্রণ হতো ঐ বিদ্যালয়ের মঞ্চ থেকে। নিকুঞ্জবিহারী সেসময় পূর্ণসময়ের কংগ্রেস কর্মী। তাঁর কার্যক্রম বিশেষভাবে খেজুরী থানাকেন্দ্রিক, অবশ্য অন্যান্য থানাতেও ছিলেন নানাভাবে সক্রিয়। দুজনে উদ্যোগী হলেন অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ কর্মসূচী রূপায়নে। হরিজনদের মন্দিরে প্রবেশ, পূজার অধিকার, তাদের স্পৃষ্ট জলগ্রহণ, একত্রে পংক্তিভোজন, তাদের গৃহের পূজা-পার্বনে অংশগ্রহণ ইত্যাদি ছিল তাঁদের অন্যতম কয়ার্যক্রম। এই প্রেক্ষিতে গ্রামে গ্রামে প্রচার, সভা ও সমিতি পরিচালনা ছিল করণীয় কর্তব্য। গান্ধিজীর কাঁথিতে শুভ আগমন ৪ ঠা জুলাই ১৯২৫ সালে। গঠনমূলক কার্যক্রমে ঘটলো অভাবনীয় অগ্রগতি ও প্রগতি। গান্ধিজীর অতিপ্রিয় চরকা ও খাদি প্রচারে আসে জনজোয়ার। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের সভাপতিত্বে কাঁথিতে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘কাঁথি খদ্দর প্রচার সমিতি’। বসন্তকুমারের সভাপতিত্বে পরিচালিত ‘কাঁথি সেবা সংঘ’ খদ্দর প্রচার ও বিক্রয়ে মুখ্যভূমিকা গ্রহণ করে। সেই সঙ্গে বিনামূল্যে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসাও করানো হতো জনসাধারণের। হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার উদ্দেশ্যে ১৯২৬ সালে কাঁথিতে গঠিত হল ‘হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি সমিতি’। সভাপতি হলেন কাঁথি জাতীয় বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষক প্রমথনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও ঐ বিদ্যালয়ের অন্যতম জনপ্রিয় শিক্ষক বসন্তকুমার হলেন সম্পাদক। সদস্যদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন নিকুঞ্জবিহারী। শান্তিপূর্ণভাবে উভয় সম্প্রদায়ের সমস্যাগুলির সমাধান হল সমিতির মাধ্যমে। নিশ্চিতরূপে এক দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ। দুর্দশাগ্রস্ত জনগণের সেবা গভীরভাবে জড়িয়েছিল তাঁদের কর্মযজ্ঞে। প্রসঙ্গত ১৯২৬ সালে কেলেঘাই নদীর বাঁধ ভেঙে বন্যায় মেদিনীপুর সদর, কাঁথি ও তমলুক মহকুমা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ও দেশপ্রাণ বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের নেতৃত্বে ‘মেদিনীপুর বন্যা সাহায্য সমিতি’ গঠিত হয়। সহকারী সম্পাদক হলেন নিকুঞ্জবিহারী। বসন্তকুমার মহাপ্রাণ আচার্যের নির্দেশে ত্রাণকার্যে নিরলসভাবে নিয়োজিত থাকেন।



নিকুঞ্জবিহারী ১৯২৮ সালে পারিবারিক অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে বাধ্য হলেন কলিকাতা কর্পোরেশনের অধীনে কয়লা সরবরাহের দায়িত্ব গ্রহণ করতে। ১ বছর বাদে যোগ দিলেন ডায়মণ্ড হারবার হাইস্কুলের প্রধানশিক্ষকের পদে। আবার শিক্ষকের ভূমিকায়। বসন্তকুমার ধারাবাহিকভাবে কাঁথি জাতীয় বিদ্যালয়ের শিক্ষকের ভূমিকায়। শিক্ষকরূপে গঠনমূলক কাজে কংগ্রেস কর্মী হিসেবে স্বতস্ফূর্ত কর্তব্য পালন করেন। উল্লেখযোগ্য হল, এই দীর্ঘ সময়ে কারোরই কারাবাস ঘটেনি।


স্বাধীনতা সংগ্রামে আইন অমান্য আন্দোলন (লবণ সত্যাগ্রহ) এক ঐতিহাসিক দেশব্যাপী সাড়া জাগানো বৈপ্লবিক অহিংস সত্যাগ্রহ। ঘটেছিল গান্ধিজীর নেতৃত্বে দুই পর্যায়ে। ১৯৩০ সালের ৬ ই এপ্রিল গুজরাটের ডান্ডির সমুদ্র উপকূলে ৭৮ জন সঙ্গী নিয়ে গান্ধিজী লবণ আইন অমান্য করলেন। ইতিহাস রইলো সাক্ষী। ১৯৩১ সালে গান্ধি-আরউইন চুক্তি হয়। এরপরেই আন্দোলনের বিরতি। আবার শুরু ১৯৩২ সালে। দুই পর্বে বসন্তকুমার ও নিকুঞ্জবিহারীর উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ। তারই সারাংশ আলোচনার অংশ।


কাঁথিতে ১৯৩০ এর মার্চ মাসে শুরু হয় আইন অমান্যের প্রস্তুতি। গঠিত হল ৭ জন সদস্য নিয়ে ‘আইন অমান্য পরিষদ’। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন বসন্তকুমার ও নিকুঞ্জবিহারী। কাঁথি শহরের অদূরে পিছাবনি নির্বাচিত লবণ আইন ভঙ্গের প্রধান কেন্দ্ররূপে। কর্মশিবিরের দায়িত্বে বসন্তকুমার। নিকুঞ্জবিহারী বিভিন্ন সভায় বক্তৃতার মাধ্যমে জনমত গঠনে সক্রিয় হলেন। পিছাবনীতে ১৩ ই এপ্রিল মহতী জনসভায় বক্তৃতা দিলেন আইন অমান্য আন্দোলন সম্পর্কে, আন্দোলনের স্বপক্ষে। ১৪ ই এপ্রিল সকালে বসন্তকুমার গ্রেফতার হলেন। ১ বছরের কারাদণ্ড ও ৩০০ টাকা জরিমানা (অনাদায়ে বর্ধিত কারাবাস)। কয়েকদিনের মধ্যে নিকুঞ্জবিহারী গ্রেফতার হলেন। ১ বছর ৩ মাস সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলেন। খেজুরীর দুই দেশপ্রেমিক আবার কারাগারে। ‘গান্ধি-আরউইন চুক্তি’ অনুসারে ১৯৩১ সালের এপ্রিল মাসে কাঁথি মহকুমার অন্যান্য রাজবন্দীর সাথে নিকুঞ্জবিহারী ও বসন্তকুমার কারাগার থেকে মুক্তি পেলেন। অন্যান্য রাজবন্দীর সাথে নিকুঞ্জবিহারী ও বসন্তকুমারকেও সংবর্ধনা দেওয়া হল খেজুরী থানার হ্যেঁড়িয়া হাইস্কুলে। পরে অজয়ার ভস্মীভূত কংগ্রেস অফিসের পাশের মাঠে। দেওয়া হল সংগৃহীত ৫০০ টাকা দেশের কাজের জন্য। টাকা প্রত্যার্পিত উপযুক্ত পরিমাণে অর্থ সহযোগে কংগ্রেস অফিস পুনর্নিমাণে। দেশকে ভালোবাসা ও দেশের প্রতি দায়বদ্ধতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।


‘গান্ধি-আরউইন চুক্তি’ অনুসারে আইন অমান্য আন্দোলনের বিরতি। স্থির হল বিরতি পর্বে কংগ্রেস সংগঠনগুলির পুনর্গঠন ও সমাজসেবামূলক কাজে আত্মনিয়োগ। বসন্তকুমার হলেন মেদিনীপুর জেলা কংগ্রেস কমিটির সাধারণ সম্পাদক, রামচন্দ্র সিং ও পূর্ণচন্দ্র চক্রবর্তী এবং শৈলজানন্দ সেন হলেন সহ-সম্পাদক, আর দেবেন্দ্রলাল খান হলেন সভাপতি। গঠিত হল ১৬ জনের কর্মপরিষদ। নিকুঞ্জবিহারী হলেন সেই কর্মপরিষদের অন্যতম সদস্য। জেলা জুড়ে চলে বিভিন্ন কর্মসূচী। কাঁথিতে পরিচালিত হল নারী ও পুরুষ কর্মশিবির। খেজুরীতেও অনুষ্ঠিত হল নিকুঞ্জবিহারীর উদ্যোগে নানা কর্মসম্মেলন ও পুরুষ কর্মশিবির ও আলোচনা চক্র। মূল লক্ষ্য স্বদেশী, অসহযোগ আন্দোলন, আইন অমান্য আন্দোলন ও স্বরাজের পথ ও পন্থা বিষয়ে সম্যক্রূপে শিক্ষিত করে তোলা। সমগ্র জেলাতে যুবদল সংগঠনের উদ্দেশ্যে ১৯৩১ সালের শেষের দিকে মেদিনীপুর শহরে সেবাদল শিবির পরিচালিত হয়। এই প্রসঙ্গে বিশেষ দুটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। বসন্তকুমার ও নিকুঞ্জবিহারীর নেতৃত্বে কংগ্রেস কর্মীরা উদ্যোগী হলেন বর্গাদার সমস্যার সমাধানে। লক্ষ্য, ভাগচাষী কৃষকদের প্রাপ্য ফসলের ভাগ নিশ্চিত করা আলাপ আলোচনার মাধ্যমে। এই সমস্যা গ্রামীণ অর্থনীতি ও রাজনীতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সামাজিক ব্যাধি অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে জনমত গঠনের আন্দোলনে আবারও উভয়ে সামিল হলেন। শুরু হল জাতপাত নির্বিশেষে একত্রে পংক্তিভোজনের কর্মসূচী। আন্দোলনের বিস্তার বিশেষভাবে ঘটে ও পরিচালিত হয় খেজুরী ও নন্দীগ্রাম থানায়। উল্লেখ্য, নিকুঞ্জবিহারীর উদ্যোগে খেজুরীর টিকাশি গ্রামে, কামারদা ও অজয়াতে অস্পৃশ্যতা বর্জন সভা। নন্দীগ্রামেও একত্রে পংক্তিভোজনের পর অনুষ্ঠিত সভায় বসন্তকুমার উপস্থিত হলেন মেদিনীপুর থেকে।


১৯৩১ এর ডিসেম্বরের শেষে গান্ধিজী ফিরলেন বিলেত থেকে ব্যর্থ বৈঠকের পর। ইতিমধ্যে শাসকদল ‘গান্ধি-আরউইন চুক্তি’ লঙ্ঘন করে চলেছে। গান্ধিজীর নেতৃত্বে আবার দ্বিতীয় দফার আইন অমান্য আন্দোলন শুরু কংগ্রেসের, ১৯৩২ সালের ৩ রা জানুয়ারি। মেদিনীপুরে আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর। জনতা অস্বীকৃত ফৌজদারী ট্যাক্স প্রদান করতে। মেদিনীপুর জেলার কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক বসন্তকুমারের ১ মাসের কারাদণ্ড। বসন্তকুমার আরও একবার কারাবন্দী ৬ ই এপ্রিল, ১৯৩২ সালে, খেজুরীর অজানবাড়িতে বক্তৃতা দেওয়াকালীন। জরিমানা সহ ১ বছরের কারাদণ্ড। প্রতিবাদে স্বতস্ফূর্ত পূর্ণ হরতাল। মুক্তি পেলেন ১৯৩৩ সালের ২১ শে এপ্রিল। অন্যদিকে কাঁথি রাষ্ট্রীয় সমিতির সভাপতি নিকুঞ্জবিহারীর নেতৃত্বে জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত কাঁথির জনসভাতে তাঁকে গ্রেফতার করা হল। কারাদণ্ড দেওয়া হল ৬ মাসের। ফলে বসন্তকুমার যখন কারাগারের বাইরে তখন নিকুঞ্জবিহারী কারান্তরালে। সেই সময় গান্ধিজীর ভাবধারায় অনুপ্রাণিত বসন্তকুমার অস্পৃশ্যতা বর্জন আন্দোলনের শরিক হলেন। কিছুকাল পরে ‘তিন মাইল’ নিয়ম পালনে স্পেশাল কনস্টেবলের কার্য করার নির্দেশে আইন অমান্য করায় আবারও তাঁর ৬ মাসের কারাদণ্ড ও ১০০ টাকা জরিমানা। মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলে রইলেন ২২.০২.১৯৩৪ থেকে ০৮.০৮.১৯৩৪। দ্বিতীয় দফার আইন অমান্য আন্দোলনে ১৯৩২ থেকে ১৯৩৪ এর মধ্যে বেশ কয়েকবার তাঁর বিভিন্ন মেয়াদের কারাবাস। নিকুঞ্জনবিহারী জেল থেকে ছাড়া পেলেন ১৯৩৩ এর জুলাই মাসে। কিছুকাল সামাজিক গঠনমূলক কাজে নিযুক্ত থাকার পর ১৯৩৪ সালে ২৪ পরগণার শিবানীপুর শ্রীনাথ ইনস্টিটিউশনের প্রধান শিক্ষকের পদ গ্রহণ করলেন। লক্ষ্যণীয়, তাঁর সংগ্রামী জীবনে বিভিন্ন সময়ে বারবার তিনি ফিরে এসেছেন শিক্ষা জগতে।


উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতির মাঝে গান্ধিজীর বোম্বাই অধিবেশনে ১৯৩৪ সালের অক্টোবর মাসে কংগ্রেসের সভ্যপদ ত্যাগ। অভাবনীয় ও অকল্পনীয় পরিবেশ। পরের বছর ১৯৩৫ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাশ হল ‘ভারত শাসন আইন’। মেদিনীপুর জেলা কংগ্রেস ও জেলার কয়েকটি সংস্থা ছাড়া বাংলায় বেআইনি ঘোষিত হল কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠানগুলি। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হল। স্থির হল নির্বাচিত আইনসভাগুলির কাজ শুরু হবে ১৯৩৭ সালের ১ লা এপ্রিল থেকে। ১৯৩৭ সালে প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচনে নিকুঞ্জবিহারী খেজুরী, ভগবানপুর ও পটাশপুরের সংযুক্ত কেন্দ্রে কংগ্রেস প্রার্থী রূপে মনোনয়ন পেলেন। নির্বাচনে নিকুঞ্জবিহারীর প্রতীক চিহ্ন ছিল ‘লাঙল’। জয়ী হলেন বিপুল ভোটে। নির্বাচিত হলেন বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য পদে। দু’বছর বাদে ১৯৩৯ সালে কংগ্রেসের মন্ত্রীসভাগুলি থেকে একযোগে পদত্যাগ করলে তিনিও ইস্তফা দেন। এই পর্যায়ে বসন্তকুমারের পদক্ষেপ ছিল অন্যরূপ। কারামুক্তির পরে সম্মুখীন হলেন বিড়ম্বনাজনক পরিস্থিতির। মেদিনীপুর জেলা কংগ্রেসের ওপর নিষেধাজ্ঞা তখনও বহাল। জেলা সম্পাদকরূপে কাজ করা সম্ভব নয়। সচেতনভাবে ভারত শাসন আইন অনুসারে নির্বাচনে অংশগ্রহণে বিরত থাকলেন। যোগ দিলেন গঠনমূলক কর্মধারায়। সমাজ সংস্কার ও বিকাশে নিয়োজিত তাঁর নবতর প্রয়াস। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলেন প্রাদেশিক স্তরে কংগ্রেসের কাজে যোগদানের। সপরিবারে ১৯৩৬ সালের শেষের দিকে তাঁর অস্থায়ী বাসস্থান হাওড়া, ভগ্নীপতি কেদারনাথের সৌজন্যে। আগামী প্রায় ৭ বছর তাঁর সংগ্রামী আন্দোলনের কর্মকেন্দ্র কলকাতা। ১৯৩৭-৩৮’ এর মধ্যে হলেন প্রদেশ কংগ্রেসের সহ-সাধারণ সম্পাদক। সরাসরি কাজ করার সৌভাগ্য হল ভারতের উদীয়মান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে। উল্লেখ্য, ১৯৩৯-৪০ সালের মধ্যে বসন্তকুমার সাধারণ সম্পাদক হলেন ‘সেন্ট্রাল কাউন্সিল ফর সিভিল ডিস্‌ওবিডিয়েন্‌স’-এর।


এই সময় বসন্তকুমার সভাপতি নির্বাচিত হন ‘কাঁথি মহকুমা রাষ্ট্রীয় সমিতি’-র। বত্রিশ জনের সদস্যযুক্ত রাষ্ট্রীয় সমিতির কার্যকরী কমিটির অন্যতম সদস্য হলেন নিকুঞ্জবিহারী। আবার দুজনের একযোগে কাজ করার সুযোগ। কয়েক মাস বাদে বসন্তকুমার পদত্যাগ করেন। সভাপতি হলেন নিকুঞ্জবিহারী। তাঁর নির্বাচনী এলাকার মধ্যে প্রথম সত্যাগ্রহীরূপে পটাশপুর থানার মংলামাড়োতে কারাবরণ করেন। ১৯৪১ সালের শেষের দিকে মুক্তিলাভ। এদিকে সত্যাগ্রহী সংগঠনের বিশিষ্ট নেতা বসন্তকুমারের ৯ মাসের কারাদণ্ড। অদ্ভুত সংযোগ। দুই সংগ্রামী নেতা আবার কারারুদ্ধ।


মুক্তিলাভের কিছুকাল পরে ১৯৪২ সালের প্রথমার্ধে নিকুঞ্জবিহারী কাঁথি মহকুমা কমিটির সভাপতি হলেন। সেই সঙ্গে তিনি নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটিরও সদস্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সারা বিশ্ব অভাবনীয় অস্থিরতা ও সংকটের মধ্যে। ব্রিটিশ-ভারতও অভূতপূর্ব সমস্যার গভীরে (জার্মান মিত্র-জাপান ভারতের দোরগোড়ায়)। ১৯৪২ সালের ৮ ই আগস্ট বোম্বাইয়ে কংগ্রেস অধিবেশনে ‘ভারত-ছাড়ো’ আন্দোলনের প্রস্তাব গৃহীত। গান্ধিজীর ‘করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে’ মন্ত্র ভারতবাসীকে নতুন চেতনায় উদ্বুদ্ধ করলো। অত্যাচারী ব্রিটিশ সরকার ৯ ই আগস্ট গান্ধিজী সহ কংগ্রেসের শীর্ষ স্থানীয় সকল নেতাকে গ্রেফতার করলো। প্রতিবাদে কাঁথি সহ কাঁথি মহকুমার সভা হরতাল পালন। ২৩ শে আগস্ট নিকুঞ্জবিহারী ও স্থানীয় নেতৃত্বগণ গ্রেফতার হলেন। ঐ সময় বসন্তকুমারের সুচিন্তিত পদক্ষেপ। কারামুক্তির কিছুকাল পর হাওড়া থেকে পরিবারসহ নিজগ্রাম রামচকে প্রত্যাবর্তন। উদ্দেশ্য ‘ভারত-ছাড়ো’ আন্দোলনে সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ ও অংশগ্রহণ করা কোনো রকম পিছুটান ছাড়া। এটি ছিল তাঁর কাছে, হয় ভারতমাতার শৃঙ্খলমুক্তি নয় মৃত্যুবরণ। তিনিও গ্রেফতার হলেন কিছুকালের মধ্যে। ব্রিটিশ শাসক সমগ্র দেশে কংগ্রেস নেতা ও নেতৃস্থানীয়দের নিক্ষেপ করলো কারাগারে। তার সঙ্গে শুরু হল অমানুষিক নির্যাতন, উৎপীড়ন। লক্ষ্য, আন্দোলনকে আঁতুড়েই বিনিষ্ট করা।


নিকুঞ্জবিহারী ও বসন্তকুমার উভয়ের ৩ বছর কারাদণ্ড। ১৯৪৫ সালে তাঁরা জেল থেকে ছাড়া পেলেন। দুজনে এখন কাঁথিতে। ১৯৪৫ এর ডিসেম্বরের শেষে গান্ধিজীর শুভাগমন দ্বিতীয়বার (প্রথমবার ১৯২৫ সালে)। তাঁকে স্বাগত জানালেন বসন্তকুমার ও নিকুঞ্জবিহারী সহ কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ। গান্ধিজীর কাঁথি বাস ৩০ শে ডিসেম্বর থেকে ২ রা জানুয়ারি। ফিরে গেলেন ৩ রা জানুয়ারি ১৯৪৬ সালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি। বিশ্ব রাজনীতিতে অভাবনীয় পরিবর্তন। ভারতের স্বাধীনতা এখন কেবল সময়ের অপেক্ষা। ১৯৪৬ সালে কেন্দ্রে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হলে প্রদেশগুলিতে আইনসভা গঠনের উদ্দেশ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নিকুঞ্জবিহারী বর্ধমান বিভাগ উত্তর মিউনিসিপ্যাল নির্বাচন কেন্দ্র থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেন এবং বিপুল ভোটে জয়লাভ করলেন। বসন্তকুমার এর আগে যেমন প্রাদেশিক আইনসভায় যোগদানের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেননি, তেমনি এবারেও সচেতনভাবে নির্বাচনে যোগদান থেকে বিরত থাকলেন। ১৯৪৬ সালের ১৫ ই আগস্ট কলকাতায় দুর্ভাগ্যজনক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূত্রপাত। মেদিনীপুর সহ বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি। আঁচ এসে পড়ল কাঁথিতেও। বসন্তকুমার ও নিকুঞ্জবিহারী ও অন্যান্য সহকর্মীরা উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় রক্ষার জন্য শুরু করলেন শান্তি মিছিল, সভা ইত্যাদি। প্রায় ৩ মাস পরে পরিস্থিতি অনেক নিয়ন্ত্রিত হয় ও শান্ত হয়ে আসে পরিস্থিতি। শুরু গণপরিষদের প্রতিনিধি নির্বাচন প্রক্রিয়া। বসন্তকুমার হলেন কাঁথি মহকুমার নির্বাচিত প্রতিনিধি। নিকুঞ্জবিহারী রইলেন প্রাদেশিক স্তরে বঙ্গীয় ব্যবস্থা পরিষদের সদস্যরূপে। বসন্তকুমারের যাত্রা কেন্দ্রে (দিল্লি) গণপরিষদের কাঁথি মহকুমার প্রতিনিধিত্ব করতে। ১৪ ই জুলাই, ১৯৪৭, সোমবার নথিপত্র পেশ করে গণপরিষদের রেজিস্টারে তিনি সই করলেন। বিধিবদ্ধ ভাবে তাঁর সদস্যপদ অন্তর্ভুক্ত হল।


দুই জননেতা : বসন্তকুমার ও মাস্টারমশাই নিকুঞ্জবিহারী মাইতি | Satish Chandra Samanta & Nikunja Bihari Maiti
মাস্টারমশাই নিকুঞ্জবিহারী মাইতি

প্রাক-স্বাধীনতা কালে উভয়ের কর্মক্ষেত্রের পরিবর্তন। বসন্তকুমারের কেন্দ্রে দিল্লিতে সর্বভারতীয় রাজনীতি মঞ্চে গণপরিষদের সদস্যরূপে খসড়া সংবিধান রচনায় অংশগ্রহণ ও গণপরিষদের আইন সভায় সক্রিয় যোগদান করলেন। অন্যদিকে নিকুঞ্জবিহারী প্রাদেশিক আইন সভায়। অনতিপরে দেশের স্বাধীনতা ১৯৪৭ সালের ১৫ ই আগস্ট। পাঞ্জাব ও বাংলা দ্বিখণ্ডিত, অগণিত নরনারীর অশ্রুসিক্ত দেশান্তর, অকল্পনীয় করুণ ইতিহাস। ড. প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বে বিভাজিত বাংলার পশিমবঙ্গে প্রাদেশিক সরকারের গঠন। তাঁর মন্ত্রীসভায় নিকুঞ্জবিহারী শিক্ষা ও সেচ দফতরের দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন। এক অনন্য সম্মান। তিনি পশ্চিমবঙ্গের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী। লোকপ্রিয় মাস্টারমশাইয়ের যোগ্য স্বীকৃতি। ড. প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষের মুখ্যমন্ত্রীত্বের কাল ১৫.০৮.১৯৪৭ থেকে ২২.০১.১৯৪৮। এই স্বল্পকালীন সময়ে নিকুঞ্জবিহারী কৃতিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তী সময়ে ড. বিধানচন্দ্র রায়ের মন্ত্রীসভায় (গঠিত হয় ১৯৪৮ সালের ২৩ শে জানুয়ারি— নেতাজীর জন্মদিন) পুনর্বাসন, ত্রাণ ও সমবায় বিভাগের মন্ত্রীত্বের দায়িত্ব পালন করেন। আর একটি দায়িত্ব তাঁর ওপর বর্তায়— সেটি ছিল সরবরাহ বিভাগের দায়িত্ব। ওই সময় ছিন্নমূল উদ্বাস্তু স্রোত, অগণিত নরনারী পূর্ববঙ্গ থেকে আশ্রয়ের আশায় পশ্চিমবঙ্গে চলে আসে। তৈরি হয় সমস্যা সংকুল জটিল পরিস্থিতি। ত্রাণ-মন্ত্রীরূপে তাঁদের পুনর্বাসনে নিকুঞ্জবিহারী আক্ষরিক অর্থে ঝাঁপ দিলেন। বসন্তকুমার দিল্লিতে গণপরিষদ ও প্রভিশনাল লোকসভায় অন্যান্য বঙ্গীয় সহকর্মীদের সাথে বাংলার উদ্বাস্তু পুনর্বাসন সমস্যা সুচিন্তিত তীক্ষ্ম বক্তব্য সংখ্যাতত্ত্ব সহকারে উপস্থিত করলেন ক্রমাগত। কেন্দ্রীয় সরকার নানা রকমের প্রকল্প ঘোষণা করতে বাধ্য হলেন। আন্দামান, দণ্ডকারণ্য ও বিভিন্ন পার্শ্ববর্তী রাজ্যে পুনর্বাসনে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি ঘটলো। খেজুরীর দুই জননেতার অপূর্ব সমন্বয়। বলা যায় যুগলবন্দী। দুঃখের বিষয় ১৯৫২ সালের নির্বাচনে নিকুঞ্জবিহারী অকৃতকার্য হলেন। বসন্তকুমার লোকসভা নির্বাচনে নির্বাচিত হলেন এবং কাঁথি লোকসভার সদস্যরূপে কেন্দ্রে, দিল্লিতে। তিনি আবারও সোচ্চার হলেন বাংলার উদ্বাস্তু পুনর্বাসন নিয়ে। গণপরিষদে তাঁর সহযোগী রেণুকা রায় তখন পশ্চিমবঙ্গের ত্রাণমন্ত্রী। নিকুঞ্জবিহারীর অসমাপ্ত কাজ বসন্তকুমার ও রেণুকা দেবী ড. বিধানচন্দ্র রায়ের (মুখ্যমন্ত্রী) নেতৃত্বে পুনর্বাসন সমস্যা সমাধানে ব্রতী হলেন। নির্বাচনে হারের পর তিনি নিকুঞ্জবিহারী মূলত তিনটি বিষয়ে সক্রিয় হলেন। মনযোগী হলেন জেলা ও গ্রামীণ স্তরে কংগ্রেস সংগঠনকে মজবুত করার প্রতি। বিনোবা ভাবের ভূ-দান আন্দোলনকে বাংলায় জনপ্রিয় করে তুলতে উদ্যোগী হলেন এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা রূপায়ণে নানাবিধ কর্মকাণ্ডে নিবিড়ভাবে সক্রিয় হলেন। উল্লেখ্য, ১৯৫৪ সালের আগস্টে মেদিনীপুর জেলা কংগ্রেসের অফিসে তাঁর সভাপতিত্বে প্রথম ছাত্রপরিষদ গঠিত হয়। আপাতদৃষ্টিতে এই সময়ে বসন্তকুমারের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ কিছুটা হলেও ক্ষীণ হতে থাকে। এই প্রসঙ্গে ১৯৫৫ সালের কাকদ্বীপে প্রাদেশিক কৃষক সম্মেলনের কথা স্মরণ করা অনুচিত হবে না। আলোচনা সভায় কৃষিমন্ত্রী প্রফুল্ল সেন সহ নিকুঞ্জবিহারী ও বসন্তকুমার প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। সভায় বাংলার কৃষিচক্রের পাটচাষের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। এই বিষয়ের প্রতি উভয়ের অর্থাৎ নিকুঞ্জবিহারী ও বসন্তকুমারের দীর্ঘদিনের প্রিয় ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ বলে বিবেচিত। প্রসঙ্গত, বসন্তকুমার ছিলেন সেন্ট্রাল জুট কমিটির সদস্য। বলার অপেক্ষা রাখে না, দুজনের সংযোগ, আর ছিল অধিক পাট চাষের সুবিশেষ আহ্বান।


১৯৫৭ সালে ঘাটাল লোকসভা কেন্দ্রে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হলেন নিকুঞ্জবিহারী। বসন্তকুমার সেবারে কাঁথি কেন্দ্রে লোকসভা নির্বাচনে অকৃতকার্য। ১৯৫৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিধান পরিষদের সদস্যরূপে আত্মপ্রকাশ তাঁর। নিকুঞ্জবিহারী এখন কেন্দ্রে, দিল্লিতে। আর বসন্তকুমার বাংলায়। দুজনের কর্মক্ষেত্র পাল্টে গেল। বিধাতার কী অপূর্ব নাট্য রচনা। দুজনে রইলেন দুই কেন্দ্রে। নিকুঞ্জবিহারী এখন ৬৫ বছরের প্রবীণ। হলেন লোকসভার সদস্য। কিছুটা হলেও জীবনের ধর্ম মেনে ঘটেছে শারীরিক কর্মক্ষমতার হ্রাস। বসন্তকুমার আবারও সক্রিয় হলেন সমস্যা সংকুল বাংলার উদ্বাস্তু পুনর্বাসনে। ১৯৬২ সালের তৃতীয় সাধারণ নির্বাচন। এবার বসন্তকুমার বিপুল ভোটে বাংলার ভূতপূর্ব মুখ্যমন্ত্রী ড. প্রফুল্ল ঘোষকে পরাজিত করে আবারও হলেন লোকসভার সদস্য। পাশাপাশি নিকুঞ্জবিহারী রাজ্যসভার সদস্য মনোনীত হলেন। এই প্রথম সম্ভাবনা ঘটলো দুজনের কেন্দ্রে যৌথ প্রয়াস অবলম্বনে দেশের ও দশের অগ্রগতি ত্বরান্বিত করার। ১৯৬২ সালে ভারতের ভাগ্যাকাশে ঘটলো এক বৈপ্লবিক বিপর্যয়। চীনের আক্রমণে ভারত বিপর্যস্ত। অভাবনীয় রাজনৈতিক বিপর্যয়। মাতৃভূমি রক্ষায় উদ্বুদ্ধ দেশবাসীর সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে জনগণের সুদৃঢ় প্রতিজ্ঞা। সত্তর বছরের প্রবীণ নিকুঞ্জবিহারী ঝাঁপ দিলেন যুদ্ধ তহবিলের জন্য অর্থ সংগ্রহের কাজে। খেজুরী থানার অজয়াতে অতিরিক্ত পরিশ্রমের ফলে হঠাৎ অসুস্থ হলেন। কিছুটা সুস্থ হওয়ার পরে এলেন দিল্লি রাজ্যসভার অধিবেশনে যোগদানের জন্য। বসন্তকুমার লোকসভায় আগের মতো সক্রিয়। তুলে ধরছেন সরকারের দুর্বলতা ও পরবর্তী পদক্ষেপ শত্রু মোকাবিলার জন্য। নিকুঞ্জবিহারীর রাজ্যসভায় উপস্থিতি স্বল্পকালীন। তিনি আক্রান্ত হলেন হৃদরোগে। খেজুরীর দুই জননেতার যৌথ কার্যক্রমের সম্ভাবনার শুরুতেই যবনিকা পতন। বিধি বাম। যৌথ উদ্যোগ অঙ্কুরিত হওয়ার পূর্বে মৃত্যুর ডঙ্কা। বিধিলিপির নির্দেশ অতিক্রম করা অসম্ভব। এই ক্ষেত্রেও তাই ঘটলো। তবে মনে রাখতে হবে, দুজনে কেন্দ্রে দিল্লিতে হলেও তাঁদের মেধা ও কর্মক্ষেত্রের কেন্দ্র আলাদা (লোকসভা ও রাজ্যসভা)। স্বাধীনতার পরবর্তী পর্যায়ে, তাঁদের রাজনৈতিক কর্মকেন্দ্রের ধারাবাহিক ভিন্নতা বুঝি বিধাতার অপূর্ব রচনা।



নিকুঞ্জবিহারী স্থানান্তরিত হলেন কলকাতায়। স্মৃতি হারানোর মাঝে রোগশয্যায় কাটলো কয়েক বছর। প্রয়াত হলেন ১৯৭০ সালের ১৯ শে মে। দেশবরেণ্য জননেতা চিরঘুমের দেশে। রেখে গেলেন কর্তব্যপরায়ণ দেশপ্রেমিক ও সফল রাজনীতিবিদের সমুজ্জ্বল জীবনের ছবি। আগামী প্রজন্মের কাছে হয়ে রইলো, গভীর প্রেরণার উৎস।


বয়ঃকনিষ্ঠ বসন্তকুমার যোগ্যতা ও কৃতিত্বের সঙ্গে পালন করলেন তৃতীয় লোকসভা সাংসদের ভূমিকা। শিক্ষা, কৃষি ও উদ্বাস্তু পুনর্বাসন— মূলত এই তিন বিষয়ে তাঁর বক্তব্য উচ্চকিত সংসদে। ইতিমধ্যে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে অভাবনীয় পরিবর্তন। কংগ্রেস ভেঙে বাংলা কংগ্রেসের আত্মপ্রকাশ তাঁর সহকর্মী ও বন্ধুবর মেদিনীপুরের অজয় মুখার্জীর নেতৃত্বে। যুক্ত ফ্রন্টের দ্বারা সরকার গঠন। ধীরে ধীরে সিপিএম-এর উত্থান। নানা রাজনৈতিক সমীকরণ। গোটা রাজ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা। বসন্তকুমারের সুচিন্তিত পদক্ষেপ। বুঝলেন প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে তাঁর বিদায়ের সময় আসন্ন। মনোনিবেশ করলেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস রচনায়। ১৯৭৫ সালে সহকর্মী ত্রৈলোক্য প্রধান মহাশয়ের অকুণ্ঠ সহযোগিতায় প্রকাশ করলেন স্বাধীনতা সংগ্রামে খেজুরীর ভূমিকার ওপর একটি বই। তাঁর প্রিয় মাস্টারমশাই নিকুঞ্জবিহারীর সংগ্রাম ও গঠনমূলক কাজের নানা দিক আলোচিত প্রাঞ্জলরূপে। অত্যুক্তি হবে না— এ যেন তাঁর শ্রদ্ধার্ঘ। পরবর্তী পর্যায়ে গঠন করলেন ‘মেদিনীপুর স্বাধীনতা সংগ্রাম ইতিহাস সমিতি’। এর কার্যকরী সভার অন্যতম সদস্যা হলেন নিকুঞ্জবিহারীর সুযোগ্যা কন্যা আভা মাইতি, যিনি হয়ে উঠেছিলেন ‘খেজুরীর অগ্নিকন্যা’। মাস্টারমশাই যেন কন্যার মধ্য দিয়ে জড়িয়ে রইলেন বসন্তকুমারের মহতী প্রয়াসের সাথে। ১৯৮০ সালে প্রকাশিত হল বসন্তকুমারের রচিত ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে মেদিনীপুর’ প্রথম খণ্ড। তখন তাঁর বয়স ৮২ বছর। এরপর ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে মেদিনীপুর’ দ্বিতীয় খণ্ড। ৮৬ বছরের বৃদ্ধের অদম্য প্রচেষ্টার ফসল। সেই বছর ডিসেম্বরে তৃতীয় খণ্ড রচনাকালে প্রয়াত হলেন। একটা যুগের অবসান। সাধারণ ব্যক্তির অনন্য সাধারণ হয়ে ওঠার অপূর্ব সংগ্রাম কাহিনি। খেজুরীর আর এক দেশপ্রেমিক কর্মযোগীর মহাপ্রয়াণ। ইতিহাস রইল সাক্ষী হয়ে।


খেজুরীর দুই অসামান্য জননেতার উত্থান প্রায় পাশাপাশি দুই গ্রাম থেকে মধ্যবিত্ত পরিবারে। নিজেদের মেধা, কর্মোদ্যম ও সততা এবং অহিংস আদর্শের প্রতি নিষ্ঠা— সব কিছু উৎসর্গ করেছেন দেশ-মায়ের বেদীতে। হয়েছেন তাঁরা কিংবদন্তী জননায়ক। পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনে অকুতোভয় সংগ্রাম, বারবার কারাবরণ, স্থির প্রতিজ্ঞ লক্ষ্যে, শেষে ভারতমুক্তি সূর্য বন্দনায় সফলতা। গভীর উপলব্ধি, স্বাধীনতা অর্জনের সাথে প্রয়োজন ভেদাভেদ শুন্য মুক্ত মনের সমাজ, তবেই সম্ভব জগৎসভায় স্বাধীন আলোকিত ভারতবর্ষ। জীবনভর তাঁদের সামাজিক ব্যাধি অস্পৃশ্যতা ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম। শিক্ষার অগ্রগতির জন্য নিকুঞ্জবিহারী ও বসন্তকুমারের নেতৃত্বে 'খেজুরী আদর্শ বিদ্যাপীঠ' (১৯৪৭), 'খেজুরী আদর্শ বালিকা বিদ্যাপীঠ' (১৯৬১) ও পরে 'আর্য তনয়া বালিকা বিদ্যালয়' স্থাপিত। তাছাড়া কাঁথি, রামনগর ও এগরা প্রভৃতি থানায় বিভিন্ন বিদ্যালয়ের প্রগতি ও অগ্রগতি তাঁর সভাপতিত্বে। নিকুঞ্জবিহারী পশ্চিমবঙ্গের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী। তাঁর স্বল্পকালীন মন্ত্রীত্বে শিক্ষা উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। গঠন করলেন শিক্ষাকর্মীদের সংঘবদ্ধ করার জন্য ‘প্রাথমিক শিক্ষা সমিতি’। প্রাথমিক শিক্ষা বিকাশে শিক্ষকগণের সমবেত প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে জরুরী। মাধ্যমিক শিক্ষা বিস্তারে শিক্ষানুরাগী অভিভাবকদের সহযোগিতা আহ্বান করেছেন। সেই উদ্দেশ্যে পশ্চিমবঙ্গের মাধ্যমিক শিক্ষা কমিশনের সম্পাদক অনাথনাথ বসু মহাশয়ের সহায়তা লাভ ছিল তাঁর প্রাথমিকতা। প্রসঙ্গত, অনাথনাথ মহাশয় বসন্তকুমারের বিশিষ্ট সুহৃদ। শিক্ষা প্রসঙ্গে নিকুঞ্জবিহারীর সুচিন্তিত দৃঢ় অভিমত— বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা সুনিশ্চিত করে শিক্ষার ভীত ও বুনিয়াদ। দুই জননেতার শিক্ষা উন্নয়নে ও প্রসারে প্রশংসনীয় ভূমিকার সুফল পরবর্তী প্রজন্ম যে লাভ করেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। খেজুরী এখন শিক্ষা উৎকর্ষতায় পূর্ব মেদিনীপুরে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছে। স্মরণ করা যায় এই প্রসঙ্গে, উভয়ের (বসন্তকুমার ও নিকুঞ্জবিহারী) সংগ্রামী জীবনের ধারাপাত সৃষ্টি মহান শিক্ষার আঙিনা থেকে।


দুই জননেতা : বসন্তকুমার ও মাস্টারমশাই নিকুঞ্জবিহারী মাইতি | Satish Chandra Samanta & Nikunja Bihari Maiti
বসন্তকুমার (দাস)

দুই জননেতার কর্মধারায় অন্তঃসলিলা সংযোগ। সৃষ্টি করেছে সহযোগিতার বাতাবরণ। ধরা পড়ে বিশেষ করে তাঁদের গঠনমূলক সমাজ উন্নয়নের কাজে। সমস্যা জর্জরিত বাঙালি উদ্বাস্তু পুনর্বাসনে তাঁরা ছিলেন একে অন্যের পরিপূরক। কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতার স্পর্ধা স্পর্শ করেনি তাঁদের। যদি কোনো প্রতিযোগিতা, তা কেবল দেশমাতৃকার মঙ্গলার্থে। বয়ঃকনিষ্ঠ বসন্তকুমারের অকুণ্ঠ ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা সর্বদা নিকুঞ্জবিহারীর প্রতি। কখনোই তিনি মাস্টারমশাই ছাড়া আর কোনোভাবে সম্বোধন করেননি। মন্ত্রী থাকাকালীন নিকুঞ্জবিহারীর কাঁথির আবাস ছিল থানা পুকুর পাড়ে। সম্মাননীয় কংগ্রেস কর্মী ও তৎকালীন এমএলএ সতীশ জানা মহাশয়ের বাড়ি। এমপি বসন্তকুমার (তাঁরও বাসা থানা পুকুর পাড়ে) যেতেন দেখা করতে মাস্টারমশাইয়ের সাথে। এর কোনো অন্যথা হত না। তিনি মাস্টারমশাইকে কতখানি শ্রদ্ধা করতেন তার একটা উদাহরণ অপ্রাসঙ্গিক হবে না। দক্ষিণ ২৪ পরগণার কাকদ্বীপে ১৯৫০ সালে কৃষি সংক্রান্ত সভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রফুল্লচন্দ্র সেন, বসন্তকুমার ও নিকুঞ্জবিহারী স্থির করলেন প্যান্ডেলে রাত কাটাবেন। বসন্তকুমার তাঁর মাস্টারমশাইয়ের জন্য খড় দিয়ে পুরু শয্যার ব্যবস্থায় হাত দিলেন। অভূতপূর্ব শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার নিদর্শন। মনে রাখতে হবে, দুজনে তখন বাংলা তথা ভারতের রাজনীতিতে সুপরিচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।


দেশমাতৃকার সেবায় তাঁরা উৎসর্গ করেছেন জীবনের সবকিছু। কোনো কুণ্ঠা বা দ্বিধা বা স্বার্থের এতটুকু ছোঁয়া ছিল না তাঁদের কর্মক্ষেত্রে। দেশসেবার প্রেরণাই তাঁদের রাজনীতির অভিমুখ। দেশপ্রেমের মন্ত্রে সিক্ত তাঁদের জীবন-যৌবন। আজকের দেনা-পাওনার, হিসেব-নিকেশের স্বার্থসর্বস্ব রাজনীতিতে এমন জননেতা অকল্পনীয় ও দুর্লভ। অনস্বীকার্য, তাঁদের প্রয়াণের এতকাল পরেও তাঁরা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। জনগণ শ্রদ্ধা সহকারে মর্মর মূর্তি স্থাপন ও উদ্বোধন করেছেন। আজকের অস্থির সময়ে আলোকিত ভারত গড়ার মহান কর্তব্যে ও স্বপ্নপূরণে প্রয়োজন দুই জননেতাকে গভীরভাবে অনুধাবন ও অনুশীলন। তাঁদের প্রদর্শিত আদর্শ ও সেবাধর্ম নবীন জীবনকে করুক উজ্জ্বীবিত। গভীর প্রত্যয় ও আশা— ভারত আবার জগৎসভায় সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত হবে।




M E D I N I K A T H A J O U R N A L

Edited by Arindam Bhowmik

Published on 20.07.2024


তথ্যসূত্র:

• ‘স্বাধীনতা সংগ্রামী জননায়ক বসন্তকুমার’— প্রফেসর ড. প্রকাশকান্তি দাস, প্রকাশক— প্রবাসী, খেজুরী, ২০২৩
• ‘মনীষী নিকুঞ্জবিহারী’— নগেন্দ্রনাথ বেরা, প্রকাশক— নেতাজী পাঠচক্র, দ্বিতীয় সংস্করণ, ২০২১
• ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে মেদিনীপুর’, প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড— বসন্তকুমার দাস, প্রকাশক— মেদিনীপুর স্বাধীনতা সংগ্রাম ইতিহাস সমিতি, ১৯৮০, ১৯৮৪
• ‘মেদিনীপুরে স্বাধীনতার গণসংগ্রাম’— বসন্তকুমার দাস, খেজুরী থানা, প্রথম প্রকাশ এপ্রিল ৬, ১৯৭৫
• ‘যুগান্তরের জীর্ণস্মৃতি’— বসন্তকুমার মাইতি, প্রথম প্রকাশ ২৬ শে জানুয়ারি, ২০০৫


নিচে কমেন্ট বক্সে আপনার মূল্যবান মতামত জানান।