সিঁদুর টিপ
সীমান্ত বাংলার গ্রামীণ খেলাধুলা - ১
Sindur (Vermilion) Tip - Rural sports in frontier Bengal
চিন্ময় দাশ।
Home » Medinikatha Journal » Chinmoy Das » Sindur (Vermilion) Tip
দ্বাদশ শতাব্দীর একেবারে গোড়ার দিক তখন। ওড়িশায় রাজা ছিলেন অনন্তবর্মণ চোড়গঙ্গদেব। তিনি মেদিনীপুর জেলার বিশাল অংশ অধিকার করে নিয়েছিলেন। বাংলা তথা মেদিনীপুর জেলার ভূমি ওড়িশার শাসকদের অধীনস্থ হওয়ার সেই সূচনা। এই অধীনতা পূর্ণতা পেয়েছিল ষোড়শ শতাব্দীতে পৌঁছে। পাঠান শাসক সোলেমান কররানির সাথে যুদ্ধে, রাজা হরিচন্দন মুকুন্দদেব নিহত হন। ইং ১৫৪৮ সালে, সোলেমানের সেনাপতি কালাপাহাড় ওড়িশা জয় করলে, মেদিনীপুর জেলা থেকে ওড়িশার রাজাদের শাসন অব্লুপ্ত হয়ে যায়।
সিঁদুর টিপ খেলার প্রচলন মেদিনীপুর জেলার মুখ্যত দক্ষিণ এলাকা জুড়ে। সুবর্ণরেখা নদীর বিস্তার এই এলাকায়। গোপীবল্লভপুর, বেলিয়াবেড়া, সাঁকরাইল, কেশিয়াড়ি, দাঁতন এবং নয়াগ্রাম থানাগুলির অবস্থান এই নদীর অববাহিকা জুড়ে। সমগ্র এলাকাটি প্রতিবেশী রাজ্য ওড়িশার সীমান্তলগ্ন। সেকারণে, ওড়িশার সামাজিক সংস্কৃতির গভীর প্রভাব এই এলাকা জুড়ে।
সিঁদুর টিপ - সীমান্ত বাংলার গ্রামীণ খেলাধুলা
সুবর্ণরেখা অববাহিকার বাইরে, জেলার অন্যত্র সিঁদুর টিপ খেলার প্রসার প্রায় দেখাই যায় না। সেকারণে, খেলাটিকে ‘ওড়িশা রাজ্য থেকে আগত’ আখ্যা দেওয়া অসঙ্গত হবে না বলেই আমাদের ধারণা।
সিঁদুর টিপ হোল প্রাঙ্গণের খেলা। মুখ্যত খোলা প্রাঙ্গণেই এটি খেলা হয়। আবার অঙ্গণ যদি প্রশস্ত হয়, সেখানেও এই খেলার আয়োজনে তেমন কোনও ব্যাঘাত হয় না। সাধারণভাবে শিশুবয়সীরাই এই খেলার আয়োজন করে। ছেলে এবং মেয়ে উভয়েই অংশগ্রহণ করে খেলাটিতে। খেলোয়াড়দের লিঙ্গবিচার নাই। তেমনই সংখ্যারও কোন নির্দিষ্টতা নাই। তবে, খেলোয়াড় অবশ্যই জোড় সংখ্যায় হতে হবে।
এটি দলবদ্ধ এবং গোষ্ঠীতে বিভক্ত খেলা। প্রথমেই খেলোয়াড়েরা দুটি দলে ভাগ হয়ে যাবে। প্রতি দলেই একজন নেতা বা দলপতি থাকবে। খেলার সময় তার নাম—‘গাছ’।
দুই দলনেতা তার দলের খেলোয়াড়দের প্রত্যেকের একটি করে নামকরণ করবে। নাম নির্বাচন করা হয় ফুল এবং ফল বিষয়ে। একটি দল নেবে ফুলের নাম। ফলের নামে অপর দলটির নামকরণ হবে। খেলা শুরুর আগে দুই দলনেতা তার দলের প্রত্যেকের কানে কানে একটি করে নাম জানিয়ে দেবে।
ধরা যাক, ১০ জন খেলাওয়াড় নিয়ে খেলা চ্ছে। প্রত্যেক দলে আছে ৫ জন খেলোয়াড়। ফুলের নাম পেয়েছে যারা, সেই দলের নেতা বা গাছ, তার ৪ জন খেলোয়াড়ের কানে কানে গোলাপ, গাঁদা, করবী এবং চাঁপা নামগুলি জানিয়ে দিল। ফলের নাম পাওয়া অন্য দলের নেতাও সেভাবেই আম, জাম, কঁঠাল, কলা নাম বলে দেবে। তখন থেকে প্রত্যেক খেলোয়াড় সেই ফুল বা ফলের নামেই পরিচিত থাকবে।
খেলার জন্য মোটামুটি বর্গাকার একটি স্থান বেছে নেওয়া হয়। মাঠটির মাঝ বরাবর একটি দাগ টেনে,, দুটি দলের জন্য এলাকা ভাগ করে দেওয়া হবে। এবার ঐ সীমানারেখা থেকে সমান দূরত্বে, দু’দিকে সমান্তরাল ভাবে দুটি দাগ টেনে দেওয়া হবে। সেই দুটি দাগের ওপর দুটি দলের খেলোয়াড়েরা বসবে।
খেলার সূচনা হবে এইভাবে ঃ যে কোনও এক পক্ষের দলনেতা, অন্য পক্ষের কোনও একজন খেলোয়াড়ের পিছনে গিয়ে দাঁড়াবে। দু’হাত বাড়িয়ে সেই খেলোয়াড়ের দু’চোখ চাপা দিয়ে, নিজের দলের একজন খেলোয়াড়কে ডাক দেবে—আয় তো আমার গাঁদা ফুল।
এবার গাঁদা ফুল নাম পাওয়া খেলোয়াড়, নিঃশব্দে পা টিপে টিপে এগিয়ে এসে, চোখ টিপে রাখা খেলোয়াড়ের কপালে টিপ পরাবার মত করে আঙুলের টোকা দেবে। তারপর তেমন ভাবেই নিঃসাড়ে নিজের জায়গার ফিরে গিয়ে বসে পড়বে।
এবার চোখ ছেড়ে দিয়ে, দলনেতা সেই খেলোয়াড়কে প্রশ্ন করবে—বল তো, কোন ফুলটি টিপ পরালো?
খেলোয়াড়টি তখন অন্য পক্ষের সব খেলোয়াড়ের চোখ-মুখের ভাবভঙ্গী পরখ করতে করতে অনুমান করবে, কে হতে পারে। এক সময় সে প্রতিপক্ষের কোনও একজন খেলোয়াড়কে আঙুল দেখিয়ে নির্দেশ করে বলবে—ঐ ফুলটি টিপ পরালো।
এই উত্তর সঠিক হতে পারে, ভুলও হতে পারে। যদি উত্তর সঠিক হয়, চোখ টিপে রাখা সেই খেলোয়াড়, পা দুটি জড়ো করে, নিজের দাগ থেকে যতটা সম্ভব জোরে লাফ দিয়ে তার সামনের মাঝের রেখাটির দিকে এগিয়ে গিয়ে বসে পড়বে।
কিন্তু উত্তর যদি ভুল হয়, তাহলে, টোকা মেরে যাওয়া খেলোয়াড়ের জিত হোল। সেও অনুরূপভাবে লাফ দিয়ে, নিজের জায়গা থেকে মাঝ বরাবর টানা রেখাটির দিকে এগিয়ে গিয়ে বসে পড়বে।
এবার অন্য পক্ষের দলনেতা গিয়ে প্রতিপক্ষের একজনের চোখ টিপে, নিজের দলের একজন খেলোয়াড়কে ডাকবে—আয় তো আমার আম? (কিংবা জাম বা অন্য কোনও ফলের নাম।) সেই খেলোয়াড় এসে টোকা মেরে ফিরে গিয়ে বসে পড়বে। চোখ খোলা হলে, সেই খেলোয়াড়কেও টোকা মারা খেলোয়াড়ের নাম বলতে হবে।
এই ভাবে খেলা চলতে চলতে যে দলের সব খেলোয়াড় প্রথমে মাঝখানের রেখায় পৌঁছতে পারবে, সেই দলের জিত হবে।
এক দান খেলা শেষ হবার পর, পরের দান শুরু করা হবে।
এই খেলায় একজন শিশু সাময়িকভাবে হলেও, কোণও একটা ফুল কিংবা ফলের নামে চিহ্নিত হয়। তার কারণে, সহজ সরল শিশুমন কল্পনার রাজ্যে ডানা মেলে বিচরণ করে বেড়াতে পারে। তেমনই অনুমান শক্তিরও বিকাশ হয় শিশুর। চোখ টেপা অবস্থায়, কোন শিশুটি এসে কপালে টিপ পরিয়ে গেল তাকে, বোঝার চেষ্টা করতে হয় তাকে। চোখ খোলার পর, প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের হাবভাব, মুখ-চোখের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে, অনুমান করতে হয় কোন খেলোয়াড়টি ভীড়ের মধ্যে বসে আছে।
এই খেলায় অংশগ্রহণের ফলে, আনন্দ উচ্ছাসের পাশাপাশি, মস্তিষ্কেরও বিকাশ হয় শিশুদের—এমনটাই অভিমত চিকিৎসাবিজ্ঞানী এবং শিশু মনস্তাত্ত্বিকদের।
M E D I N I K A T H A J O U R N A L
Edited by Arindam Bhowmik
(Published on 09.03.2025)
নিচে কমেন্ট বক্সে আপনার মূল্যবান মতামত জানান।