নবগ্রামের সিংহবাহিনীর মন্দির
Singhabahini Temple in Nabagram
উমাশংকর নিয়োগী।
Home » Medinikatha Journal » Umasankar Neogi » Singhabahini Temple in Nabagram
মেদিনীপুর জেলার একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধর্মীয় স্থাপত্য ঘাটাল থানার নবগ্রামের রায়দের পোড়া ইটে ও চুনসুরকি দিয়ে তৈরি গোপাল এবং সিংহবাহিনীর পঞ্চরত্ন পরিত্যক্ত মন্দির । পূর্বমুখী মন্দিরের সামনে দাঁড়ালে এখন থেকে তিনশো বছরেরও পূর্বে মন্দির প্রতিষ্ঠাতাদের রুচি, মন্দির নির্মাণ শিল্পীর টেরেকোটা অলংকরণের শৈল্পিক জাদু যে কোনো দর্শককে স্তব্ধ বিস্ময়ে বহুক্ষণ দাঁড় করিয়ে রেখে দেবে।
নবগ্রামের সিংহবাহিনীর মন্দির
ঘাটাল থেকে ঘাটাল চন্দ্রকোণা বাসরাস্তায় ১১ কিলমিটার এবং ক্ষীরপাই থেকে পাঁচ কিলমিটার দূরে নবগ্রাম। নবগ্রামে নেমে রায় পাড়া যাব বললে, সবাই দেখিয়ে দেবে। বাসরাস্তা থেকে উত্তর দিকে মিনিট দুয়েকের কংক্রিট রাস্তায় হেঁটে গেলে মন্দিরটি দেখতে পাওয়া যাবে ।
রায় পরিবারের সদস্য অসিত রায় জানালেন , তাঁদের পূর্বপুরুষের বড় কাঁসাপেতলের ব্যবসা ছিল। নবগ্রামের পাশ দিয়ে এক সময়ে প্রবাহিত হত রত্নাকর নদ। বর্তমানে যা প্রায় খালে রূপান্তরিত সেই নদেতে বর্ষাকালে হাজারমনি নৌকা আসত। রত্নাকর নদ থেকে শিলাবতী হয়ে জল পথে দেশে বিদেশে বহু জায়গায় পৌঁছে যেত রায়েদের কাঁসাপিতলের পণ্য সামগ্রী। ব্যবসা করেই এই পরিবার প্রভুত বিত্তের অধিকারী হয়। রায় পরিবারের সুখের দিনে পূর্বজরা গোপাল ও সিংহবাহিনীর মন্দির এবং শিবের মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কোনো এক সময়ে কাঁসাপেতলের পণ্য বোঝাই হাজারমনি নৌকা মালিক সহ বড় গাঙ্গে ডুবে যায়। দুর্দিন নেমে আসে পরিবারে। পরবর্তী কালে অর্থনৈতিক দিক থেকে সম্পুর্ণ বিধ্বস্ত পরিবারের উত্তরাধিকারীরা মন্দির দুটি সংরক্ষণের জন্য কিছু করে উঠতে পারেননি। ফলে শিব মন্দিরটি ধূলিস্যাৎ হয়ে গিয়েছে। কালের রক্তচক্ষুকে অবহেলা করে বহু টেরেকোটা ফলক , বেলে পাথরে খোদাই করা ফলক, প্রতিষ্ঠালিপি ও নক্সা সহ সিংহবাহিনীর মন্দিরটি আজও দাঁড়িয়ে আছে।
নবগ্রামের সিংহবাহিনীর মন্দির
মন্দিরটি উচ্চতায় প্রায় ৩২ ফুট, লম্বায় চওড়ায় ২০ ফুটের বেশি। তিনটি খিলান যুক্ত প্রবেশ দ্বারে আছে দুটি পূর্ণ স্তম্ভ ও দুটি অর্ধ স্তম্ভ । মন্দিরের সম্মুখ ভাগের দক্ষিণ প্রান্তে ও উত্তর প্রান্তে পাঁচটি করে আটটি স্তরে মোট ৮০ টি ফলক আছে , এগুলি সবই টেরেকোটা ফলক। দুটি অর্ধ স্তম্ভের পাশে একজোড়া করে দশটি স্তরে ৪০ টি ফলক আছে। এর মধ্যে বেশ কিছু ফলক হালকা নীল বেলে পাথরের উপর হুবহু টেরেকোটা ফলকের মত মূর্তি খোদাই করা আছে। টেরেকোটা ফলকের বেশ কিছু ফলক নষ্ট হওয়ার মুখে থাকলেও পাথরের ফলকগুলিতে বিন্দুমাত্র কালের ছাপ পড়েনি। তিনটি খিলানের মধ্যে থাকা টেরেকোটা ফলকগুলিকে ঘিরে আছে মোট ৪১ টি ফলক। উপর আর্চে দুটি স্তরে প্রতিটি স্তরে নয় জোড়া করে মোট ৩৬ টি ফলক আছে। এরও উপরে আছে দুটি ফলকে প্রতিষ্ঠালপি। এর একটি ফলক পাথরের। ক্ষেত্র সমীক্ষক তারাপদ সাঁতরা মন্দিরের প্রতিষ্ঠালিপির পাঠোদ্ধার করে লিখেছেন “ তিন লাইনে প্রতিষ্ঠালিপির পাঠ শকাব্দা ১৬৩১ শোল ষত ত্রোশ ষেষ শ্রীগোপালস্য অতএব মন্দিরটি ১৭০৯ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত। “ টেরেকোটা ফলকের মূর্তিগুলিতে দশাবতার , কৃষ্ণকাহিনি আছে , আছে জপমালা হাতে সাধু, মুদ্গর হাতে সৈন্য, পাদ্রীর মতো পোশাকে হাতে মালা মাথায় টুপি পরা সম্ভবত খ্রিস্টান পাদ্রীর ফলক অনেকগুলি আছে। সিদ্ধি ঘোটা , বিভিন্ন ভঙ্গিতে নর্তক নর্তকী , বাদ্যকর , সেতার বাদক , পতিব্রতা নারী স্বামীকে প্রণামরত পাশে দাঁড়ে বসা পাখি , দাঁড়ে বসা পাখিকে খেতে দেওয়া , সন্ধ্যাপ্রদীপ হাতে গৃহবধূ, শিব পূজা রত পুরোহিত ,ঝাঁজ ঘণ্টা বাজানো ভক্ত এমনি কতশত ফলক। দুটি করে ঘোড়ার কোথাও বা দুটি নারী মূর্তির উপর রচিত হয়েছে স্তম্ভের গোলাকার ও অর্ধবৃত্ত।
এখন থেকে প্রায় তিনশো ষোল বছর পূর্বে প্রতিষ্ঠিত মন্দিরটির পূর্ণস্তম্ভ দুটিতে মেঝে উপরেই থাকা ফলক বাদ দিয়েও বেষ্টন করে আছে দুটি স্তরে ফলক । অর্ধ স্তম্ভ দুটিতেও বহু ফলক আছে। থামেও হালকা নীল বেলে পাথরের ফলক আছে। স্তম্ভের ফলকগুলিতে যেমন সপরিবারে দুর্গা আছেন তেমনি কৃষ্ণ কাহিনিও স্থান পেয়েছে। একবারে মেঝে সংলগ্ন ফলকে গোপিনীদের বস্ত্র হরণ , পুতনা বধ , সৈন্যদের ফলক হোলি খেলা, সংকীর্তন ইত্যাদি আছে। উত্তর ও দক্ষিণ দিকের খিলানে আটটি করে এবং মুল প্রবেশ দ্বারের উপর দশটি শিবলিঙ্গ সহ পতাকা শোভিত মন্দির আছে। এই অংশে দেখা যাবে এক এলোকেশী ভূলুণ্ঠিত চুলের পূজারিণী ঘটি হাতে নিয়ে আটটি মন্দিরে শিবের মাথায় জল ঢালছেন। তারাপদ সাঁতরা মহাশয় পূজারিণীকে মন্দোদরী বলে উল্লেখ করেছেন।
নবগ্রামের সিংহবাহিনীর মন্দির
দক্ষিণ দিকের খিলানের উপর রাম লক্ষ্মণের বানর সেনা সহ কুম্ভকর্ণকে আক্রমণ , কুম্ভকর্ণের বানর সেনা ভক্ষণের ফলক আছে। উত্তর দিকের খিলানের উপর আছে বীরবাহুর সঙ্গে রামচন্দ্রের যুদ্ধের ফলক। মূল প্রবেশ দ্বারের উপরে আছে লঙ্কেশ্বর দশাননের সঙ্গে রাম ও লক্ষ্মণের যুদ্ধ। রামচন্দ্রের পাশে বিভীষণকে দেখা যাবে ।যুদ্ধক্ষত্রে রামচন্দ্রের পাশে তরবারি হাতে নিয়ে বিভীষণের উপস্থিতির ফলক ঘাটাল মহকুমার আর কোনো মন্দিরে নেই। রাম , লক্ষ্মণের ক্ষত্রিয়োচিত আকর্ণ লম্বিত সূচালো গোঁফ , আর রাক্ষসদের বীরাপ্পান গোঁফ। রামচন্দ্র ও রামানুজ তাঁদের ধনুতে এক সাথে তিনটি শর যোজনা করছেন ,এদের সাথে তরবারি নেই কেবল তূণ আছে। আর রাবণের ধনুতে একটিমাত্র শর, হাতে তরবারি । এক সাথে তিন শর নিক্ষেপের ফলক এই মন্দিরের অভিনবত্বের মধ্য একটি ।অন্য একটি বৈশিষ্ট্য শিল্পীর কল্পনায় বনবাসী রাম মকরমুখী দশচাকা যানে চড়ে যুদ্ধ করছেন আর লঙ্কেশ্বর রাবণ দাঁড়িয়ে আছেন মাটিতে। লক্ষ করলে দেখা যাবে অনার্যদের পা ঢাকা জুতো আছে কিন্তু রাম ও লক্ষ্মণ , বানর সেনা নগ্নপদ। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে আমাদের দেবতাদের মধ্যে কেবল দেবসেনাপতি কার্তিকের পায়ে জুতো আর কারো পায়ে জুতো নেই । নারদ ইত্যাদি ঋষির পায়ে বড় জোর খড়ম আছে । পা ঢাকা চামড়ার জুতো অনার্যদের আবিষ্কার বলেই মনে হয়।
গর্ভগৃহের প্রবেশদ্বারকে কেন্দ্র করে টেরেকোটার অনুরূপ বেলে পাথরের ফলক ও টেরেকোটা ফলক , পোড়ামাটির নক্সায় সজ্জিত আছে। জানিনা, গর্ভগৃহের পোড়া মাটির নক্সা ও ফলকগুলি তিনশো বছর আগে রঙ করা হয়েছিল কিনা! যদি তাই হয়ে থাকে , তাহলে আমাদের বিস্মিত হতে হবে এখনও সেই রঙের ঔজ্জ্বল্য দেখে। ফলকগুলির মধ্যে এক নগ্নিকা ও সাধুর ফলক পরপর দেখে মহন্তের কাহিনি বলে মনে হয়। রঙের ফলে ফলকের মূর্তি গুলির পরিচয় জানা কঠিন হয়ে গিয়েছে। মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশ দ্বারকে কেন্দ্র করে পঙ্খের কাজ ও পোড়া মাটির নক্সাগুলির জন্যই মন্দিরটি জাতীয় সংরক্ষণ যোগ্য হতে পারে।
নবগ্রামের সিংহবাহিনীর মন্দির
মন্দিরের উত্তর দেওয়ালে তিনিটি পঙ্খের কাজ করা নকল দরজা পোড়া মাটির নক্সায়ব সুসজ্জিত এছাড়াও বেশ কিছু পোড়ামাটির ফুলের ফলক আছে। দক্ষিণ দিকের দেওয়াল ভেঙে গিয়েছে অনুমান এখানেও অনুরূপ দরজা ছিল , মন্দিরের পশ্চিম দেওয়ালের প্রান্তদুটিও বহু দৃষ্টি নন্দন পোড়ামাটির নক্সায় সজ্জিত।
দাসপুরের সিংহ দের গোপীনাথের একরত্ন মন্দিরটি এই মন্দিরের নয় বছর পরে ১৭১৬ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত। নক্সা ও টেরেকোটা ফলক দেখে অনুমান করা যায় মন্দির দুটি একই ঘরানার, একই শিল্পীর হাতে সৃষ্টি। ঘাটাল মহকুমার অন্যতম পুরাতত্ত্ব নিদর্শন দুটি সর্বস্তরের অবহেলায় আজ ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। উত্তরাধিকারীদের অসামর্থ্য , জনতার ঔদাসিন্য , রাজনৈতিক দলগুলির পুরাবস্তু সম্পর্কে অনাগ্রহ আমাদের পূর্বপুরুষের রেখে যাওয়া মুল্য্যবান কীর্তি যা জগজনে দেখিয়ে গর্ব করার কথা তা আজ জঙ্গলে পূর্ণ পরিত্যক্ত মন্দির মাত্র।
M E D I N I K A T H A J O U R N A L
Edited by Arindam Bhowmik
(Published on 12.07.2025)
গ্রন্থ ঋণ -
রচনা সংগ্রহ তৃতীয় খণ্ড তারাপদ সাঁতরা
ঘাটালের কথা পঞ্চানন রায় কাব্যতীর্থ ও প্রণব রায়
সাহায্য পেয়েছি এঁদের কাছে -
অসিত রায়, সুকান্ত সিংহ
নিচে কমেন্ট বক্সে আপনার মূল্যবান মতামত জানান।