রত্নেশ্বরবাটি, Ratneshwarbati, Gajan, গাজন, Ghatal, ঘাটাল, হটনাগর, Medinipur, Midnapore

তিন মাসে তিন গাজন - আছে শালে ভর, গ্রাম - রত্নেশ্বরবাটি


Three Gajans in three months, village - Ratneshwarbati



উমাশংকর নিয়োগী।



Home » Medinikatha Journal » Umasankar Neogi » Three Gajans in three months, village - Ratneshwarbati


তিন মাসে তিন গাজন- আছে শালে ভর, রত্নেশ্বরবাটি হটনাগর। ঘাটাল শহর থেকে মাত্র ছয় কিলোমিটার দূরে ঘাটাল থানার অন্তর্গত রত্নেশ্বরবাটি গ্রাম। যাবার পথে মনোহরপুর বাজারে আছে ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত বুড়োশিবের আটচালা মন্দির , এ ছাড়া এখানে আছে ধর্মের চাঁদনি ও কালী মন্দির। বাজারের অদূরে রাস্তার পাশেই দালালদের মেজগিন্নীর দক্ষিণমুখী পরিত্যক্ত জীর্ণ সপ্তরেখ বুড়োশিবের মন্দির , বেশ কয়েকটি টেরেকোটা ফলক সহ শ্যামসুন্দরের নবরত্ন রাসমঞ্চ, পশ্চিমমুখী দুটি আটচালা শিবমন্দির সহ দ্বারপাল এখনো দাঁড়িয়ে এমন একটি আটচালা শিব মন্দির আছে। মনোহরপুরের পাশের গ্রাম রত্নেশ্বরবাটি। লোক মুখে প্রচলিত ছড়া, ‘কাঁঠাল, কাঁড়ার শিবশীতলা/ এদের নিয়ে মাড়োতলা’।মাড়োতলা তথা ‘হটনাগর’ শিবের মন্দির প্রাঙ্গণ পার্শ্বেই আছে রত্নেশ্বরবাটি দেশপ্রাণ প্রাথমিক বিদ্যালয় ও রত্নেশ্বরবাটি নেজাজী উচ্চ বিদ্যালয়। হটনাগর শিবের নবরেখ মন্দির আনুমানিক ত্রিশ ফুটের বেশি সুউচ্চ। মন্দিরের পশ্চিম দেওয়ালে একটি প্রতিষ্ঠালিপি ছিল। বিখ্যাত পুরাতত্ত্ব গবেষক তারাপদ সাঁতরা সেটি উদ্ধার করে অমরত্ব দান করেছেন। লিপিটি এই রকম “ চন্দ্রেষু মুনি সংখ্যাতে / শাকে চৈব নিশাপতৌঃ / মাঘস্য পঞ্চবিংশাহে আরম্ভোহস্য বভূবহ” লিপি দৃষ্টে সিদ্ধান্তে এসেছেন হটনাগর শিবের মন্দিরটি ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত। পঞ্চানন রায় কাব্যতীর্থ ও প্রণব রায় তাঁদের ‘ ঘাটালের কথা’ গ্রন্থে একই মত পোষণ করেছেন। মন্দিরটি অতি সম্প্রতি সংস্কার হয়েছে। মিথুন ফলক সহ বেশ কয়েকটি ফলক ও প্রতিষ্ঠা লিপিটি মন্দিরগাত্র থেকে জীর্ণতার কারণে ভেঙে ফেলা হয়েছে। দক্ষিণ দিকের রামরাজা ও পূর্বদিকের গোপিনীদের বস্ত্রহরণ পুরোনো এই দুটি পঙখ ফলক ছাড়া আর কিছুই নেই। পশ্চিম দিকের মূল দরজা ছাড়াও দক্ষিণ দিকে একটি দরজা আছে। পশ্চিমদিকে আছে প্রশস্ত পাকা আটচালা। মাড়োতলায় হটনাগর শিবের আটচালার পশ্চিম প্রান্তে আছে ধর্মরাজের চাঁদনি মন্দির , উত্তরপূর্বে শীতলা মন্দির আর দক্ষিণ দিকে আছে একটি অতি প্রাচীন ইঁটে নির্মিত ওলাবিবির মাজার নামে পরিচিত গম্বুজযুক্ত মন্দির।যার অনেকটাই মাটিতে ঢাকা পড়ে গিয়েছে। মাথাটা অনেকটা ক্ষুদ্রাকৃতি সাঁচি স্তুপের মতো। স্তপটি ওলাবিবির না বৌদ্ধস্তুপ তা নিয়ে গবেষকরা ভেবে দেখতে পারেন। মকর সংক্রান্তির দিন হিন্দু পুণ্যার্থীরা শিব মন্দির, ধর্ম মন্দির এবং শীতলা মন্দিরে পুজো দেবার সময় এখানেও পুজো দেন। পুজোর সামগ্রী নিয়ে যান ঘাটালের জনৈক সেখ আবদুল। হটনাগর শব্দের আক্ষরিক অর্থ হটযোগের নায়ক , হটানোর নায়ক। রত্নেশ্বরবাটি গ্রামে ইসলাম ধর্মাবলম্বী কোনো পরিবারের বসবাস নেই অথচ ওলাবিবির অবস্থান! তাহলে কি এখানে এককালে মুসলমানদের বসতি ছিল ? নাকি সামনের ধর্ম ঠাকুরের প্রতিপত্তি খর্ব করে শিব মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ! গাজন, পশুবলি ,( মাগুর মাছ কাটা ?) শালে ভর , বাণ ফোঁড়া, বৈশাখী উৎসব সবই কিন্তু ধর্ম ঠাকুরকে কেন্দ্র করে এক সময়ে হত।


রত্নেশ্বরবাটি, Ratneshwarbati, Gajan, গাজন, Ghatal, ঘাটাল, হটনাগর, Medinipur, Midnapore
তিন মাসে তিন গাজন - আছে শালে ভর, গ্রাম - রত্নেশ্বরবাটি

এই মন্দিরে পুরুষানুক্রমে পৌরোহিত্য করে আসছেন হটনাগরের সেবাইত গোপমহল গ্রামের গোবিন্দ চক্রবর্তীর বংশধর দয়ানন্দ , হিরণ্ময় চক্রবর্তীরা। সেবাইতদের দাবি মতো প্রায় তিন শতাধিক বছরের প্রাচীন দারুলিঙ্গ হটনাগর পাথরের শক্তি দ্বারা বেষ্টিত। বাবা শিবের বৈশাখী গাজন, সাত ভোগের মাড়ো। গাজনের সময় এখোগুড় দিয়ে শিবলিঙ্গ মার্জন করা হয়। গুড় আসে কমলকৃষ্ণ সাউদের পরিবার থেকে। ৪০-৫০ জন ভক্তা থাকেন। দুর্গাঘট হাইস্কুলের ওপাশে থাকা শিবপুকুর থেকে ভোরবেলা ডোবানো হয়। ভোগ মুদা চালে ভোগ রান্না করে বাবাকে সামান্য নিবেদন করে জলে দেওয়ার নিয়ম। অবশিষ্টাংশ ঢাকি বা ডোমেরা নিয়ে যায়। কেউ শিবের অন্নপ্রসাদ গ্রহণ করেন না। অন্যান্য মন্দিরেব গাজনের মতো হিঁদোলা , ধুনো সেবা, মাথা চালা , বেত চালা ইত্যাদি এবং গুড়ান ভোগের দিন কাঁটা ভাঙা , কাঁটা গড়ানো হয়ে থাকে। মেল পুজোর দিন পাঁচশতাধিক মানুষ জল ঢালেন। বৈশাখী সংক্রান্তির দিন চড়ক হয়। পূর্বে চড়কের দিন বাণফোঁড়া হত বর্তমানে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। হটনাগর শিবের গাজনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য সংক্রান্তির দিনে ‘ শালে ভর’ যা আশেপাশে কোথাও হয় না। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তী কালে বিষ্ণুপদ শাসমলের ব্যবস্থাপনায় প্রচলিত শালে ভর হল ধারালো পাঁচটি ক্ষুরধার খড়্গের উপর ভক্তাদের শুয়ে থাকা। মৃতদেহ বহনের খাটুলির মতো খাটুলি তৈরি করে পূর্ব রাত্রে পুজো করে রাখা শাণিত খড়গগুলিকে বিচেকলা গাছের সাহায্যে সমান ভাবে শক্ত করে খাটুলির সাথ বাঁধা হয়। সুদীর্ঘকাল এই দায়িত্ব পালন করে আসছেন এই গ্রামের শাসমল ও কাঁঠাল পরিবারের সদস্যরা। মূল ভক্তা বা পাটভক্তা প্রথমে শালে ভর করেন অর্থাৎ শাণিত খড়্গের উপর শুয়ে পড়েন, তাকে গামছা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় । অন্যান্য ভক্তারা শালে ভর করা পাট ভক্তাসহ খাটুলি কাঁধে তুলে নিয়ে নৃত্য করতে করতে শিব মন্দির প্রদক্ষিণ করেন। পরে তাকে শিব মন্দিরের ভেততে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। তিনি অক্ষত অবস্থায় বাইরে চলে এলে অন্য ভক্তারা শালে ভর করেন। এক সময়ে পাঁচু পাল , করালী কাণ্ডার পাট ভক্তা হতেন। এখন প্রভাস কাণ্ডার পাটভক্তা হন। তিনি দীর্ঘদিন প্রথমে শালে ভর দিয়ে আসছেন । শালে ভরের উল্লেখ পাওয়া যায় রূপরাম চক্রবর্তীর ধর্ম মঙ্গল কাব্যে’ (,রচনা কাল ১৫৯০ খ্রিস্টাব্দ) । লাউসেনের মা রঞ্জাবতী শালে ভর করেছিলেন ‘” শালে ভর দিয়ে তুমি বড় পাইলে দুখ / ব্যাকুল হয়েছে মন দেখ পুত্রমুখ।“ লাউসেনও শালে ভর দিয়ে নিজের দেহকে নয়খণ্ড করেছিলেন।



রত্নেশ্বরবাটি গ্রামের উত্তর প্রান্তে মাঝপাড়া ও কাঁড়ার পাড়ার মাঝে অতি প্রাচীন বটগাছের নীচে অবস্থিত রামেশ্বর নামে এক পিতলের শিবলিঙ্গ ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে একটি ছোট দেবালয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। সেবাইত নিযুক্ত হয়েছিলেন অনাথতারণ চক্রবর্তী। বালক ভক্তাদের নিয়ে রামেশ্বরের চৈত্র মাসে গাজনের শুরু হয়। অতি সম্প্রতি দক্ষিণমুখী রামেশ্বর শিব মন্দির ও লাগোয়া নবগ্রহের মন্দির নবরূপে নির্মিত হয়েছে। সামনেই একটি আটচালা আছে। ২৫-৩০ জন নারীপুরুষ নির্বিশেষে ভক্তা তথা সন্ন্যাসী গাজনে অংশ গ্রহণ করে থাকেন। সামনে থাকা প্রায় মজে আসা পুকুরটি শিব পুকুর। এখান থেকেই পাঁচ ভোগের মাড়ো রামেশ্বরের গাজন ওঠে। গুড়ান ভোগের দিন বিকেল বেলায় সন্ন্যাসীরা কুলডাল ভেঙে আনেন , রাত্রিতে কাঁটা গড়ানো হয়। হিঁদোলা, বেত চালা , মাথা চালা, ধুনোসেবা হয়। সংক্রান্তির দিন চড়ক হয়। পাটভক্তা বা মূল ভক্তা পরিবার ভিত্তিক হয় না। অন্যান্য নিয়ম আর পাঁচটা শিব মন্দিরের মতোই। মেলের দিন পাঁচশতাধিক ভক্ত শিবের মাথায় জল ঢেলে থাকেন। এই দিন রূপনারায়ণ নদ থেকে ভারে করে জল নিয়ে এসে অনেকেই শিবের মাথায় ঢালেন। পুরোহিত চিন্ময় চক্রবর্তীরা গাজন সম্পর্কীয় সমস্ত ধর্মীয় আচার পরিচালনা করেন।


রত্নেশ্বরবাটি, Ratneshwarbati, Gajan, গাজন, Ghatal, ঘাটাল, হটনাগর, Medinipur, Midnapore
তিন মাসে তিন গাজন - আছে শালে ভর, গ্রাম - রত্নেশ্বরবাটি

গ্রামের পূর্ব প্রান্তে যুধিষ্ঠির মেটে প্রভৃতির পূর্বপুরুষের পাওয়া কাশীশ্বর ও কুশেশ্বর শিবদ্বয় বর্তমানে দক্ষিণমুখী জোড়া আটচালা শিব মন্দিরে অবস্থান করছেন।মন্দিরে কোনো প্রতিষ্ঠালিপি নেই। লোকমুখে প্রচলিত ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে, ১৩০৫ সালে দাসপাড়ার চণ্ডী দাসের নেতৃত্বে এই মন্দির দুটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মন্দিরের দক্ষিণ দিকে আটচালা ও বারোয়ারি কালীমন্দির। শিবরাত্রির পর দিন এখানে সাড়ম্বরে মায়ের পূজা হয়। পূর্বদিকে বড় শিবপুকুর। প্রচলিত কাহিনি , - এই মাড়ো রাখাল মাড়ো নামে পরিচিত। এককালে শিব পুকুর পাড়ে গভীর বন ছিল। এক শিব ছিলেন কাশ বনে আর একজন ছিলেন কুশ বনে।রাখালদের ছেড়ে রাখা এক সাদা গোরু প্রতিদিন গিয়ে দুধ দিয়ে আসতো। গোরুকে অনুসরণ করে গিয়ে রাখালরা এই দুই শিবকে দেখতে পায়। রাখাল দলে যুধিষ্ঠির মেটের পূর্বপুরুষ ছিলেন। এই পরিবারের লোকেরাই এখনো প্রধান ভক্তা হয়ে থাকেন। কাশীশ্বর শিবটি মাকড়া পাথরের খানিকটা গাছতলায় থাকা ষষ্ঠী ঠাকুরের মতো দেখতে। কুশেশ্বর সাধারণ শিবলিঙ্গের মতো। কাশীশ্বর ও কুশেশ্বরের গাজন জ্যৈষ্ঠ মাসে অনুষ্ঠিত হয়। মেটে পরিবারের মূল ভক্তা সহ নয় নয় করে ৫০-৬০ জন সন্ন্যাসী থাকেন গাজনে। এখানকার গাজন দেড়শো দুশো বছর পূর্ব থেকে চলে আসছে। এটি সাত ভোগের মাড়ো । গুড়ান ভোগের দিন কাঁটা গড়ানো হয়। মেলের দিন সর্বাধিক ভক্ত সমাগম ঘটে মন্দির প্রাঙ্গণে। প্রায় হাজার চারেক ভক্ত এদিন শিবের মাথায় জল ঢালেন। ভক্তদের বিশ্বাস কাশীশ্বরে মেলের দিন জলঢালার মানত করলে যেকোন কাশি ভাল হয়ে যায়। গাজনে চড়ক হয়। চড়ক শিব পুকুরে সারা বছর ডুবিয়ে রাখা হয়। প্রথম দিকে মন্দিরের পৌরোহিত্য করতেন সন্ধি ভট্টাচার্য ও তাঁর বংশধররা বর্তমানে পৌরোহিত্য করছেন হরিসাধন চক্রবর্তীর বংশধরেরা।




M E D I N I K A T H A J O U R N A L

Edited by Arindam Bhowmik

(Published on 14.04.2025)


তথ্যসূত্র -

রত্নেশ্বরবাটি হটনাগর তথ্য ঋণ: দয়াময় চক্রবর্তী, কমলকৃষ্ণ সাউ, অবনী মেটে, উজ্জ্বল চক্রবর্তী।
গ্রন্থ ঋণ: রচনা সংগ্রহ তৃতীয় খণ্ড - তারাপদ সাঁতরা, রত্নেশ্বরবাটী মা আমার - অজিত কুমার কাণ্ডার।
রামেশ্বর শিবলিঙ্গ তথ্য ঋণ: অবনী মেটে, বিট্টু মেটে, চিন্ময় চক্রবর্তী।
কাশীশ্বর ও কুশেশ্বর শিবদ্বয় তথ্য ঋণ: অজিত সাঁতরা, রবীন্দ্রনাথ সাঁতরা, দয়াময় চক্রবর্তী, উজ্জ্বল চক্রবর্তী।


নিচে কমেন্ট বক্সে আপনার মূল্যবান মতামত জানান।