রাকেশ সিংহ দেব।
Home » Medinikatha Journal » Rakesh Singha Dev » Common Krait of Medinipur
২০১২ সাল। কয়েক বছর হল প্রাথমিক শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছি পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার শালবনি ব্লকের এক প্রত্যন্ত গ্রামে। আজন্ম এই এলাকার ছেলে হওয়ায় অচিরেই সখ্যতা গড়ে উঠলো গ্রামের মানুষদের সাথে। লক্ষ্য করেছিলাম উপজাতি অধ্যুষিত গ্রামের অধিকাংশ পরিবারেই থাকার মতো উপযুক্ত ঘরের অভাব রয়েছে। গ্রামের অনেকেই রাতে পাড়ায় যাদের একটু বড় ভালো মাটির বাড়ি রয়েছে সেখানে শুতে যেত। সেই রাতেও পাশের বাড়িতে বিছানায় নিয়ে শুতে গিয়েছিল আমার স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রী বছর বারোর পূজা দুলে। পরেরদিন সকাল থেকেই তার শরীর খারাপ হতে থাকে। মাথা ঘোরা, গা হাতের ব্যথা, বমি ভাব, পেটের যন্ত্রণার মতো উপসর্গ দেখা দেয়। বাড়িতে মাতাল বাবা সংসার সম্পর্কে উদাসীন। মা স্কুলের স্ব-সহায়ক দলের সদস্যা। তারা কেউ বুঝতেই পারেনি কি হয়েছে! বেলা যত বাড়তে থাকে প্রাণচঞ্চল মেয়েটি ততই নেতিয়ে পড়তে থাকে। এরপর পাড়ার কয়েকজন তাকে শালবনি হাসপাতলে নিয়ে যায়। সেদিন ছিল শনিবার। সোমবার যথারীতি স্কুলে গিয়ে বাচ্চাদের থমথমে মুখ দেখে প্রশ্ন করে জানতে পারি পূজা আর নেই! অথচ ঘটনার দিল সকালেও সে স্কুলে এসেছিল মিড-ডে মিলের কাজে মাকে সাহায্য করতে। স্থানীয় কয়েকজনের সাথে কথা বলে নিশ্চিত হই সেই কালরাতে মশারী ছাড়া মেঝেতে ঘুমোনো পূজাকে খেয়েছিল কালান্তক কালাচ! আমার জানা এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার খলনায়ক কালাচ। রহস্যময় এই সাপের দংশনই সেদিন পূজার পেটে ব্যথা, চোখের পাতা পড়ে আসার মতো স্নায়ুবিষের উপসর্গ তৈরি করেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেসময় এই উপসর্গগুলি সাপের কামড় বলে কেউ ভাবেনি।
সাধারণত বর্ষাকালেই সাপের উপদ্রব বাড়ে কারন সেসময় অধিকাংশ সাপেরই প্রজনন মরসুম। তবে বর্তমান সময়ে প্রাকৃতিক ভারসাম্য যেভাবে নষ্ট হচ্ছে তাতে যে কোনও মরসুমেই জনবসতি এলাকায় বেরিয়ে পড়ছে সাপেরা। আমাদের রাজ্যে যে সকল বিষধর সাপের দেখা মেলে তাদের মধ্যে রহস্যময় এবং তীব্র বিষধর সাপ কালাচ ! কালাচের নাম শুনলেই লোকজন ভুরু কোঁচকান। আসলে বিষধর সাপের যে এলিট ক্লাস, তার মধ্যে এই সাপের নামটি তেমন প্রচলিত নয়। অথচ এদের বিষ কিন্তু শঙ্খচূড়, কেউটে বা অন্য বিষধর সাপের থেকে বেশি তীব্র। কিন্তু তবু, কালাচের ইমেজ আমজনতার কাছে অতটা ভীতিপ্রদ নয়। তার কারণ, এদের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য এমনই যেটা অন্য বিষধর সাপেদের সঙ্গে মেলে না। প্রথম কথা, এই সাপ ফণাহীন। দ্বিতীয়ত, এই সাপ কামড়ালে ব্যথা হয় না। জায়গাটা ফোলেও না। ফলে যাকে কালাচ সাপে কামড়াল সে বুঝতেও পারে না। অথচ আস্তে আস্তে নার্ভবিষের লক্ষণগুলি দেখা যায়। আর এইখানেই শুরু হয় গণ্ডগোল। ডাক্তারবাবুদের পক্ষে রোগীর বাড়ির লোককে বোঝানোই কঠিন হয়ে যায়, আপনাদের রোগীকে সাপে কামড়েছে। তার ওপর ‘কালাচ’ নামটাও বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন নামে পরিচিত। ফলে তারা চিকিৎসকের কথায় আগাগোড়া অবিশ্বাস করার সুযোগ পেয়ে যায়। উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলা বাদ দিয়ে সারা বাংলা জুড়ে কালাচের অবাধ উপস্থিতি তাই জেলাভেদে এর নানা নাম - নিয়রচাঁদা, কালাচ, কালাজ, শিয়রচাঁদা, কালচিতি, শাঁখাচিতি, ডোমনাচিতি, চামরকোষা, ঘামচাটা ইত্যাদি। কালাচের ইংরেজি নাম Common Krait, Indian Krait, Blue Krait । বৈজ্ঞানিক নাম - Bungarus caeruleus।
কালাচ সাপ সহজেই চেনা যায় এদের মাথা আঙুরের মতো লম্বাটে গোলাকার। সম্পূর্ণ কালো অক্ষিগোলক। মাথার একটু দূর থেকে লেজের শেষপ্রান্ত পর্যন্ত গোলাকার সাদা দাগ থাকে। এই কারণে মেদিনীপুর এর মানুষ একে শাঁখাচিতি বলে থাকে। কিন্তু যদি এই কালো কালাচের শরীর হয় ধবধবে সাদা আর গায়ে যদি দাগ না থাকে তাহলে? এমনই সাদা কালাচ বা ডোমনাচিতি বিভিন্ন সময়ে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা থেকে উদ্ধার হয়েছে।
২০১৭ সালে পশ্চিম মেদিনীপুরের সবং থেকে রাজ্যে প্রথম এই ধরনের শ্বেত কালাচ উদ্ধার করেন জেলার সর্পপ্রেমী ও পরিবেশ কর্মী কৌস্তভ চক্রবর্তী। যা পরবর্তীতে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের প্রথম শ্বেতবর্ণ কালাচ হিসেবে সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত হয়। সম্প্রতি ২০২০ সালের জুলাই মাসে পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলা থেকে এরকম আরেকটি শ্বেত বর্ণের কালাচ উদ্ধার করেন মেদিনীপুর শহরের সর্পপ্রেমী ও পরিবেশকর্মী দেবরাজ চক্রবর্তী। কালাচের এইরূপ সাদা রঙ হওয়া যথেষ্ট বিরল। এই ধরনের পরিবর্তনকে লিউসিস্টিক (Leucistic) পরিবর্তন বলা হয়। সাপের ত্বকের রঙ নির্ধারণকারী জিনের অস্বাভাবিক ঘাটতি থাকলে গায়ের রঙ এমন হয়। জিনঘটিত এই পরিনর্তনের ফলে সাপের গায়ের রঙ সাদা হয়ে যায় কিন্তু এতে চোখের অক্ষিগোলকের স্বাভাবিক রঙের পরিবর্তন হয়না। তবে এটি কালাচের নতুন কোনও প্রজাতি কিনা সেবিষয়ে গবেষণা চলছে। কালাচ বা কালচিতি ছোট ছোট ব্যাং, ইঁদুর ও কীটপতঙ্গ খেয়ে দিন যাপন করে থাকে৷ তাই বর্ষাকাল ও গরমকালে এই ধরণের প্রানীর ঘরে আনাগোনার ফলেই এই সাপটিকে বাড়ির আনাচে কানাচে খাদ্যের জোগাড়ে ঘুরতে দেখতে পাওয়া যায়৷ এসময় কালাচের হাত থেকে বাঁচতে সবার প্রথমে দু’টি জিনিস করতে হবে। এক, সবসময় বিছানা ঝেড়ে মশারি টাঙিয়ে ঘুমাতে হবে। দুই, বাড়িতে থাকা ইঁদুরের গর্ত বুজিয়ে ফেলতে হবে। বাড়ির আশপাশের ঝোপঝাড় পরিষ্কার রাখতে হবে।
● কালাচ সাপ রাতে ঘুমন্ত মানুষের রক্ত চুষে খায়।
● কালাচ সাপ রাতে ঘুমন্ত মানুষের ঘাম চেটে খায় । তাই অনেক জায়গায় এদের নাম ঘামচাটা।
জেনে রাখুন এই ধরনের ঘটনার কোনও বিজ্ঞানসম্মত তথ্যপ্রমাণ নেই। কালাচ সাপ নিশাচর। গভীর রাতে খাবারের সন্ধানে এরা বাড়িতে ঢোকে। মশারি ছাড়া মেঝেতে ঘুমানো মানুষের হাত পা এদের গায়ে লাগলে এরা কামড় দেয়।
এই সাপ দংশন করলে ওঝা গুনীনের বুজরুকিতে সময় নষ্ট না করে তাকে যত দ্রুত সম্ভব সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। সাপের কামড়ের আধুনিক এবং একমাত্র ওষুধ ANTI VENOM SERUM যত দ্রুত রোগীর শরীরে প্রবেশ করানো যাবে তত বাড়বে রোগীর সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা। কালাচের কামড়ে রোগীর তীব্র শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে তাই রোগীকে সবসময় এমন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিৎ যেখানে ভেন্টিলেশন এর সুব্যবস্থা রয়েছে। ডাক্তারবাবু কালাচের কামড়ের উপসর্গ দেখে চিকিৎসা করেন তাই রোগীর সাথে সাপ নিয়ে আসবার কোনও প্রয়োজন নেই।
বাংলায় একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদ রয়েছে "কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা"। প্রকৃতি তার নিজস্ব নিয়মে কোনও প্রজাতির অত্যধিক সংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। আজ রাজ্যজুড়ে কালান্তক কালাচের বাড়বাড়ন্তের পেছনে রয়েছে প্রকৃতি নির্ধারিত নিয়ন্ত্রণের উপায় মানব হস্তক্ষেপ। বছর দশেক আগেও আমাদের রাজ্যের জলাভূমি, ঝোপঝাড়, বাঁশবন, এমনকি বাড়ির চারপাশে অবাধে ঘুরে বেড়াত বন বিড়াল, নেউল ও গোসাপের মত সর্পভুক প্রাণীরা। কালাচ সহ অন্যান্য বিষধর সাপ থাকত এদের নিয়মিত খাদ্য তালিকায়। কিন্তু দ্রুত বাসস্থানের সংকোচন এবং অবৈধ শিকারের ফলে এই সমস্ত প্রাণীরা আজ কোনঠাসা। এদের সংখ্যা দ্রুতহারে কমছে, এর ফলে তরতরিয়ে বাড়ছে সাপের বংশবিস্তার। উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলা বাদ দিলে সারা পশ্চিমবঙ্গ জুড়েই আজ কালাচের সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে।
কালাচের সংখ্যার প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রক হিসেবে সবচেয়ে পরিচিত হল শাঁখামুটি। সর্পভুক শাঁখামুটি বা ব্যান্ডেড ক্রেইট এর খাদ্যতালিকার প্রধান উৎস হলো বিভিন্ন সাপ। অত্যন্ত বিষধর কিন্তু স্বভাব লাজুক এই সাপ মানুষের সংস্রব এড়িয়ে চলতেই পছন্দ করে। শাঁখামুটির প্রিয় খাবার কালাচ ও তার বাচ্চা। স্বাভাবিকভাবেই যেখানে শাঁখামুটির সংখ্যা বাড়বে, সেখানে কালাচের সংখ্যা তত কমবে এটাই প্রাকৃতিক নিয়ম। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে শাঁখামুটি দেখলেই আতঙ্কগ্রস্ত মানুষ তাদের মেরে ফেলছে। "কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা"-র যে নিয়ম প্রকৃতি নিজেই করে দিয়েছিল, মানুষ নিজের অপরিণামদর্শিতার ফলে তা নষ্ট করে আজ খেসারত দিচ্ছে। আটকানো যাচ্ছেনা বিষধর কালাচের বাড়বাড়ন্ত। শাঁখামুটির মত বন্ধু সাপ মেরে কালাচের সংখ্যা বাড়িয়ে মানুষ নিজেরাই নিজেদের বিপদ ডেকে আনছে, আজ সময় এসেছে সেটা বোঝার।
সাধারন বাংলা নাম – নিয়রচাঁদা, কালাচ, কালাজ, শিয়রচাঁদা, কালচিতি, শাঁখাচিতি, ডোমনাচিতি, চামরকোষা, ঘামচাটা ইত্যাদি।
ইংরেজি নাম – Common Krait, Indian Krait, Blue Krait
বৈজ্ঞানিক নাম - Bungarus caeruleus (Schneider, 1801)
আয়তন – ৩৯ ইঞ্চি থেকে ৭০ ইঞ্চি ।
চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য – নিশাচর। দিনের বেলায় চুপচাপ থাকে। গভীর রাতে সক্রিয় হয়ে ওঠে।
প্রজনন – ডিম পাড়ে।
বিষের প্রকৃতি – তীব্র স্নায়ুবিষ বা নিউরোটক্সিন।
বিষের লক্ষণ – কামড়ে কোনও জ্বালা যন্ত্রণা হয়না। স্নায়ুবিষের প্রভাবে গায়ে হাতে ব্যাথা হয়। গাঁটে ব্যাথা। মাথা ঘোরা। বমি ভাব। তলপেটে ব্যাথা। চোখের পাতা পড়ে আসা বা শিবনেত্র। মুখ সম্পূর্ণভাবে না খুলতে পারা। শ্বাসকষ্ট।
সংরক্ষণ – তফশিল ৪ (Wildlife Protection Act 1972)
মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর এলাকার জন্য - দেবরাজ চক্রবর্তী (যোগাযোগঃ ৮৯৭২১৭৪০৯৩)
খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর এলাকার জন্য - কৌস্তভ চক্রবর্তী (যোগাযোগঃ ৯৪৭৫৫৯৯৩২২)
ঘাটাল, পশ্চিম মেদিনীপুর এলাকার জন্য – মেহেবুব আলম (যোগাযোগঃ ৯৪৭৪৬২৩৬২০/৯৭৩৫৭৩৮৫৩৩)
ঘাটাল, পশ্চিম মেদিনীপুর (দাসপুর) এলাকার জন্য – গৌর মাজী (যোগাযোগঃ ৯৬০৯১১৯১১৪)
ঘাটাল, পশ্চিম মেদিনীপুর (ক্ষীরপাই) এলাকার জন্য – মলয় ঘোষ (যোগাযোগঃ ৯৬৩৫৯৩৫০২৮)
রামনগর, পূর্ব মেদিনীপুর এলাকার জন্য – উমেশ গুঁই (যোগাযোগঃ ৯৮০০৮০০৫৮৯)
এগরা, পূর্ব মেদিনীপুর এলাকার জন্য – অর্ধেন্দু দাস মহাপাত্র (যোগাযোগঃ ৭৫৫১০০৭৩৩৬/৭৯০৮৫১৩৪৯৬)
পটাশপুর/এগরা, পূর্ব মেদিনীপুর এলাকার জন্য – সোমনাথ দাস অধিকারী (যোগাযোগঃ ৯৭৩৫২০৩৬২৪)
midnapore.in