দারিদ্রকে সঙ্গী করেই তাঁর বেড়ে ওঠা। উপরিপাওনা হিসেবে ঘরে-বাইরে প্রতিনিয়ত শুনতে হত এইসব কথা। তবে কোন কথাই তাঁর মনোবল ভাঙতে পারেনি। কারণ তাঁর কানে এইসব কিছুই ঢুকতো না। তাঁর কানে ধ্বনিত হত স্বামী বিবেকানন্দের সেই বাণী - "Arise awake and stop not till the goal is reached."
সেই দেখতে বাজে, কালো মেয়েটাই আমাদের আজকের "মেদিনীআচার্য", আমাদের গর্ব। সমাজের কাছে, দেশের কাছে তিনি এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাঁর একার চেষ্টায় আর্থিক ভাবে পিছিয়ে থাকা ছেলেমেয়েরা জীবনকে নতুন ভাবে দেখতে শিখেছে। সেইসব ছেলেমেয়েদের তিনি শিখিয়েছেন জীবনের নতুন মন্ত্র।
প্রীতিকণা জানা-র জন্ম পূর্ব মেদিনীপুর জেলার, খেজুরী থানার অন্তর্গত বেগুনাবাড়ী গ্রামে। পিতা স্মৃতিরঞ্জন জানা এবং মা অলকা জানা। অনেক প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে 'বাজকুল মিলনী মহাবিদ্যালয়' থেকে বি. এ. পাশ করেন। তারপর আইন নিয়ে পড়তে পাড়ি দেন শান্তিনিকেতন। খুব ছোটবেলা থেকেই মনের গভীরে একটি সুপ্ত ইচ্ছে ছিল যে আর্থিক ভাবে পিছিয়ে থাকা ছেলেমেয়েদের জন্য তিনি কিছু করবেন। সেই সুযোগ তিনি পেলেন শান্তিনিকেতনে পড়াকালীন।
যে কলেজে তিনি নিয়ে আইন পড়তেন, সেই কলেজের পাশেই সাঁওতাল জনজাতির মানুষের বসবাস। রোজ কলেজ যাওয়ার পথে দেখতেন কিছু পড়ুয়া নিয়মিত স্কুলে না গিয়ে পথেঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেই দৃশ্য তাঁর সমাজের জন্য কিছু করার সুপ্ত ইচ্ছাকে জাগিয়ে তোলে এবং তা তিব্র হয়ে ওঠে করোনা মহামারীর সময়।
তিনি প্রথমে ওই গ্রামের সর্দারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং স্কুলছুট ছেলেমেয়েদের পড়ানোর প্রস্তাব দেন। কিন্তু গ্রামের লোকজন সন্দেহ করেন, সেভাবে আগ্রহ দেখান না। হাল না ছেড়ে দিয়ে তিনি প্রত্যেকদিন পাড়ায় গিয়ে সবাইকে বোঝাতে শুরু করেন। প্রথমদিকে সবাই ভুল বুঝতো, কেউ কেউ আবার ছেলেধরাও বলত। আসলে নিরীহ গ্রামবাসীর মধ্যে একটা ভয় কাজ করছিল। কিন্তু প্রীতিকণার চেষ্টায় সেই ভয় কেটে যায়। তিনি বাচ্চাদের পড়ানোর সম্মতি পান।
২০২০ সালের ২রা সেপ্টেম্বর মাত্র ১১-১২ জন বাচ্চা নিয়ে শুরু হয় তাঁর স্বপ্নের পাঠশালা। পাঠশালার নাম দেন 'রুবানী গৌতম শিক্ষাঙ্গন' (গোপালনগর, বোলপুর, বীরভূম)। রুবানী বা Rubani শব্দের অর্থ হল "Soul of Holy Book" - ধর্মগ্রন্থের আত্মা বা সারমর্ম। যে কোন ধর্মগ্রন্থেরই আত্মা বা সারমর্ম এক তাই রুবানী শব্দটি প্রীতিকণার খুব প্রিয়। সঙ্গে যুক্ত হল 'গৌতম', অর্থাৎ গৌতম বুদ্ধ। দুয়ে মিলে হল 'রুবানী গৌতম', শুরু হল 'রুবানী গৌতম শিক্ষাঙ্গন'-এর পথ চলা।
এই শিক্ষাঙ্গন কিন্তু অন্যদের থেকে অনেকটাই আলাদা। এই শিক্ষাঙ্গন স্বনির্ভর, অন্যদের থেকে কোন বৈষয়িক সাহায্য নেওয়া হয় না। অনেকেই আর্থিক ভাবে বা জামা-কাপড়, বই-খাতা ইত্যাদি দিয়ে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু প্রীতিকণা ফিরিয়ে দিয়েছেন। তাঁর মতে অন্যের থেকে সাহায্য নিয়ে মুখাপেক্ষী হয়ে বাঁচার থেকে, প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে তাঁর ছেলেমেয়েরা নিজেদের পায়ে দাঁড়াবে এটাই তাঁর স্বপ্ন।
শিক্ষা দানের সঙ্গে সঙ্গে তিনি দেন জীবন বোধের পাঠ দেন। এলাকা পরিষ্কার করা, বৃক্ষরোপণ করা। বাচ্চার এবং তাদের বাবা-মায়েদের পুষ্টির জন্য তৈরী করেছেন কিচেন গার্ডেন। সেই সঙ্গে গ্রামের মানুষদের তাঁদের নিজস্ব সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতন করেন। নিয়মিত বাচ্চাদের নখ, চুল, কেটে দেন। ছেলেমেয়েদের জামাকাপড় কেচে পরিষ্কার করে দেন। স্বাস্থবিধি শেখান।
কিচেন গার্ডেন (Photo: Rajkumar Das)
তাঁর শিক্ষাঙ্গনে এখন ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা এখন ১১ থেকে বেড়ে ৫৬। বৃষ্টি, রেখা, পূর্ণিমা-দের নিয়ে পড়াশুনার সঙ্গে চলে নাচ-গান আঁকা ইত্যাদি। ইতিমধ্যেই অজিত মুর্মু মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তির্ণ হয়েছে। মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে আরো দুই ছাত্র রাজু বাস্কি এবং অনিল মার্ডি। তাঁর চেষ্টায় ৮ জন পড়ুয়া বার্ষিক ৮ হাজার টাকা স্কলারশিপ পেয়েছে।
শুধু পড়াশুনাই নয়। সামাজিক প্রতিবন্ধকতা কাটাতে তাঁর শিক্ষাঙ্গনে অনুষ্ঠিত সরস্বতী পূজোয় পুরোহিত করেছেন এক ছাত্রীকে। মেয়েরা যে কোন অংশেই পিছিয়ে নেই তা প্রমান করেছেন বার বার। যাদবপুর ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অফ রিলিজিয়ন অ্যান্ড সোসাইটির অধ্যাপক রুবি সাইন বলেন - "এই উদ্যোগ অবশ্যই নারীদের জন্য একটি বড় সাফল্য। পুরোহিতরা উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণদের পুরুষ-শাসিত জগতের এবং তারা সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই এই আদিবাসী মেয়ের পুজো নিরপেক্ষ বর্ণমুক্ত সমাজ গড়তে সাহায্য করবে। বৈদিক যুগে গার্গী, খনা এবং মৈত্রীর মতো নারী পুরোহিত ছিলেন কিন্তু রাজা মনু মহিলাদের পিছনে ঠেলে দিয়েছিলেন।” হিন্দু শাস্ত্র বিশেষজ্ঞ কে কে ভৌমিকও এই উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন - "আমাদের অবশ্যই মেয়েদের পুরোহিত হিসাবে কাজ করতে উত্সাহিত করতে হবে এবং তাদের তৈরি করার জন্য প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করতে হবে।"
এই সবের বাইরেও প্রীতিকণা ক্যান্সার রোগীদের জন্য চুল দান করেছেন। অতিমারীতে পথকুকুরদের খাইয়েছেন। করোনায় আক্রান্ত রোগীর বাড়িতে ওষুধ ও খাবার পৌঁছে দিয়েছেন। অল্প বয়সেই তাঁর জটিল অস্ত্রোপচার হয়েছে, কিন্তু শরীর, মন কোন কিছুই তাঁকে থামাতে পারেনি।
জনপ্রিয় বাংলা ধারাবাহিক 'দিদি নং ১'-এর মঞ্চে প্রীতিকণা জানা।
যে গ্রাম একদিন তাঁকে ছেলেধরা সন্দেহ করেছিল। আজ প্রীতিকণা সেই গ্রামের নিজেদের মেয়ে।
প্রীতিকণা তুমি এগিয়ে যাও। তোমার চলার পথে আমরা গাইবো সেই গান -
"যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে,
তবে একলা চলো রে।
তবে একলা চলো, একলা চলো,
একলা চলো, একলা চলো রে।"
অরিন্দম ভৌমিক।
midnapore.in
Published on 26.09.2023 (204th Birthday of Pandit Iswar Chandra Vidyasagar)
From 2020 onwards ‘Midnapore-Dot-In’ is celebrating Vidasagar’s English & Bengali birthday as ‘TEACHERS DAY’ of undivided Medinipur District.