ইংরেজিতে একটি শব্দ রয়েছে Polymath (Greek: πολυμαθής), অর্থাৎ এমন একজন ব্যক্তি যার জ্ঞান উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিষয়ে বিস্তৃত। সোজা বাংলায় বহুমুখী প্রতিভা সম্পন্ন ব্যাক্তি। বিদ্যাসাগরের ক্ষেত্রে এই Polymath শব্দটি ব্যবহার করে যায়। সেই বহুমুখী প্রতিভার একটি হল 'হোমিওপ্যাথি ডাক্তার বিদ্যাসাগর'। আজ 'World Homeopathy Day' উপলক্ষ্যে আপনাদের শোনাবো বিদ্যাসাগরের ডাক্তারি।
তিনি যে শুধু ডাক্তার ছিলেন তা নয়, তিনি আবিষ্কার করেছিলেন হাঁপানির (Asthma) ওষুধ। যে ওষুধ আজ শুধু দোকান থেকেই নয় ঘরে বসেই flipkart বা Tata 1mg-র মত ওয়েবসাইট গুলি থেকে কিনতে পারবেন।
প্রচুর অর্থ ব্যয় করে হোমিওপ্যাথির বই কিনে চিকিৎসা বিদ্যা শিখেছিলেন তিনি। বইয়ের সংখ্যা এত ছিল যে প্রায় একটা লাইব্রেরি বানিয়ে ফেলেছিলেন। বিনামূল্যে বিতরণ করেছেন ওষুধ। শব ব্যবচ্ছেদ শেখার জন্য শেখার জন্য বেশ কিছু নরকঙ্কাল (human skeleton) পর্যন্ত কিনেছিলেন বিদ্যাসাগর। এছাড়াও সুকিয়া স্ট্রিটে ডাক্তার চন্দ্রমোহন বসুর কাছে বিদ্যাসাগর হোমিয়োপ্যাথি চিকিৎসার শিক্ষা নিয়েছিলেন। তাঁর চিকিৎসার তথ্য লিখে রাখতেন ডাইরিতে।
তবে ডাক্তারি যে তিনি শখের জন্য করতেন তা কিন্তু একদমই নয়। বরাবরই সেবা অন্ত প্রাণ বিদ্যাসাগর। গরিব-দুঃখীর যন্ত্রনা তিনি সহ্য করতে পারতেন না। তাঁদের সেবার উদ্দেশেই শুরু করেছিলেন চিকিৎসা।
শঙ্করীপ্রসাদ বসুর ‘রসসাগর বিদ্যাসাগর’ বইয়ে রয়েছে— ‘‘নিজে বহু অসুখে ভুগেছেন তার যন্ত্রণা, অপরকে ভুগতে দেখার যন্ত্রণা পণ্ডিত বিদ্যাসাগরকে ‘চিকিৎসক’ বিদ্যাসাগর করে তুলেছিল।“
শহর কলকাতায় যখন খুব কলেরার প্রকোপ দেখা দিয়েছিল। সেই সময় তিনি যেখানেই খবর পেতেন যে, কলেরা রোগীকে অস্পৃশ্য করে রাখা হয়েছে, সেখানেই চিকিৎসক বন্ধুকে নিয়ে বা একাই চলে যেতেন তিনি। তাঁর চিকিৎসায় কত জন যে জীবন ফিরে পেয়েছেন তার কোনও হিসেব নেই। শুধু কলকাতাই নয়, পৌঁছে গেছেন প্রত্যন্ত গ্রামেও।
অধ্যক্ষ ক্ষুদিরাম বসু লিখেছেন - "একবার বর্ধমানের গ্রামকে গ্রাম ম্যালেরিয়ায় উজাড় হয়ে যায়। উলো, দ্বারবাসিনী, কল্যাণপু সহ বিভিন্ন গ্রামে ৬ মাস থেকে চিকিৎসা করেছিলেন বিদ্যাসাগর।"
শুধু অসহায়ের চিকিৎসাতেই নয় শহরের বড় বড় চিকিৎসকরা যেখানে রোগ সারাতে পারতেন না সেখানে ডাক পড়ত বিদ্যাসাগরের।
ক্ষুদিরাম বসু তাঁর স্মৃতিচারণায় লিখছেন - “আমার একবার পেটের ব্যারাম হয়েছিল। ব্রজেন বাঁড়ুজ্যে, প্রতাপ মজুমদারদের ওষুধও ঠিক লাগছিল না। বিদ্যাসাগর মশায় আমায় দেখতে এসে বললেন- 'থাকবে?-না যাবে?' বেঁচে থাকতে চাও, না মরতে চাও? আমি একটু হাসলাম। তিনি বই খুঁজে খুঁজে আমাকে ওষুধ দিলেন। ২/৩ বার খেয়েই সুস্থ হলাম”
ক্ষুদিরাম বসুকে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা শিখতে বলেছিলেন বিদ্যাসাগর। বই আর ওষুধ মিলিয়ে দেড়শ টাকার একটা ফর্দ করে দিয়েছিলেন। সে যুগের দেড়শ টাকা, স্বভাবতই খুব অস্বস্তিতে পড়েছিলেন এবং বিব্রত বোধ করেছিলেন ক্ষুদিরাম বসু। বিদ্যাসাগর সে কথা বুঝতে পেরে তাঁর তরুণ সহকর্মীটিকে টাকাটা ধার হিসেবে দিয়েছিলেন। প্রথমে বিরক্ত হলেও সারা জীবনের জন্য লাভ হয়েছিল ক্ষুদিরাম বসুর। তিনি লিখেছেন - "এখন কিন্তু মনে হয় কি উপকারই তিনি করে গিয়েছিলেন। এলোপ্যাথিক ডাক্তারখানায় আমার বাড়ির জন্য এখন বছরে যদি ২০ টাকার বিল হয়ত খুব বেশী। আমি হোমিওপ্যাথিতেই বাড়ীর ছোট খাটো রোগ সারাই। আমার ছেলে হিরণ যার বয়স ২৫/২৬ হবে, এই গত বছরে মাত্র প্রথম এলোপ্যাথিক ওষুধ খায়"।
সে যুগের বিখ্যাত আ্যালোপাথ ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার একসময় হোমিওপ্যাথিকে 'হাতুড়ে চিকিৎসা'' মনে করতেন। সেই তিনিই নিজের মত পালটে পরবর্তীতে হোমিওপ্যাথি চর্চা করেন। আর এই পরিবর্তনের পিছনেও আছেন বিদ্যাসাগর। বিদ্যাসাগরের ভাই সম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্নের লেখা থেকে জানা যায়, একবার একই গাড়িতে ভবানীপুর থেকে উঠেছিলেন তিনি, বিদ্যাসাগর এবং মহেন্দ্রলাল সরকার। শ্রী রামকৃষ্ণের ডাক্তারের সঙ্গে হোমিওপ্যাথির যথার্থতা নিয়ে প্রবল তর্ক জুড়েছিলেন বিদ্যাসাগর। সে বিবাদের স্বর এমনই উচ্চে পৌঁছেছিল যে শম্ভুচন্দ্র বলতে বাধ্য হন - “মশাই আমাকে নামিয়ে দিন, আপনাদের বিবাদে আমার কানে তালা লাগল”। এই মহেন্দ্রলালই পরে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাতেও খ্যাতি অর্জন করেন।
ক্ষুদিরাম বসু এই প্রসঙ্গে বলছেন -“মহেন্দ্র ডাক্তারকে ত তিনিই একরকম হোমিওপ্যাথিতে হাতে খড়ি দেন। লাল মিত্রের একসময়ে liver abscess হয়। মহেন্দ্র ডাক্তার দেখেশুনে ওষুধ দিয়ে গেলেন। তারপর বিদ্যাসাগর মশাই এসে রোগীকে দেখে সে ওষুধ আর দিতে দিলেন না। তিনি নিজে দেখেশুনে ওষুধ খাইয়ে তাঁর দুরারোগ্য রোগ সারিয়ে ছিলেন”।
১৮৭৮ সালে একবার হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর খুব ম্যালেরিয়া জ্বরে হয়েছিল। সেই সময় তাঁর লখনৌ-এর ক্যানিং কলেজে যাওয়ার কথা ছিল (এই কলেজিটি বর্তমানে University of Lucknow)। কিন্তু অসুস্থ শরীরে কলকাতা থেকে সরাসরি লখনৌ যাওয়া অসম্ভব। ঠিক করলেন, পথে কার্মাটাঁড়ে বিদ্যাসাগরের বাড়ি কয়েক দিন থেকে শরীরটাকে ঠিক করবেন। জামতাড়া আর মধুপুর স্টেশনের মাঝখানে কার্মাটাঁড়। জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতে বীতশ্রদ্ধ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৭৩ সালে সেখানে বাগানঘেরা একটি বাড়ি কিনেছিলেন। বাড়িটির নাম দিয়েছিলেন ‘নন্দন কানন’। জীবনের শেষ ১৮ বছর কলকাতা ছেড়ে সেখানেই মূলত সাঁওতালদের মধ্যে থাকতেন। ১৮৭৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী সেখানে পৌঁছলেন।
এক দিন বিকেলে তিনি বিদ্যাসাগরকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছিলেন না। ‘নন্দন কানন’ থেকে বেরিয়ে খুঁজতে গিয়ে হঠাৎ দেখলেন, হাতে একটা পাথরের বাটি নিয়ে ঘর্মাক্ত শরীরে আলপথ ধরে হনহন করে বিদ্যাসাগর হেঁটে আসছেন। কোথায় গিয়েছিলেন জানতে চাইলে বিদ্যাসাগর জানালেন, এক সাঁওতাল কিশোরের নাক দিয়ে ক্রমাগত রক্ত পড়ছিল। তার মা ছুটতে-ছুটতে এসেছিলেন ডাকতে। মাইল দেড়েক দূরে সেই গ্রামে হোমিয়োপ্যাথিক ওষুধ দিতে গিয়েছিলেন। এক ডোজ়েই রক্ত পড়া কমে গিয়েছে। ‘‘এঁরা তো মেলা ওষুধ খায় না, তাই অল্প ওষুধেই উপকার হয়। কলকাতার লোকের ওষুধ খেয়ে-খেয়ে পেটে চড়া পড়ে গিয়েছে। মেলা ওষুধ না দিলে তাঁদের উপকার হয় না।’’
সমাজসংস্কারক, শিক্ষাবিদ পরিচয়ের আড়ালে থেকে গিয়েছে তাঁর হোমিয়োপ্যাথি-চর্চার ইতিহাস। কলকাতায় শুরু করলেও সম্পূর্ণ রূপ পেয়েছিল কার্মাটাঁড়ে। পুরোদস্তুর ডাক্তারবাবুর ভূমিকায় তাঁকে পেয়েছিলেন কার্মাটাঁড়ের আদিবাসী মানুষজন। বাড়ির বৈঠকখানাতেই চালাতেন তাঁর অবৈতনিক ডিসপেন্সারি।
ভাই শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন মাঝে-মধ্যেই যেতেন কার্মাটাঁড়ে। দাদাকে কাজে সাহায্য করতেন। তাঁর লেখাতেও পাওয়া যায়, ভোরবেলা থেকে বেলা দশটা পর্যন্ত রোজ বিদ্যাসাগর সাঁওতাল রোগীদের দেখতেন, বিনা পয়সায় ওষুধ দিতেন। পথ্য হিসেবে সাবু, বাতাসা, মিছরি খাওয়াতেন। আবার বিকেল থেকে রাত অবধি চলত রোগীদের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে দেখা, যার জন্য দিনে অনেক সময় তাঁকে তিন মাইলেরও বেশি হাঁটতে হত এবং রাত জাগতে হত।
এক বার রাজনারায়ণ বসু দেওঘরে এসেছেন। বিদ্যাসাগরের একটি বিশেষ কাজে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার কথা। কোনও দিন কথার খেলাপ না-করা মানুষটি কিন্তু সে বার যেতে পারলেন না। কারণ, কলেরা-আক্রান্ত ৬৪ বছরের অশ্বিনী হেমব্রমকে বাঁচাতে তখন তিনি দিন-রাত এক করে ফেলছেন। চিঠিতে সে কথা জানিয়েছিলেন রাজনারায়ণকে।
এই কার্মাটাঁড়ে নিয়মিত একটি ডায়েরিতে বিদ্যাসাগর চিকিৎসার বিবরণ লিখে রাখতেন। বর্তমানে ডায়েরি সংরক্ষিত রয়েছে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিদ্যাসাগরের পৌত্রীর পুত্র ছিলেন ক্ষিতিপ্রসাদ। বড় ছেলে নারায়ণচন্দ্রের মেয়ে মতিমালা দেবী। মতিমালা দেবী ও যামিনীমোহন চট্টোপাধ্যায়ের ছেলে ক্ষিতিপ্রসাদের বিয়ে হয় মঞ্জুশ্রী দেবীর সঙ্গে। মঞ্জুশ্রী দেবী ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৌত্রী তথা সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় মেয়ে। এই ভাবেই মিলে গিয়েছিল বিদ্যাসাগর ও রবীন্দ্রনাথের পরিবার। সেই সূত্রে বিদ্যাসাগরের প্রেসক্রিপশন ও ৯৬ পৃষ্ঠার ডায়েরি এখন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে।
ডায়েরি থেকে জানা যায়, বিদ্যাসাগর রোগীদের রোগের লক্ষণ খুব গুরুত্ব দিয়ে পর্যবেক্ষণ করতেন এবং তা লিখে রাখতেন। যেমন, রোগীর নাম, চিকিৎসা শুরুর তারিখ, উপসর্গ, তাঁকে কোন ওষুধ কত বার দিলেন এবং রোগ কবে সারল। মোট ৯৬ পৃষ্ঠার ডায়েরি। কালো কালিতে লেখা। আরও কিছু পাতা ছিল যা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ১৮৮০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে ১৮৮৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন বছর সময়সীমায় বিভিন্ন রোগীর কেস-হিস্ট্রি রয়েছে এই ডায়েরিতে। রোগীদের মধ্যে তাঁর স্ত্রী দিনময়ী দেবী, পুত্রবধূ ভবসুন্দরী, মেয়ে শরৎকুমারী, মেয়ে কুমুদিনী, নাতনি মৃণালিনীর মত নিকটাত্মীয়দেরও নাম রয়েছে। আত্মীয়রা ছাড়াও হরমোহন, মোক্ষদা দেবী, সুরেশচন্দ্র, তারকনাথ সান্যাল, প্রিয়মোহন, সুখদা দেবী, হেমলতা, সারদা, রাধাকৃষ্ণ ইত্যাদি অনেকের নাম রয়েছে।
উদহারণ স্বরূপ কিছু বর্ণনা এখানে দেওয়া হল –
Dinamayi Devi
Thin watery evacuations-cutting pains in the bowels-violent chills; Execessive heat and thirst.
15.10.80
acontium 1
Every 2 hours
Cured 16.10.80’
‘Bhabasundari
Copious, tenacious, yellowish discharge from the female genital organs.
26.1.81
aconitium 6, Thrice daily
1.2.81
sepea 30, Thrice daily
Cured 15.2.81.
‘‘Saratkumari Devi
Hiccup, Nausea in the Morning and After Meal Vomiting of Food Awakens from Sleep with a Start.
15.10.80.
Sulfur 30, night and morning.
No improvement.
Mokshada Devi
Cancer in the uterus of three years.
Standing-continuous fever-great disgust for all food-excessive burning in the uterine region-left leg very much solen and painful restlessness day and night.
Aceticum acidum 1, Arsenicum 30.''
বিদ্যাসাগরের পরবর্তী প্রজন্মও বয়ে নিয়ে চলেছে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার ধারা। বিদ্যাসাগরের ছোট ভাই ঈশানচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। বিদ্যাসাগরের মৃত্যুর পরের বছর জন্মগ্রহণ করেন ঈশানচন্দ্রের ছেলে পরেশনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি পরবর্তী কালে বিখ্যাত হন চিকিৎসক ‘পি ব্যানার্জি (মিহিজাম)’ নামে। পরেশনাথের ছেলে প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ও বিখ্যাত হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক ছিলেন। এলগিন রোডে নেতাজি ভবনের ঠিক উল্টো দিকে তাঁর বাড়ি ছিল। তাঁর ছেলে প্রতীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনিও সেই একই বাড়িতেই প্র্যাকটিস করেন। বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারে হোমিয়োপ্যাথি চর্চার ১৫০ বছর পালন করা হয়েছিল।
এইবারে শোনাবো তাঁর ওষুধ আবিষ্কারের বৃত্তান্ত -
ছোটবেলায় বিদ্যাসাগর বাবার সঙ্গে যে ভাড়ার ঘরে থাকতেন সেই ঘরের রান্নাঘরটি ছিল অন্ধকার। একফোঁটা রোদ ঢুকতো না। তার উপর রান্নাঘরের পাশে একটা ময়লার ভাগাড় ছিল, মলমূত্র আর কৃমিকীটে ভরা। দুর্গন্ধ তো ছিলই, তার চেয়ে বিশ্রী ব্যাপার হল খাবার সময় বিদ্যাসাগরকে এক ঘটি জল নিয়ে বসতে হতো। নইলে ভাত খাওয়ার উপায় থাকত না। দলে দলে কৃমি থালার দিকে এগিয়ে আসতো। ঘটি থেকে জল ঢেলে ঈশ্বর কৃমির দলকে ভাসিয়ে দিতেন বা সরিয়ে দিতেন। আর রান্নাঘরে ছিল আরশোলার খুবই উৎপাত। একদিন খেতে বসে বিদ্যাসাগর দেখলেন, তরকারির মধ্যে একটা আরশোলা। কাউকে বললেন না সেকথা। বললে তো কারো খাওয়া হবে না। আরশোলাটা যদি পাতের পাশে ফেলে দেন, অন্যদের চোখে পড়বে। কী করা যায়? অন্যদের যাতে অসুবিধা না হয়, কেউ যাতে কিছুই টের না পায়, তরকারির সঙ্গে আরশোলাটাও খেয়ে ফেললেন তিনি।
ভবিষ্যতেও এই আরশোলা তাঁর পিছু ছাড়েনি। আরশোলার জন্যই বিদ্যাসাগর আবিস্কার করে ফেলেছিলেন হোমিওপ্যাথির অন্যতম একটি ওষুধ। বিদ্যাসাগরের হাঁপানি ছিল। শীতকালে সেই রোগ বাড়ত। তাই শীতকালে তিনি সকাল-বিকেল দুবেলা গরম চা পান করতেন। একদিন তিনি চা খাওয়ার ঘণ্টা খানেক পরে অনুভব করলেন যে হাঁপানির টান একদম কমে গেছে। তিনি বুঝতে পারলেন যে চায়ের সঙ্গে কিছু একটা ছিল, যার জন্যই তাঁর হাঁপানির টান কমে গেছে। তিনি ভৃত্যকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, "চায়ের সঙ্গে কি আদার রস দিয়েছো?" ভৃত্য জানালো যে সে কিছুই মেশায়নি, অন্য দিনের মতই বানিয়েছে। তবে তাড়াহুড়োয় সেইদিন কেটলি না ধুয়েই চা বানিয়েছে। বিদ্যাসাগর কেটলি পরীক্ষা করে দেখলেন, ভেতরে দুটি আরশোলা পড়ে রয়েছে।
বিদ্যাসাগর অনুমান করলেন এই আরশোলাতেই এমন কিছু রয়েছে যা হাঁপানির উপশম করতে পারে। ঠিক করলেন ওষুধ বানিয়ে পরীক্ষা করবেন। হোমিওপ্যাথি ওষুধ বানানোর পদ্ধতিতে বেশ কিছু আরশোলা বেশি জলে সেদ্ধ করার পর, তাকে অ্যালকোহলে ফেলে ছেঁকে ডাইলিউট (dilute) করে ওষুধ বানিয়ে ফেললেন। প্রথমে নিজে খেয়ে পরীক্ষা করে দেখলেন সত্যিই কাজ করছে ওষুধটি। পরে না জানিয়ে অন্যান্যদের উপরে পরীক্ষা করে সাফল্য পেলেন। ভুবনকৃষ্ণ মিত্র তাঁর স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, "বহু রোগীকে না জানিয়ে তিনি এই ওষুধ খাওয়ান। সাফল্য পাওয়ার পর রীতিমতো ব্যবহার হতে শুরু করে তাঁর তৈরি ব্লাট্টা অরিয়েন্টালিস (Blatta orientalis)।" Oriental cockroach-এর বিজ্ঞান সম্মত নাম Blatta orientalis, তাই ওষুধের নাম রাখা হয় ব্লাট্টা অরিয়েন্টালিস (Blatta orientalis)। ‘মেটিরিয়া মেডিকায় (Materia medica)’ এই ওষুধের প্রথম প্রয়োগকর্তা হিসেবে নাম আছে পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের। স্প্যানিশ এবং ইংরেজি ভাষায় William Boericke-এর লেখা Una Edicion Aumentada Manual De Bolsillo De Materia Medica Homeopatica (Pocket Manual of Homoeopathic Materia Medica & Repertory: Comprising of the ...) বই দুটির পৃষ্ঠার ছবি দেওয়া হল। ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত Indian Journal of Zoology (Volume 6)-তে বিদ্যাসাগরের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
২০১৮ সালে ব্লাট্টা অরিয়েন্টালিস হোমিওপ্যাথিক ওষুধের একটি বিশদ ভৌত রাসায়নিক অধ্যয়ন করেছিলেন ড্রাগ স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন ইউনিট, হায়দরাবাদ, তেলেঙ্গানার বিজ্ঞানী বিবস্বান বিশ্বাস, শ্যাগা ঝাঁসি, রামচন্দর পোটু, সতীশ প্যাটেল, এম নাগারাজু, ই.এন. সুন্দরম এবং সেন্ট্রাল কাউন্সিল ফর রিসার্চ ইন হোমিওপ্যাথি, নিউ দিল্লির বিজ্ঞানী রাজ কে মানচন্দা, রেনু আর্য, এ কে খুরানা। সেই প্রতিবেদনের কিছু তথ্য এখানে সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো।
ব্লাটা ওরিয়েন্টালিসের হিমোলিম্ফের রিপোর্ট করা রাসায়নিক উপাদানগুলি হল ট্রায়াজোলস, থিওফেনস, সেকেন্ডারি সালফোনামাইড, ভিনাইল হ্যালাইডস, সালফিনিক অ্যাসিড, সেকেন্ডারি অ্যামাইড, ব্রোমো যৌগ, সাইক্লোপেপটেন, অ্যালডিহাইড/কেটোনস গ্রুপ এবং মিথিলিন গ্রুপ। হোমিওপ্যাথিতে সম্ভাব্য অ্যান্টি-অ্যাজমাটিক ড্রাগ হিসাবে এর ঔষধি প্রভাব বিবেচনা করে, বর্তমান গবেষণাটি ব্লাটা ওরিয়েন্টালিসের কাঁচা ওষুধ এবং হোমিওপ্যাথিক ফর্মুলেশন (মাদার টিংচার) মানক করার জন্য করা হয়েছিল। এই গবেষণা নিবন্ধে উপস্থাপিত ভৌত রাসায়নিক তথ্য বাণিজ্যিক নমুনার গুণমান নিশ্চিত করতে ফার্মাকোপিয়াল মান হিসাবেও ব্যবহার করা যেতে পারে।
ফলাফল: অধ্যয়নটি নির্দেশ করে যে এই ওষুধের প্রাথমিক পরামিতিগুলির মানগুলি উদ্ভিদের ওষুধের জন্য রিপোর্ট করা রেঞ্জ থেকে বেশ ভিন্ন। টিএলসি অধ্যয়ন প্রস্তুত ওষুধের গঠনের জটিলতা নিশ্চিত করে।
উপসংহার: ব্লাটা ওরিয়েন্টালিস, ওষুধের ভৌত রাসায়নিক তথ্য, বাণিজ্যিকভাবে উপলব্ধ ওষুধের প্রমাণীকরণ, গুণমান নিশ্চিতকরণ এবং গুণমান নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়ার জন্য ফার্মাকোপিয়াল স্ট্যান্ডার্ড হিসাবে কাজ করতে পারে।
এর পরে আপনি কখনো হোমিওপ্যাথি ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে যদি দেখেন যে Samuel Hahnemann-এর ছবি ঝুলছে, তাহলে অবশ্যই সেই ডাক্তারবাবুকে ব্লাটা ওরিয়েন্টালিসের আবিস্কারক ডঃ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ছবিও রাখতে অনুরোধ করবেন।
অরিন্দম ভৌমিক
midnapore.in
(Published on 10 April 2023, World Homeopathy Day)