আমার জ্ঞাতি ভাই এবং স্কুল জীবনের সহপাঠী স্বর্গত নিরঞ্জন ভৌমিকের পুত্র শ্রীমান অরিন্দমের অনুরোধে আমার দেখা গ্রাম এবং সে যুগের সমাজ জীবনের একটি যথাযথ চিত্র আঁকিবার চেষ্টা করিতেছি।
আমার জন্ম মেদিনীপুর জেলার নন্দীগ্রাম থানায়। নানা কারণে, বিশেষত; কৃষি আন্দোলনের জন্য আজ নন্দীগ্রাম অনেকের নিকট পরিচিত। আমার জন্ম বাংলা ১৩৪৫ সালে। উনপঞ্চাশের ভরাভয় বন্যা। বঙ্গোপসাগরের জলোচ্ছাস এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু। তাহার পর সর্বগ্রাসী দুর্ভিক্ষ আমার শৈশব স্মৃতিকে আকীর্ণ করিয়া রাখিয়াছে। সর্বোপরি পুলিশি অত্যাচার আমার তিন চার বৎসরের শৈশব স্মৃতি হইতে এখনও মুছিয়া যায় নাই। আমার ধূসরতম স্মৃতি হইল বন্যা।
যেদিন বন্যা হয় তাহার দুই-তিন দিন পূর্ব হইতে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিল - এবং ঈষান কোন হইতে ঝডে়া হাওয়ার সহিত গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হইতেছিল। আমার পিতৃদেব আমাদের গ্রামের অনেক জমিজমার মালিক – সুখে দুঃখে সকলের আশ্রয় স্বরূপ, তিনিও সকলের উপর নির্ভর করিতেন। ঐবন্যার আগে আমাদের অতি পুরাতন বাসগৃহ বিধ্বংসী আগুনে পুড়িয়া যায়। এমনিই আমাদের বাস্তুটি বেশ উঁচুতে, তাহার উপর পোড়ো বাড়ির মাটির দেওয়াল পড়িয়া অনেকখানি উঁচু হইয়া গিয়াছিল। তাহার একাংশে অস্থায়ী ভাবে ছিটা বেড়া দিয়া তিন চারিটি ছোট ছোট কুঠিরিতে আমরা থাকিতাম। ইহার পর মূল বাস্তুতে বাড়ি তৈরি হইবে, ইহাই ছিল পতৃদেবের পরিকল্পনা।
আকাশ মেঘে ঢাকা। মাঝে মাঝে গুড় গুড় করিয়া শব্দ হইতেছিল।
আকাশ মেঘে ঢাকা। মাঝে মাঝে গুড় গুড় করিয়া শব্দ হইতেছিল। সম্ভবত আমি একজনের কোলে ছিলাম। গ্রামের মাতব্বররা বাবাকে কহিতেছিল – খুব ভাল মনে হইতেছে না। আমাদের কিছু পরিমান জায়গা, যেখানে ভাগীরথী বঙ্গোপসাগরে মিশিয়াছে, সেইখানে ছিল। একটি ছোট মাছের ঘেরিও ছিল। যাহাতে জোয়ারের সময় জল না ঢুকে, সেইজন্য পর পর ৩-৪ টি উঁচু ও শক্ত বাঁধ ছিল। সেই উঁচু বাঁধগুলিকে ভেড়ি বলা হইত। প্রথম ভেড়ি ভাঙিয়া গেলে তাহার সামান্য পরে জোয়ারের জল দ্বিতীয় ভেড়িতে ধাক্কা খাইত। ঐ মোহনার নিকট আমাদের জায়গা জমি পুকুর ও বাস্তু ছিল। সেখানের কিছু কৃষক সকাল সকাল চলিয়া আসিয়া কহিল, অবস্থা খুব ভাল নয়। ঐখানে থাকা নিরাপদ নহে, গরুগুলির দড়ি খুলিয়া দিয়া চলিয়া আসিয়াছি।
তখনকার দিনে আবহাওয়ার পূর্বাভাস ছিল না। রেডিও, টিভি প্রভৃতির আবির্ভাব ঘটে নাই। গ্রামগঞ্জের মানুষকে পরিস্থিতি অনুযায়ী কাজ করিতে হইত। পরিবেশ ক্রমাগত খারাপ হইতে লাগিল।
পরিবেশ ক্রমাগত খারাপ হইতে লাগিল।
গ্রামের মাতব্বরেরা ও পিতৃদেব একত্রিত হইয়া এই সিদ্ধান্ত লইলেন, গ্রামের মেয়ে ও শিশুদের ঐ চালাঘরে রাখা হউক। গরু বাছুরের গলার দড়ি খুলিয়া মুক্ত রাখা হউক।
আমাদের গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তে পাহাডে়র মত উঁচু ঢিবি ছিল। সেই ঢিবির নাম ছিল “রাখাল পড়িয়া”। সেই ঢিবিতে গরু বাছুর সহ কিছু লোক আশ্রয় লইল। রাখাল পড়িয়াকে ২/৩ মাইল দূর হইতে দেখা যাইত।
রাখাল পড়িয়া সম্বন্ধে অনেক প্রবাদ ছিল। উহা এক দেবস্থান। জন্মাষ্টমীর দিন রাতে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ এক বিরাট সাপের ফনার উপর বসিয়া বাঁশি বাজাইতেন। আমার দিদিমা বহুবার তাহা দেখিয়াছেন। কাজেই ইহা মিথ্যা নহে, আমাদের গ্রামের রাস্তা উহার পাশ দিয়া গিয়াছে। শৈশবে আমরা ঐটুকু জায়গা শ্রীকৃষ্ণের নাম করিতে করিতে চলিয়া আসিতাম।
যতদূর মন আছে, দূর্গা পূজার সময় ৭মী – ৮মী তিথিতে বন্যা হইয়াছিল। তখনকার দিনে আমন ধান, এক ফসলা। তাহাতেই মানুষের চলিয়া যাইত। বিধ্বংসী বন্যা ও ঝড়ে সতেজ ধান গাছ ডুবিয়া পড়িয়া গেল। সমস্ত দেশ জলে থৈ থৈ করিতে লাগিল। বন্যার পরের বৎসর শুরু হয়, মহামারি ও দুর্ভিক্ষ। উহাই উনপঞ্চাশের মন্বন্তর নামে পরিচত। আমার স্মৃতিতে ঐ সময়, এক দুর্যোগের পর্ব বলিয়া মনে হয়। জলোচ্ছাসে যাহারা ভাসিয়া যায় নাই তাহাদের অবস্থা আরও খারাপ। আমি তখন তিন-চারি বৎসরের মনে আছে। আমাদের বাড়িতে যাহা ধান চাউল ছিল আমার মা একমুঠা দুইমুঠা করিয়া প্রতিবেশীদের সাহায্য করিতেন। তখন আমাদের পরিবার সম্পূর্ণ গৃহশূণ্য। আমার বড় দাদা স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। তাহাকে পুলিশ প্রথমবার ধরিয়া ছিলেন। এক দিনের হাজতে থাকার পর উপযুক্ত প্রমাণ অভাবে পুলিশ ছাড়িয়া দিলে তিনি তখনই খেজুরি থানার দিকে পালাইয়া যান। আমাদের বাড়ি তমলুক মহকুমার নন্দীগ্রামের আমদাবাদ গ্রামে। নন্দীগ্রাম থানার পুলিশ সহজে কাঁথি মহকুমার খেজুরি থানায় যাইবে না। বন্যার বহু পূর্বে বাবা আমার বড়বৌদি, ছোটদি ও ভাইপো ভাইঝিদের লাটের, অর্থাৎ ২৪ পরগনার গোসাবার নিকট বিজয়নগরে পাঠাইয়াছেন। সেখানে আমাদের একটি বাস্তু, পুকুর, জায়গা জমি ও রানিধল নামে একটি ফিসারি ছিল। আমার এক দাদামহাশয় সেই সব রক্ষনা বেক্ষন করিতেন। সেইখানে বৌদি ও ভাইপো ভাইঝিদের পাঠাইয়া দেওয়া হইয়াছিল। ইহার কারণ পুলিশি অত্যাচার। ইংরাজ আমলের বিহারী পুলিশরা নারীদের সম্মান হানি করিত। স্বাধীনতা সংগ্রামী শ্রদ্ধেয় সুশীল কুমার ধাড়া যে সমস্ত পরিবারের নরনারীগন অত্যাচারিত হইয়াছিলেন তাহার একটি তালিকা প্রস্তুত করিয়াছিলেন। তিনি বলিাছিলেন, মা ও ভগিনীগন কেহই মুখ খুলিয়া বলেন নাই যে তাঁহারা অত্যাচারিতা হইয়াছিলেন।
ড. প্রবোধকুমার ভৌমিক।
আমার দুই দাদার বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযোগ ছিল। মেজদা প্রবোধকুমার তখন স্কুলের ছাত্র ছিলেন। সেই সময় তিনি তিন বৎসরের জন্য হিজলী জেলে বন্দী ছিলেন। বাবা লোক পাঠাইয়া জানিলেন যে হিজলী জেলে বঙ্গোপসাগরে জলোচ্ছাসের জল প্রবেশ করে নাই। পরে মেজদার নিকট শুনিয়া ছিলাম। জেলখানার নীচের তলাতে সামান্য জল উঠিয়াছিল। তিনি ভালো আছেন জানাইয়া ছিলেন। বড়দাদা অমূল্যরতনের কোন খোজ পাওয়া যায় নাই। তিনি একজন লোককে পাঠাইয়া জানাইয়া ছিলেন, তিনি ভাল আছেন, এবং তিনি অন্তরীন আছেন।
হিজলী জেল।
পরে বড়দাদার নিকট শুনিয়া ছিলাম, তিনি খেজুরি থানার এক কৃষকের বাড়িতে আত্মগোপন করিয়া ছিলেন। যাঁহার বাড়িতে ছিলেন, তিনি বলিলেন, যে ভাবে সাইক্লোন শুরু হইয়াছে। আমরা কে কোথায় যাইব ঠিক নাই। মনে হয় আমারা সকলেই ভাসিয়া যাইব। তখন এক কৃষকের কুঁড়ে ঘরের চালায় বসিয়া রহিলেন। সেই খড়ের কুড়ের চালা জলোচ্ছাসের জলে ভাসিতে ভাসিতে কোথায় গেল তাহার ঠিক নাই। সেই সঙ্গে প্রবল ঝড়ো হাওয়া ও অবিরাম বৃষ্টি।