Dr Suhrid Kumar Bhowmik, Amdabad, Nandigram, Medinipur, সুহৃদকুমার ভৌমিক, আমদাবাদ, নন্দীগ্রাম, মেদিনীপুর, Prabodh Kumar Bhowmik, অমূল্যরতন ভৌমিক, প্রবোধকুমার ভৌমিক, Amulyaratan Bhowmik

আমার দেখা আমার গ্রাম ২


Memories of my village 2


শ্রী সুহৃদকুমার ভৌমিক।




Home » Medinikatha Journal » Dr Suhrid Kumar Bhowmik » আমার দেখা আমার গ্রাম



সকাল হইলে দেখা গেল, সমস্ত দেশ জলমগ্ন। তিনি একটি গাছের ডালে বসিয়া রহিলেন। তাহার নিকট একটা গামছা ছিল তাহাতে সামান্য মুড়ি বাঁধা ছিল, ক্ষুধার সময় এক মুঠা করিয়া খাইতেন। তাহার পর ধীরে ধীরে জল কমিতে লাগিল। ধীরে ধীরে উঁচু জায়গাগুলি জাগিয়া উঠিল।


Dr Suhrid Kumar Bhowmik, Amdabad, Nandigram, Medinipur, সুহৃদকুমার ভৌমিক, আমদাবাদ, নন্দীগ্রাম, মেদিনীপুর, Prabodh Kumar Bhowmik, অমূল্যরতন ভৌমিক, প্রবোধকুমার ভৌমিক, Amulyaratan Bhowmik
আমার দেখা আমার গ্রাম।

এদিকে আমাদের বাড়িতে পুলিশী অত্যাচার ক্রমে ক্রমে বাড়িতে লাগিল। আমার বাবা টিনের চালা দিয়া একটি ঘর সারাইয়া ছিলেন। তাহাতেই সমস্ত জিনিষপত্র ছিল। পুলিশ সেইগুলিতেই আগুন দিতে লাগিল। আমার বাবা গ্রামের গন্যমান্য ব্যক্তি ছিলেন। ইংরাজ পুলিশের সহিত বিহারী পুলিশেরা তাঁহাকে সবুট লাথি মারিত। গ্রামের অনেকে জডে়া হইয়া পুলিশকে বলিত, উহার ছেলে কোথায় আছে উনি কি করিয়া বলিবেন।


Dr Suhrid Kumar Bhowmik, Amdabad, Nandigram, Medinipur, সুহৃদকুমার ভৌমিক, আমদাবাদ, নন্দীগ্রাম, মেদিনীপুর, Prabodh Kumar Bhowmik, অমূল্যরতন ভৌমিক, প্রবোধকুমার ভৌমিক, Amulyaratan Bhowmik
আমার দেখা আমার গ্রাম।

ঐ সময়ের স্মৃতিগুলি আমার ভাল মনে আছে। তখন আমি দুই বৎসরের। প্রায় প্রতিদিনই রাত্রে, পুলিশ দারোগা ও বিহারী পুলিশ বাড়ি আক্রমন করিত।


এ কথা সত্য যে, আমাদের বাড়িতে স্বাধীনতা সংগ্রামীরা লুকাইয়া থাকিত। আমাদের বৈঠকখানা লম্বা, তাহাকে বারান্দা ঘর বলা হইত। মূল বাস্তু বাড়ি হইতে প্রায় ৪০/৫০ গজ দূরে। এই দুই ঘরের মধ্যে বিরাট উঠান, তাহাতে যাত্রা, ছোটদের থিয়েটার, পুতুল নাচ ইত্যাদি হইত। বাহিরের লোকজন বা কোন আত্মীয় আসিলে সেইখানে থাকিত। তাহার দোতলাতে ছোট ছোট জানালা, প্রায় অন্ধকার। সেইখানে স্বাধীনতা সংগ্রামীরা দিনের বেলায় পুলিশের তাড়া খাইবার ভয়ে লুকাইয়া থাকিত। মা আচলের আড়ালে, মুড়ি ও ভাত ইত্যাদি দিয়া আসিতেন। আবার রাত্রে তাহারা চলিয়া যাইত। অনেক দিন আগে সুশীল ধাড়া, পিনাকী প্রামানিক প্রভৃতি আমাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, আমাদের ঐ ঘরটি এখনও আছে কিনা।


ঐ সময় প্রায় প্রতি রাত্রে পুলিশী অত্যাচার শুরু হইত। আমার তখন দুই বৎসর বয়স। রাত্রি ২টা হইতে ভোর ৫টা পর্যন্ত ৪০/৫০ জন পুলিশ হুইশেল বাজাইয়া ঘর ঘিরিয়া ফেলিত। আমার মা আমাকে কোলে করিয়া ঘর হইতে দুরে আল বাঁধ ধরিয়া পালাইয়া যাইতেন। তাহার পরে ছোটখাটো ঝোপের আড়ালে লুকাইয়া থাকিতাম। এইটুকু মনে আছে, আমার মাথায় ঘন চুল ছিল। সেই চুলের ভিতর জোনাকি পোকা ঢুকিয়া যাইত। মা আমাকে কাঁদিতে বা শব্দ করিতে না বলিতেন। পুলিশ ঘরে ঢুকিয়া আগে কে আছে খোঁজ করিত। বাড়ির কেহ নাই, দু-এক জন নির্ভর যোগ্য শ্রমিক সেই দুর্দিনে তাহারা ছাড়িয়া যাইতে রাজী হয় নাই। তাহাদের ধরিয়া পুলিশ মার ধর করিত। সকলের আগে পুলিশ বাড়ির নানা রকম জিনিষ নষ্ট করিয়া চলিয়া যাইত।


একদিন দেখিতাম, আমাদের বাড়িতে যত কাঁসার থালা ছিল তাহা ঢেঁকির গড়ে তাড় দিয়া ভাঙিয়া দিয়াছে। কোনদিন দেখিতাম, আমাদের টিনের ঘর ছিল তাহাতে কেরোসিন দিয়া আগুন জ্বালাইয়া দিয়াছে। একদিন পুলিশ চলিয়া গেলে দেখি ঘর ময় তেল। তখনকার দিনে, সরিষার তেল ঘানিতে দিয়া, বাড়িতে মজুত রাখিত। সেই তেলের ভাড় ভাঙিয়া দিয়াছে। আমার ছোটদি ও আমার নিজের অনকে খেলনা পুতুল ছিল সেগুলি লাঠি দিয়া ভাঙিয়া দিয়াছে।


Dr Suhrid Kumar Bhowmik, Amdabad, Nandigram, Medinipur, সুহৃদকুমার ভৌমিক, আমদাবাদ, নন্দীগ্রাম, মেদিনীপুর, Prabodh Kumar Bhowmik, অমূল্যরতন ভৌমিক, প্রবোধকুমার ভৌমিক, Amulyaratan Bhowmik
আমার দেখা আমার গ্রাম।

এক দিন দেখি, আমাদের যত বইপত্তর ছিল, বাবার বহু কাগজপত্র একত্র করিয়া আগুন ধরাইয়া দিয়াছে। শেষ কালে বাবাকে এই নির্দেশ দিল যে। তুমি প্রতিদিন, থানায় গিয়া বড়বাবুর সহিত দেখা করিয়া আসিবে। আমাদের বাড়ি হইতে নন্দীগ্রাম থানা খুব কম হইলেও পাঁচ ক্রোশ। যাওয়া আসার দশ ক্রোশ বাবার পক্ষে খুবই কষ্টকর হইল। এক দিন তিনি পথে খুব অসুস্থ হইয়া পডে়ন। দারোগা বদল হইলে, নতুন বড় বাবু চিন্তা করিয়া বলিলেন, আপনি বাড়িতেই সবসময় থাকিবেন। যখন খুসি আসিলে যেন আপনার সাক্ষাৎ পাই।


দারোগা আসিলে পিতৃদেব অতিথি হিসেবে তাঁহার যত্ন করিতেন। ভালো খাওয়াইতেন। এই ভাবে পুলিশি অত্যাচার হইতে আমরা খানিকটা রেহাই পাইয়াছিলাম। এদিকে সুশীল ধাড়া, সতীশ সামন্ত প্রভৃতির চেষ্টায় তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার গড়িয়া উঠিল। সেই সরকার ইংরাজ সরকারের সমান্তরাল ছিল। তাহার বিদ্যুৎ বাহিণী ছিল। যাহারা গোপনে ইংরাজকে সাহায্য করিত তাহাদের কঠিন শস্তি হইত। ঐ আমলের ঐতিহাসিক অমলেশ ত্রিপাঠিরা বেশ জমিজমার মালিক ছিল – তাহারা নানা ভাবে ইংরাজ শাসন পদ্ধতিকে সাহায্য করিত। ফল স্বরূপ জাতীয় সরকারের লোকেরা অমলেশ ত্রিপাঠিকে একটি ঘরে বন্দী করিয়া রাখে এবং তাহার দাদার নিকট মোটা পরিমান টাকার মুক্তি পন আদায় করিয়া তাহাকে ছাড়িয়া দেয়। এইসব কাহিনী এখনও লোকমুখে প্রচলিত।


Dr Suhrid Kumar Bhowmik, Amdabad, Nandigram, Medinipur, সুহৃদকুমার ভৌমিক, আমদাবাদ, নন্দীগ্রাম, মেদিনীপুর, Prabodh Kumar Bhowmik, অমূল্যরতন ভৌমিক, প্রবোধকুমার ভৌমিক, Amulyaratan Bhowmik
আমার দেখা আমার গ্রাম।

ঐ সমস্ত কিছুকে স্তম্ভিত করিয়া ৪৯ এর সাইক্লোন বা জলোচ্ছাস মেদিনীপুর জেলাকে ডুবাইয়া দিল। নানা রকম সেবা কর্মীর প্রয়োজন হইল। ঐসময়ের ঘটনার উল্লেখ পাই মহাত্মা গান্ধীর ব্যাক্তিগত সচীব অধ্যাপক নির্মল কুমার বসুর গান্ধীচরিত পুস্তকে এই ভাবে শুরু করিয়াছেন –


“১৯৪২ সালর দুর্গাপূজার সময় প্রচণ্ড ঝড় ও বন্যার আঘাতে মেদিনীপুর জেলা অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছিল। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও কাঁথি ও তমলুক মহকুমার অধিবাসীগন ইংরাজ সরকারের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষনা করিয়া নিজেদের সাধ্যমত দেশ শাসনের কাজ চালাইয়া যাইতে লাগিলেন। ইংরাজ সরকার সকল শক্তি প্রয়োগ করিয়াও তাঁহাদিগকে কাবু করিতে পারেন নাই। অবশেষে মুক্তি লাভ করিবার পর যখন কংগ্রেস কর্মীগনকে গোপন থাকিতে নিষেধ করিয়া দিলেন, তখনই শুধু মেদিনীপুরের কর্মীরা একে একে সরকারের নিকট আত্ম-প্রকাশ করিলেন। মেদিনীপুরবাসীর শৌর্য ও দৃঢ়তার কাহিনী শুনিয়া গান্ধীজী তাঁহাদিগকে যথোচিত প্রশংসা করিয়া ছিলেন। কিন্তু যে কাজ দেখিয়া তাঁহার মনে হইয়াছিল, কংগ্রেস কর্মীগন অহিংসার নিয়ম হইতে বিচ্যুত হইয়াছিল, সেগুলির জন্য তিনি তাঁহাদিগকে সমালোচনা করিতে বিন্দুমাত্র ইতস্তত করেন নাই।”


সেই সময় মহাত্মাগান্ধী মেদিনীপুরেই ছিলেন। বলিলেন, তোমাদের সংগঠনকে সেবার কাজে নিযুক্ত কর। দেশ স্বাধীন হইবেই বলিতে গেলে তখন ইংরেজ শাসনের শেষ প্রহর।


তখন মেদিনীপুরের সংগ্রামীরা একে একে অস্ত্র পরিত্যাগ করিলেন। যাঁহারা রাজবন্দী তাহাদের ছাড়িয়া দেওয়া হইল।


আমার বড়দা তিনচারিজন পরিচিত সঙ্গীকে সঙ্গী করিয়া বাড়ি ফিরিয়া আসিলেন। ঐসময়ের এক দিনের ঘটনা আমার স্মরণে আছে। দীর্ঘদিন আমি একাকি ছিলাম। বৌদি ও ভাইঝিদের সুন্দরবনের বাড়িতে পাঠাইয়া দেওয়া হইয়াছিল, তাঁহারা ফিরিয়া আসিলেন। সেজদা বাড়িতেই ছিলেন। সেই সময় গ্রামের লোকেরা ছুটিয়া আসিয়া বাড়িতে খবর দিল, প্রবোধ আসিতেছে।


মেজদা, একটা ধূতি ও সাদা ওড়না গায় দিয়া উপস্থিত হইলেন। আমি তখন নগ্ন আবস্থায় নিঃসঙ্গ ভাবে একাকি খেলা করিতেছিলাম। একজন আমাকে লইয়া গিয়া মেজদার কোলে দিয়া বলেন, রাণাকে চিনতে পার। মেজদা আমাকে কোলে লইয়া বলিলেন, “তুই এত বড় হয়ে গেছিস।” যখন আমি প্রায় দুই বছরের তখন তিনি বন্দী অবস্থায় জেলে যান, আমার কিছুই মনে থাকিবার কথা নহে।


মেজদা ঘরের প্রাঙ্গনে আসিয়াই মা ও দিদিমাকে জড়াইয়া ধরিলেন। তখন তাঁহাদের আর কান্নার শেষ নাই। ইতিমধ্যে আমাদের অনেক আত্মীয় বিয়োগ হইয়াছে। বড়দাদার একটি ফুটফুটে সুন্দর মেয়ে হইয়াছিল, সে এক বৎসর বয়সে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা গিয়াছে।


সুখ দুঃখের পরপারে আসিয়া সকলে একত্র হইলাম। পুরাতন দুঃখ বিদীর্ণ ঘটনার স্মৃতি সমূহ ধীরে ধীরে শিথিল হইয়া আসিল। দেশের স্বাধীনতাকে আহ্বান জানাইবার জন্য মানুষ ধীরে ধীরে প্রস্তুত হইতে লাগিল।


স্বাধীনতার পূর্বদিন রাত হইতে অর্থাৎ ১৪ই আগষ্ট রাত্রি বারোটায় শঙ্খধ্বনির মধ্যদিয়া দেশ স্বাধীন হইল। সেই সঙ্গে শুরু হইল হিন্দু মুসলমানের দাঙ্গা হাঙ্গামা, হাজার হাজার রিফিউজি আমাদের গ্রামেও চলিয়া আসিলেন ঘরবাড়ি ছাড়িয়া, অত্যাচারিত হইয়া অসংখ্য নরনারী আমাদের গ্রামে আশ্রয় লইল। “লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান” করিতে করিতে বহু হিন্দু গ্রাম লুন্ঠিত হইতে লাগিল। নানা রকম গুজব মানুষকে ভয়ার্ত করিয়া তুলিল। শোনা গেল নেহেরু সমস্ত বঙ্গদেশকে পাকিস্তানের নিকট দিতে চাহিয়াছে। ফলে আমাদের পরিবারের দূর সম্পর্কের কয়েকজন উড়িষ্যার বারিকনাতে ছিল, তাহাদের আশ্রয়ে চলিয়া যাইতে স্থির করিল।


ক্রমশ ...




M E D I N I K A T H A J O U R N A L

Edited by Arindam Bhowmik

Published on 25.08.2024



নিচে কমেন্ট বক্সে আপনার মূল্যবান মতামত জানান।