একবছর Probation Period-এর প্রথম বছর শেষ করলাম বাঁকুড়া শহরে। Probation Period-এর দ্বিতীয় বছরের জন্য আমার বদলি হল সোনামুখী থানাতে। বাঁকুড়া শহর থেকে পূর্ব দিকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সোনামুখী। মাঝে রয়েছে Beliator Forest Range। সোনামুখীর কিছুটা দূরে উত্তর-পূর্ব দিক দিয়ে বয়ে গিয়েছে দামোদর নদী।
সোনামুখী থানা
যাইহোক আবার সেই ট্রাঙ্ক ও বেডিং গুছিয়ে, পুলিশ ক্লাব থেকে বাসে চেপে পৌঁছে গেলাম সোনামুখী থানায়, তখন ১৯৮৯ সাল। আমার থাকার জায়গা হ'ল পুরাতন একটি কোয়ার্টারে। থানার বিল্ডিংটিও অনেক পুরানো, কিছু কিছু থানায় বিভিন্ন এলাকা দেখভালের জন্য আলাদা ইউনিট থাকে। এগুলোকে ফাঁড়ি বা আউটপোস্ট বলে। এই ধরণের ইউনিট পৌরসভা এলাকায় থাকলে তাকে 'টাউন আউটপোস্ট' (Town Out Post) বলা হয়। সংক্ষেপে আমরা Town Out Post-কে TOP বলতাম।
সোনামুখী থানা
সেইরকমই সোনামুখী থানার নিয়ন্ত্রণে একটি TOP ছিল। সেই TOP-এ অনেক ফোর্স থাকতো। থানার প্রয়োজনে TOP থেকে reinforcement করা হত। আমার কোয়ার্টারটা ছিলো, ওই TOP-এর প্রাঙ্গনেই। ওখানের মেসে দুইবেলা খেতাম। রাতের খাওয়ারটি বেশ ভালো লাগতো, তাই এখনো মনে আছে, মোটা মোটা রুটির সঙ্গে আলু-পটল-ঢেঁঢ়শ ভাজা।
সেই সময়ের একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে। সোনামুখী শহরের একটি পাড়া থেকে একটি পরিবার অভিযোগ জানায় যে, কিছুদিনের মধ্যেই তাঁদের বাড়ির মেয়ের বিয়ে। পাশের বাড়ীর সাথে মনোমালিন্য আছে। পাশের বাড়ী থেকে প্রতিদিন রাত্রে তাঁদের বাড়ীতে ঢিল পড়ছে। এদিকে বিয়ে উপলক্ষে বাড়ীতে আত্মীয় স্বজন আসছে। অভিযুক্তরা খুবই ভীত হয়ে আছেন। বিয়ের দিন যাতে কোনো ঝামেলা না করে তাই তাঁরা থানায় অভিযোগ করছেন।
স্বাভাবিক ভাবেই আমি যাদের বাড়ীর বিরুদ্ধে অভিযোগ সেই বাড়ীর কর্তাকে থানায় ডাকলাম। উনি ঢিল ছোঁড়ার কথা অস্বীকার করলেন। আমার তখন ব্যাপারটা ভালোভাবে জানার খুব ইচ্ছা হলো। এদিকে ঢিল পড়ার ঘটনা ঘটেই চলেছে। একদিন রাত্রে গোপনে আমি দু-জনের ফোর্স নিয়ে চুপচাপ দুই বাড়ীর মাঝখানে লুকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। দুইবাড়ীর উঠোনের মাঝে প্রাচীর। ওই প্রাচীরের দিকে লক্ষ্য রাখলাম। রাত তখন প্রায় একটা, একটা ঢিল অভিযুক্ত পরিবারের উঠোনের দিক থেকে, অভিযোগকারী পরিবারের বাড়ীর উঠোনে পড়লো। পরপর আরো কয়েকটা ঢিল একইভাবে পড়লো। বুঝতে কোনো অসুবিধা হলো না। সঙ্গে সঙ্গে অভিযুক্ত বাড়ীর দরজা খোলালাম। ওরা একটু influential ছিলো।
এতো রাত্রে কেন তাদের বাড়ীতে গিয়েছি, সেই নিয়ে খুব চিৎকার চেচামেচি করতে লাগল। আমি জোরের সাথে বললাম যে ওদের বাড়ী থেকেই ঢিল পড়ছে এবং আমাদের গোপনে লক্ষ্য করার ব্যাপারটাও জানালাম। ততক্ষণে পাশাপাশি অনেকেই চলে এসেছে। যাইহোক এরপর থেকে আর ঢিল পড়েনি। অভিযোগকারীর মেয়ের বিয়েও খুব নির্বিঘ্নে হয়েছিলো ।
সোনামুখী থানায় শিক্ষানবীশ থাকা কালীন আর একটা স্মৃতি আমার চিরকাল মনে থাকবে। সেদিন রাত্রি প্রায় সাড়ে দশটা হবে। হঠাৎ খবর এলো হাটতলায় আগুন লেগেছে। জায়গাটা থানা থেকে প্রায় দুই কিমি দূরে। ওই হাটতলায় প্রতিদিন বাজার বসে। অনেক স্থায়ী ও অস্থায়ী দোকান আছে। পাশাপাশি অনেক বসত বাড়ীও আছে। খবর পাওয়ার পর দ্রুত যতটা সম্ভব ফোর্স নিয়ে পৌঁছলাম ঘটনাস্থলে। থানার অফিসার ইন-চার্জও গেলেন। সময়টা গরমকাল। আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পডে়ছে। ফায়ার ব্রিগেডে খবর দেওয়া হোল। তখন একমাত্র বাঁকুড়া শহরে ফায়ার ব্রিগেড অফিস ছিলো। যতদূর মনে পড়ে, তখন মাত্র দু-টো ফায়ার ব্রিগেড গাড়ী ছিল। সোনামুখী থেকে বাঁকুড়ার দূরত্ব প্রায় ৪৫ কিমি। দুটো গাড়িই অন্য জাযগায় আগুন নেভানোর কাজে থাকায় আসতে দেরি হয়েছিল। সেই রকমই কন্ট্রোলরুম মারফৎ খবর পেয়েছিলাম। তাই অপেক্ষা না করে আমরা এবং স্থানীয় কিছু লোকজন মিলে কাছাকাছি জলের উৎস থেকে জল এনে আগুন নেভানোর কাজ করছিলাম।
হঠাৎ পাশাপাশি বাড়ীর ছাদ থকে আমাদের উপর ইঁটের টুকরো, পাথর, ডাবের খোলা ইত্যাদি ছোঁড়া শুরু হলো। আমাদের কয়েকজন আহত হয়েছিলো। খবর নিয়ে জানলাম, আগুন কেনো নিভছে না - সেই কারণেই আমাদের আক্রমণ করা হয়েছে। ব্যাপারটা শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। যারা পাথর ছুড়ছিলেন তারা যদি আমাদের কাজে হাত লাগাতেন তাহলে একটা কাজের কাজ হত, তা না করে ইঁট ছুড়ছেন। আক্রমণের ফলে আমাদের আগুন নেভানোর কাজ ব্যহত হচ্ছিল। ওসি বললেন যতটা সম্ভব নিজেদেরকে বাঁচিয়ে আগুন নেভানোর কাজ চালিয়ে যেতে। উত্তেজিত হতে বারণ করলেন, কারণ ওই সময় শান্ত হয়ে পরিস্থিতি নিজেদের আয়ত্বে রেখে আগুন যাতে আরো বেশী ছড়িয়ে না পড়ে, সেই চেষ্টা করছিলাম। কিছু সময় পরে ফায়ার ব্রিগেড পৌঁছয়। ওদের ওপরও ইঁট বৃষ্টি শুরু হয়। আস্তে আস্তে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। সেইদিন বুঝেছিলাম, প্রতিকূল পরিস্থিতি সামলাতে হলে, পুলিশকে কতটা ধৈর্য্যশীল হতে হয়।
আমরা পারতাম ওই সময়ই ওই সব লোকগুলোর বাড়ীতে ঢুকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে, কিন্তু শান্তি ও শৃঙ্খলার রক্ষার কারণে আমরা নিজেরা আহত হয়েও আগুন নেভানোর কাজে ছিলাম। কিছু লোক আমাদের সাহায্য করেছিলেন। যাইহোক পরদিন একটা দারুন ব্যাপার হল। বিকেলে শহরের বেশ কিছু মানুষ থানায় এসে আগের রাত্রে পুলিশের ওপর আক্রমণের জন্য দুঃখপ্রকাশ করলেন এবং পুলিশকে ধৈর্য্যশীলতার জন্য ধন্যবাদ জানালেন।
পরবর্ত্তীকালে বিভিন্ন আইন শৃঙ্খলা জনিত সমস্যা সামলাতে গিয়ে দেখেছি। দেখেছি উপস্থিত মানুষ জনের মধ্যে কিছু খারাপ লোক থাকেই। যারা সবসময় পরিস্থিত যাতে স্বাভাবিক না হয় তার চেষ্টা করে এবং বিভিন্নভাবে পুলিশের কাজে বাধা দেয়।
এবারে আপনাদের সেই সময়ে পুলিশের crime prevention ব্যবস্থা বিষয়ে বলি। তখন চৌকিদার-দফাদার ছিল গ্রামে। গ্রামের নির্দিষ্ট অঞ্চলে ভাগ ভাগ করে চৌকিদাররা থাকতো। তাদের কাজ ছিলো নিজের এলাকায় কোনো শান্তি ও শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, বাইরের অপরিচিত লোকের আনাগোনা, bad character ইত্যাদির খোঁজ রাখা। এদের কয়েকজনের উপর এক এক জন দফাদরে নিযুক্ত থাকতো।
প্রতি শুক্রবার থানায় চৌকিদারি প্যারেড হতো। ওইদিন সবাই আসতো এবং খবর আদান প্রদান হতো থানায় কর্মচারীদের সাথে। এইভাব তখন পুলিশ গ্রামের দিকের crime prevention করতো। চৌকিদারি ব্যবস্থা খুব সম্ভবত ১৯৯১ - ১৯৯২ সালের পরে উঠে যায়।
তখন শহরে Beat Patrol চালু ছিলো। একে Disc Petrol ও বলা হতো। শহরের কিছু এলাকা নিয়ে একটা করে Beat এলাকা ছিল। এরকম হয়তো একটা শহরে দশটা বিট। রাত্রি বেলায় ঐ রাত্রের জন্য নিযুক্ত অফিসার প্রত্যেক বিটে একটি করে বিভিন্ন রঙের Disc (গোল চাকতির মতো দেখতে) কোনো স্থানে রেখে আসতো। সেই বীটের Night Patrol-এ নিয়োজিত কনস্টেবলরা সমস্ত বীট এলাকা সাইকেলে বা হেঁটে ঘুরতো এবং ওই Disc খুঁজে বের করতে হতো। এর উদ্দেশ্যে ছিল, কনস্টেবলদের Disc খোঁজার জন্য বাধ্য হয়েই সমস্ত এলাকা Patrolling করতে হত। এইভাবে তখন শহর এলাকায় Anti Crime Patrolling হতো। তবে ওই ব্যবস্থাও এখন আর নেই।
অবশ্য সেই সময় গ্রাম থেকে শহরে এসে এতো মানুষজন বসবাস করতে শুরু করেনি। এখন শহরের জন সংখ্যা অনেক বেড়েছে। গ্রাম থেকে মানুষ বিভিন্ন জীবিকা ও সুযোগ সুবিধার জন্য শহরে এসে বসবাস করতে শুরু করছে। যার ফলে পুলিশের Patrolling-এর ধরনও পাল্টেছে। তবে বিট ব্যবস্থা এখনও আছে।
পুলিশি অভিজ্ঞতার পাশাপাশি যে শহরে বাস করতাম সেই সোনামুখী সম্বন্ধেও আপনাদের কিছু বলতে চাই। সোনামুখী শহরের কালীপূজা ও কার্ত্তিক পূজা খুব ধুম ধামের সাথে পালন হয়। সেইসময় সর্বজনীন এবং ব্যক্তিগত মিলিয়ে প্রায় ২০০টি কালিপূজা হত। স্বাভাবিকভাবেই পুজোর সময় বাইরের বেশীরভাগ আত্মীয় স্বজন এসে উৎসবে সামিল হত। বড়ো বড়ো ডাক সাজের মূর্ত্তি হত, দেখতে খুব সুন্দর লাগতো। বিখ্যাত কালী পুজোর মধ্যে মাইত কালীমা খুবই জাগ্রত। এছাড়াও আছে বড়ো কালী। সার্ত্তিস কালি, শিবকালী, ভদ্রকালী, দক্ষিখন্ড কালী। প্রায় ৪/৫ দিন চলে উৎসব। বিসর্জনের দিন বিকেল নাগাদ সব ঠাকুর ভাসানোর জন্য দালান থেকে ওঠে, পরদিন ভোর থেকে পুকুরে ভাসানো শুরু হয়। প্রচুর পুলিশ ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা থাকে নির্বিঘ্নে ভাসান হওয়ার জন্য।
সোনামুখী বড় কালী
বহুবছর আগে বর্গীদের আক্রমণ হতো। সেই সময় বর্গীরা একদিন কালীমা-র স্থানের পাশ দিয়ে যাবায় সময় সন্ধেবেলায় সেবাইতের মেয়ের দিকে কুমতলব নিয়ে যায়। সেবাইতের মেয়ের কাছে পৌঁছনোর আগেই সেই বর্গীদের চোখ অন্ধ হয়ে যায়। তখন ওরা মায়ের স্থানে ওদের দোষ স্বীকার করে। তখন মা স্বপ্নে ওই সেবাইতের মেয়েকে বর্গীদের উপরে ঘটের জল ছিটিয়ে দিতে বলেন। মায়ের কথামতো জল ছিটিয়ে দিতেই তারা আবার দৃষ্টি শক্তি ফিরে পায়। তখন ডাকাতরাই নাম দেয় মা-ই-ত মা।
সোনামুখী মাইত মা
এবার আসি হরনাথ বাবা প্রসঙ্গে। সোনামুখী শহরের মাঝেই হরনাথ বাবার মন্দির, তার পাশেই বিশাল কাঠাল বাগান। প্রায় দেড়শ বছর আগে সোনামুখী ব্যানার্জী পাড়ায় হরনাথ বন্দোপাধ্যায়ের বাড়ী ছিলো। ওনাকে বাকসিদ্ধ পুরুষ বলা হত। যতদূর শুনেছি উনি কাশ্মীরে রাজার বাড়ীতে চাকরী করতে গিয়েছিলেন। ওখানের লোকজন ক্রমশ বুঝতে পারেন উনি কোনো সাধারণ মানুষ নয়, যা বলেন তাই ফলে যায়।
সোনামুখী মধ্যম কার্তিক
হরনাথ ঠাকুর প্রতিদিন সকালে নদীতে যেতেন, সেখানে স্নান করে সাধনা করতেন। সেইসময় দক্ষিণ ভারতীয় একজন ভদ্রলোক উপলব্ধি করেন যে হরনাথ কোন সাধারণ ব্যাক্তি নয়। ওই দক্ষিণ ভারতীয় ভদ্রলোক তখন ওনার প্রচার শুরু করেন। পরে ওনাকে অন্ধ্রপ্রদেশে ওনার বাড়ী নিয়ে যান। সেখানে ওনার প্রচার শুরু হয়। এইভাবে ওনার ভক্ত ছড়িয়ে পড়ে। সেইজন্য ওনার দক্ষিণ ভারতীয় ভক্ত বেশী। সোনামুখীতে ওনার নিজেদের জায়গাতে ভক্তরা হরনাথ বাবার মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতি বছর দুর্গাপূজার চতুর্থী থেকে দশমী পর্যন্ত বড়ো করে উৎসব হয়। ওকে নামসপ্তাহম বলে। প্রচুর দক্ষিণ ভারতীয় শিষ্য ওই কয়েকদিন মন্দির প্রাঙ্গনে অতিথিশালায় এসে থাকে।
এরপর আসি সোনামুখীর রেশম শিল্পে। এটি সোনামুখীর একটি প্রধান অর্থকরী ব্যবসা। এই শহরের কৃষ্ণবাজার, দেওয়ান বাজারে অনেক তাঁতি সম্প্রদায়ের মানুষ আছেন। মেদিনীপুর জেলার বিশেষত ঝাড়গ্রাম এবং ঝাড়খন্ড রাজ্য থেকে রেশম গুটি আনা হয়। সেই রেশম গুটি থেকে চরকা দিয়ে রেশম সুতা তৈরী হয়। ওই রেশম সুতো দিয়ে তৈরী হয় শাড়ী। কাপড়ের থান। ওই শাড়ীর থান কলকাতা বা বাঁকুড়া জেলায় বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি হয়। এটাই ছিলো মুল জীবিকা। এখনও আছে। সোনামুখী সিল্কের যথেষ্ট খ্যাতি আছে।
কলকাতায় ব্যবসায়ীদের কাছে যাবার কারণে কিছু কিছু কাবুলি ওয়ালাদের সাথেও তাঁতিদের যোগাযোগ হয়। ওরাও সোনামুখী সিল্ক তৈরী দেখতে আসা শুরু করে। এইভাবে সিল্কের 'পাগড়ী' তৈরী শুরু করে তাঁতিরা। সুদূর আফগানিস্থানেও সোনামুখীর রেশম-এর তৈরী 'পাগড়ী' স্থান পেয়েছে।
সোনামুখী রেলওয়ে স্টেশন
এবার 'বড় দুঃখের রেল'-এর কথা না বললেই নয়। আসল নাম Bankuda Damodor Railway (BDR). তখন ওটা ন্যারো গেজ লাইন ছিলো। ভোরবেলায় বাঁকুড়া স্টেশন থেকে রওনা হয়ে রায়না (বর্ধমান জেলা) পর্যন্ত গিয়ে সন্ধেবেলায় বাঁকুড়া ফিরে আসতো। সময়ের কোনো ঠিক ছিল না। যাত্রী ও খুব কম। মানুষজন বনের কাঠ, পাতা ওইসব নিয়ে ওই ট্রেনে উঠতো। তাই ওকে সবাই 'বড়ো দুঃখের রেল' বলতো। ট্রেনটি সোনামুখী, পাত্রসায়ের, ইন্দাস হয়ে রায়না যেত। ২০০৪ সালে ৩টি ব্রডগেজ লাইন হয়। মাঝে অনেকদিন ওই লাইন বন্ধ ছিল। ২০২৫ সালের ওই লাইন হাওড়ার সাথে যুক্ত হয়ে যাবার কথা আছে।
দীর্ঘ পুলিশ জীবনের বহু ভালো-মন্দ অভিজ্ঞতা হয়েছে। বিভিন্ন শান্তি শৃঙ্খলা বিঘ্ন হওয়ার সম্ভাবনা আগাম খবর পেয়ে পুলিশ ডিপার্টমেন্ট বহু দুর্ঘটনা প্রতিহত করে, সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা দেয়। এরকম বহু ঘটনা আছে। একে 'Intelligence led pre emptive action' বলে।
সোনামুখী থানা
বহু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আগাম খবর সংগ্রহ করে পুলিশ দাঙ্গা প্রতিহত করে। জনজীবন শান্ত রাখে। পুলিশের এই কর্মকান্ড সাধারণ মানুষ বুঝতেও পারে না। পরবর্ত্তী সময়ে আমি ওই সোনামুখী থানায় অফিসের-ইন-চার্জ হয়ে জয়েন করেছিলাম এবং ওখান থেকেই Promotion নিয়ে পুরুলিয়া জেলায় চলে গেছিলাম।
সোনামুখী 'বড়ি মন্ডা'
সোনামুখীর কারিগররা এক বিশেষ আকৃতির মন্ডা বানায়। একে 'বড়ি মন্ডা' বলে। জলের বড়ি যেমন দেখতে হয়। তার থেকে একটু বড়ো সাইজ। শীতকালে নলেন গুড়ের বড়ি মন্ডার স্বাদ খুব উপাদেয়।
আর একটা খুব গুরুতমপূর্ণ তথ্য জেনেছিলাম। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ঐকান্তিক চেষ্টায় ভারতবর্ষে প্রথম হিন্দু বিধবা বিবাহ শুরু হয়। ওই ঐতিহাসিক বিধবা বিবাহের পাত্রী ছিলেন বাঁকুড়া জেলার সোনামুখী ব্লকের ডিহিপাড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের পলাশ ডাঙা গ্রামের ছয় বছরের বিধবা কন্যা কালীমতি দেবি (যদিও অধিকাংশ জায়গায় বর্ধমান জেলার পলাশডাঙ্গার কথা উল্লেখ রয়েছে)। কালীমতি দেবির পিতা ব্রহ্মানন্দ মুখোপাধ্যায় এবং মাতা লক্ষ্মী দেবী।
দূর্গাপূজার দিনগুলিতে প্রথম প্রথম মন খুব খারাপ লাগতো। সবাই নূতন জামা, কাপড় পরে ঠাকুর দেখছে। আমরা খাঁকি উর্দি পরে পূজা মণ্ডপে, রাস্তাঘাটে crowd control, Traffic Control করতাম যাতে সাধারণ মানুষ সুস্থভাবে পূজার আনন্দ উপভোগ করতে পারে। District Intelligence Branch থেকে Police agreement বেরোয়। সমস্ত পুলিশ কর্মচারীর ছুটি বন্ধ হয়ে যায়। emergency কারণ ব্যতীত।
পরে পরে বুঝতে পারলাম যে কর্ত্তব্য পালন করে সাধারণ মানুষের সেবা করছি। থানায় কতরকমের সমস্যা নিয়ে মানুষ আসতো। অনেক মহিলা আসতো, বিশেষ করে গরীব যারা, ওই অভিযোগ নিয়ে যে ওদের স্বামী মারধোর করছে, মদ খাচ্ছে। গরু-ছাগলে জমির ফসল নষ্ট করছে। কেউ টাকা ধার নিয়ে দিচ্ছে না ইত্যাদি। চেষ্টা করতাম যতটা সম্ভব সমস্যা মেটাতে। খুব ভালো লাগতো যখন ওই গরীব মানুষগুলো তাদের সমস্যা মিটিয়ে হাসিমুখে ফিরে যেত। তখন নিজের এই খাঁকি পোশাকটার প্রতি গর্ব হতো।
পুলিশ বিভাগ সর্বদাই বিভিন্নভাবে জনসংযোগ করে, সাধারণ মানুষকে নিরাপদে থাকতে সাহায্য করে। রাত্রে গাড়ীর ড্রাইভার, গাড়ী চালানোর সময় যাতে ঘুমিয়ে না পড়ে। সেইজন্য রাত্রিবেলায় চা খাওয়ানো হয় যাতে দুর্ঘটনা রোধ হয়।
পুলিশে চাকরী করেছি বলেই এই সব সম্ভব হয়েছে তাই কয়েকটা ইংরেজি শব্দ পাঠককে জানাই Khaki is not just a uniform, but it is an undying spirit, a resolution and a selfless act of service that we wear (সংগৃহীত).
যাইহোক বাঁকুড়া জেলা ও আরো বিভিন্ন জেলায় চাকরী করার সুযোগ হয়েছে, সেইসব দিনগুলোর বিভিন্ন ঘটনাবলী, সাফল্য, ব্যর্থতা জানানোর ইচ্ছায় রইলাম।