ফেলে আসা দিনগুলি
Memoirs of Sabyasachi Sengupta, Retired Deputy Superintendent of Police, Paschim Medinipur
শ্রী সব্যসাচী সেনগুপ্ত
Home » Medinikatha Journal » Sabyasachi Sengupta » ফেলে আসা দিনগুলি
তখন ১৯৮৬ সাল। সেই বছরই ব্যারাকপুর পুলিশ ট্রেনিং কলেজ থেকে আমার প্রশিক্ষণ শেষ হয়। এরপর কর্মজীবনের শুরু। আমার প্রথম পোস্টিং হলো বাঁকুড়া জেলায়। তখন আমি সাব ইন্সপেক্টর অফ পুলিশ। মনের মধ্যে একটা সুন্দর অনুভূতি ছিল সেদিন। সম্পূর্ণরূপে অজানা একটি জায়গায় প্রথম যাচ্ছি চাকরি করতে। ট্রেনিং কলেজ থেকে বাঁকুড়া যাওয়ার আগে গিয়েছিলাম মেদিনীপুরে আমার বাড়িতে। তখন জয়েনিং লিভ পাওয়া যেত, সেই ছুটি কাটিয়ে ট্রেনে করে রওনা দিলাম বাঁকুড়া। সঙ্গে একটা কালো রঙের ট্রাঙ্ক। সেই ট্রাঙ্কে কি নিয়ে যাবো, সেই নিয়ে আমাকে খুব-একটা ভাবতে হয়নি কারণ বাবা-মা সব গুছিয়ে দিয়েছিলেন। এছাড়াও সঙ্গে ছিল একটা বেডিং। বাঁকুড়া স্টেশন পৌঁছে অটো রিক্সায় চেপে চললাম রিজার্ভ অফিস। সেই অফিসেই জয়েন করলাম। এখনো মনে পড়ে, প্রথম দিনটা খুব ভালো লাগছিলো। আমরা চার ব্যাচমেট। সেইদিনই শুরু হলো আমার ছয় মাসের Probation Period, আমার পোস্টিং হয়েছিল গঙ্গাজলঘাটি থানায় (Gangajalghati Police Station)। বাকি ব্যাচমেটদের বিভিন্ন থানায় পোস্টিং হলো। প্রথম রাত্রি আমরা বাঁকুড়া পুলিশ ক্লাবে ছিলাম। জায়গাটা মাচান তলায়। পরেরদিকে এই মাচানতলা নামকরনের ইতিহাস জেনেছিলাম।
Barrackpore police training academy
পরেরদিন সকালবেলায় বাস ধরে পৌঁছলাম গঙ্গাজলঘাটি থানায়। বাঁকুড়া থেকে উত্তর দিকে প্রায় ২৫ কিমি দূরে গঙ্গাজলঘাটি। মাঝে কাঞ্চনপুর, গোবিন্দধাম, অমরকানন, কৌডো পাহাড়ে বাস থামে। গঙ্গাজলঘাটি থেকে আরো উত্তরে গেলে দামোদর নদী। নদী পেরোলেই রানীগঞ্জ। গঙ্গাজলঘাটি থেকে রানীগঞ্জ প্রায় ২৫ কিমি দূরে। তখন এখনকার মতো এতো জনবসতি ছিল না। রাস্তাঘাট প্রায় ফাঁকাই থাকতো। রাস্তার দুধারে শাল, সেগুন, আকাশমনি গাছের সারি দেখলেই মনটা ভালো হয়ে যেত। থানায় পৌঁছে অফিসার-ইন চার্জের কাছে রিপোর্ট করলাম। থানা বিল্ডিং খুব পুরানো। পিছনে একটা প্রকান্ড বটগাছ, চারিদিকে ঝোপঝাড়। থানার ঠিক উপরেই একটি ঘরে আমার থাকার জায়গা হলো। বারান্দায় একপাশে সার্কেল ইন্সপেকশন অফ পুলিশের অফিস। আমার ঘরের পাশেই ছিল রেডিও-কন্ট্রোল-রুম। তখনকার দিনে এই রেডিও টেলিফোনের মাধ্যমেই পুলিশের সমস্ত খবর আদান প্রদান হত। ঘরে ঢুকে একটা লোহার খাটে আমার বেডিং বিছালাম। পাশে সেই ট্রাঙ্ক। সেই কালো ট্রাঙ্কটি আজও আমি যত্ন করে রেখেছি। ট্রেনিংএ যাওয়ার সময়েও ওই ট্রাঙ্কেই বাবা সব গুছিয়ে দিয়েছিলেন। তখনকার দিনের থানাগুলোতে সাধারণত দুজন এস.আই এবং দুজন এ.এস.আই থাকতো। এস. আই.-দের মধ্যে সিনিয়রকে অফিসার ইন চার্জ বলা হতো। আমার খাওয়ার ব্যবস্থা হল থানার একটি মেসে। তখনকার দিনে থানা কম্পাউন্ডে কিছু ছোট ছোটো রান্নাঘর থাকতো। চৌকি বলতো যদি কেউ আলাদা রান্না করতে চায়। বিশেষত বিভিন্ন সম্প্রদায়ের কর্মচারীর কথা ভেবেই এই ব্যবস্থা ছিল।
প্রথমদিকে থানার বিভিন্ন রেজিস্টার লেখা শিখতে লাগলাম। মালখানা-রেজিস্টার, খতিয়ান-রেজিস্টার, ওয়ারেন্ট-রেজিস্টার, সমন-রেজিস্টার ইত্যাদি। ধীরে ধীরে থানার অফিসারদের সাথে বাইরে তদন্তে যাওয়া শুরু করলাম। বিভিন্ন অভিযোগের উপর তদন্ত হত। তখন ১৯৮৭ সাল, সেই সময় পাশেই দুর্লভপুর গ্রামের এবং আশেপাশের জায়গা নিয়ে তৈরী হচ্ছিল 'দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন।' সে এক বিরাট কর্মযজ্ঞ। ওখানকার লেবার সমস্যা, ট্রাকের মাল লোডের সমস্যা হলে অফিসারদের সাথে আমি যেতাম। কোন ফ্যাক্টরির শুরুর দিকে কি কি ধরণের সমস্যা হয় সেই অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমার। আজ অবসর গ্রহণের পরে আমিও একটি ফ্যাক্টরিতে উপদেষ্টা বা এডভাইসর হিসেবে কর্মরত। সেই সময়ের অভিজ্ঞতা এখন কাজে লাগছে।
Gangajalghati police station
এক রাত্রের কথা আমার খুব মনে পড়ে। আমি Night Patrolling-এ ছিলাম। থানার পাশেই জঙ্গলের মাঝদিয়ে রাস্তা চলে গিয়েছে। প্রায় মাঝরাত নাগাদ সেই জঙ্গলের রাস্তায় গরুর গাড়ী থেকে এক মহিলার চিৎকার শুনতে পেলাম। গিয়ে দেখলাম যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে। সঙ্গে বাড়ীর লোকজন রয়েছেন। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম যে মহিলাকে অমরকানন হাসপাতাল নিয়ে যাচ্ছে। মহিলার ঠিক কি হয়েছিল আজ আর মনে নেই।
হাসপাতাল ওখান থেকে প্রায় ১০ কিমি দূরে। মহিলার অবস্থা দেখে আমার খুব চিন্তা হল। আমি ওনাদের বললাম, আমার জিপে আপনারা অসুস্থ মহিলাকে নিয়ে বসুন। আমি আপনাদের পৌঁছে দেবো। সেই রাত্রে অসুস্থ মহিলাকে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পৌঁছে দিয়ে খুব ভালো লেগেছিলো। পরেরদিন সকালে অফিসার-ইন-চার্জ-কে ঘটনার কথা বলি। উনি শুনে বললেন খুব ভালো করেছো। কিন্তু তার সাথে একথাও বললেন, যদি পুলিশের গাড়ীতে মহিলার কিছু হয়ে যেতো, তাহলে সবাই পুলিশকে দোষারোপ করতো। অনেকক্ষেত্রেই পুলিশ ভালো করতে গিয়ে দোষারোপের শিকার হয়।
অমরকানন গ্রামের নামটা খুব সুন্দর, এখানেই গঙ্গাজলঘাটি ব্লকের বিডিও অফিস এবং হাসপাতাল অবস্থিত। অমরকাননের কাছেই কোড়ো নামের ছোট্ট গ্রামে অবস্থিত কোড়ো পাহাড় (Koro hill)। প্রায় চারশো ফুট উঁচু। এখানে অনেকেই ট্রেকিং ও বনভোজন করতে আসে। খুব সুন্দর মনোমুগ্ধকর জায়গা। পাহাড়ের টিলায় একটি মন্দির আছে। ওই পাহাড়ে আমিও উঠেছি অনেকবার।
অমরকাননের একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আছে। এখানে শ্রী রামকৃষ্ণ সেবাদল আশ্রম আছে। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় মহাত্মাগান্ধী, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস এই অমরকাননে এসেছিলেন। কাজী নজরুল ইসলাম একাধিকবার এই অমরকাননে এসেছিলেন। "অমরকানন" ছিল তাঁর খুবই প্রিয়। ঋষিকল্প গোবিন্দপ্রসাদ ছিলেন তাঁর বন্ধুর মত। তাঁর আহ্বানে অমরকাননে বহুবার এসেছেন নজরুল। অমরকাননে সেই বিখ্যাত বটগাছে বসে লিখেছেন "অমরকানন সঙ্গীত" নামে বৃহৎ একটি গান, আজও অমরকাননবাসীর মুখে মুখে শোনা যায় সেই গান--
"অমরকানন মোদের অমর কানন।
বন কে বলেরে ভাই আমাদের এ তপোবন, আমাদের এ তপোবন॥
(এর) দক্ষিণে শালি নদী কুলু কুলু বয়,
কূলে তার শাল তরু ফুলে ফুলময়,
হেথা ভেসে আসে জলে দখিনা মলয়,
হেথা মহুয়ার মৌ খেয়ে মন উচাটন।
বন কে বলেরে ভাই আমাদের এ তপোবন, আমাদের এ তপোবন॥
দূর প্রান্তর ঘেরা আমাদের বাস,
দুধ হাসি হাসে হেথা কচি দুব ঘাস,
উপরে মায়ের মত চাহিয়া আকাশ
বেনু বাজা মাঠে হেথা চরে ধেনুগণ।
বন কে বলেরে ভাই আমাদের এ তপোবন, আমাদের এ তপোবন॥
প্রহরী মোদের ভাই পুরবী পাহাড়,
শুশুনিয়া আগুলিয়া পশ্চিমী দ্বার,
ওড়ে উত্তরে উত্তরী কানন বীথার,
দূরে ক্ষণে ক্ষণে হাতছানি দেয় তালিবন।
বন কে বলেরে ভাই আমাদের এ তপোবন, আমাদের এ তপোবন॥
(হেথা)মাঠ ভরা ধান নিয়ে আসে অঘ্রাণ,
প্রাণে ফুটে ফুল হেথা ফুলে ফোটে প্রাণ,
রাখাল সাজিয়া হেথা খেলে ভগবান,
মোরা নারায়ণ সাথে খেলা খেলি অনুক্ষণ।
বন কে বলেরে ভাই আমাদের এ তপোবন, আমাদের এ তপোবন॥
মোরা নিজ হাতে মাটি কাটি, নিজে ধরি হাল,
খুশি ভরা বুক হেথা, হাসি ভরা গাল,
(মোরা) বাতাস করিয়ে ভেঙে হরিতকী ডাল,
হেথা শাখায় শাখায় পাখি গানের মাতন।
বন কে বলেরে ভাই আমাদের এ তপোবন, আমাদের এ তপোবন॥
বটতলা ঘিরি মোরা করি গীতাপাঠ,
আমাদের পাঠশালা চাষী ভরা মাঠ,
গাঁয়ে গাঁয়ে আমাদের 'মায়েদের হাট',
ঘরে ঘরে ভাই বোন বন্ধু স্বজন।
বন কে বলেরে ভাই আমাদের এ তপোবন, আমাদের এ তপোবন॥
যাঁর নামে এ কানন বীর সে অমর,
আয় ভাই নমি তাঁরে মাগি তাঁর বর,
তাঁহারই পতাকা সবে আয় তুলে ধর,
যাঁর গুণে তপোবন হয়েছে এ বন।
বন কে বলেরে ভাই আমাদের এ তপোবন, আমাদের এ তপোবন॥
অমরকানন মোদের অমরকানন॥
এছাড়াও কিছুদুরে আছে গাংদুয়া ড্যাম (Shali Water Reservoir)। শালী নদীর উপর অবস্থিত এই বাঁধ। বাঁধের পিছনে বিশাল জলাধার। এটাও পর্যটনের জায়গা। বাঁকুড়া শহর থেকে প্রায় ২৪ কিমি দূরে অবস্থিত। কিছু দূরেই অবস্থিত বিপ্লবী গোবিন্দপ্রসাদ সিংহের নামে গোবিন্দধাম গ্রাম। তাঁর নামেই বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল। সময়ের সাথে সাথে বহু পরিবর্তন হয়েছে। এখন আসানসোল বা দুর্গাপুর গেলে ওই গঙ্গাজল ঘাটি উপর দিয়ে যাবার সময় দেখি অনেক পরিবর্তন হয়েছে। রাস্তাঘাট চওড়া। থানা বিল্ডিংটাও নতুনকলেবরে।
Shali Water Reservoir
ছয়মাসের Probation Period শেষ করে ফিরে এলাম বাঁকুড়া। আবার সেই মাচানতলায় পুলিশ ক্লাব। অনেক দিনের পুরানো দোতলা বাড়ী। ক্লাবের মেসের রাঁধুনি সুবলদা রান্না ছিল খুব সুন্দর। অল্প সময়ে সবার পছন্দের খাওয়ার বানিয়ে দিতো। ক্লাবের ছাদটা ছিল আমাদের আড্ডা মারার জায়গা।
সেই সময় এই মাচানতলা জায়গাটির নামকরণের ইতিহাস জেনেছিলাম। এই জায়গায় স্বাধীনতা আগে একটা Watch Tower ছিল। যাকে বাংলায় মাচা বললেও স্থানীয়ভাবে মাচান বলা হয়। সেই থেকেই জায়গার নাম হয় মাচানতলা। এটি বাঁকুড়া শহরের প্রায় কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। এই মাচানতলার কাছেই বঙ্গ বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়টি একটি প্রাচীন অট্টালিকার উপরে অবস্থিত। সম্ভবত ২০১১/১২ সাল নাগাদ স্কুলের মেরামতির কাজের জন্য মাটি খোঁড়া হয়েছিল। সেই সময় মাটির নিচে পুরানো দিনের ইটের ঘরের নিদর্শন পাওয়া যায়।
ব্যাপারটা প্রশাসনিক মহল ও পুরাতত্ত্ব বিভাগে জানানো হয়। লোকমুখে জানা যায় যে আগে ওই জায়গায় পথিকদের জন্য বড় সরাইখানা ছিল। সঙ্গে হাতিশাল, ঘোড়াশালও ছিল। সেইসময় এই টুকুই জেনেছিলাম। পরে কি হল আর খবর নেওয়া হয়নি।
যাইহোক এই বাঁকুড়া শহরেই আমার Probation Period-এর বাকি সময় শেষ হয়। এই বাঁকুড়া জেলায় বিভিন্ন জায়গায় আমি ও আমার পরিবার প্রায় ২২ বছর কাটিয়েছি। লাল মাটির জেলার সেই সময়ের অভিজ্ঞতা আপনাদের জানানোর ইচ্ছা রইলো।
ক্রমশ ...
M E D I N I K A T H A J O U R N A L
Edited by Arindam Bhowmik
Published on 30.08.2024
নিচে কমেন্ট বক্সে আপনার মূল্যবান মতামত জানান।