দাঁতন-মোহনপুরের বিলুপ্তপ্রায় 'সিয়ালগিরি' সম্প্রদায়ের কথা  | Extinct 'Sialgiri' Community of Dantan-Mohanpur

দাঁতন-মোহনপুরের বিলুপ্তপ্রায় 'সিয়ালগিরি' সম্প্রদায়ের কথা | Extinct 'Sialgiri' Community of Dantan-Mohanpur

সন্তু জানা।

"লাউডু খাইন সানঝু যাসো” - অর্থাৎ “ভাত খেয়ে সন্ধ্যায় যাবেন”।

কথাটা শোনা মাত্রই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম মানুষটির দিকে। গোবর-মাটির জাপ দেওয়া একটিমাত্র ঘর। ফুটিফাটা খড়ের চালা। সামান্য একটু উঠোনে মাস-ছয়েকের শিশুটি কাঁথামুড়ি দিয়ে দোলনায় দুলছে। ঘোমটার অন্দরে বিস্ময়াভিভূত মুখটি লুকিয়ে একনাগাড়ে দুলিয়ে চলেছে যুবতী-মা। চারদিকে চরম দারিদ্যের সহস্র প্রমাণ। অথচ অতিথি-আপ্যায়নে দরিদ্র নন ষাটোধর্ব পৌড় ভজহরি পাত্র। ইনি হলেন ওড়িশা সীমান্তবর্তী দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার সোলপাট্টা গ্রামে বসবাসকারী বিলুপ্তপ্রায় প্রায় জনজাতি “সিয়ালগিরি” সম্প্রদায়ের মানুষ। বিলুপ্তপ্রায় জাতি ও ভাষার অনুসন্ধানে “দণ্ডভুক্তি” পত্রিকার পক্ষ থেকে নেওয়া এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের শেষে হাতে বোনা চাটাইয়ে বসেই আমার হাত দুটি ধরে মধ্যাহ্নভোজের সাদর আমন্ত্রণ জানিয়ে রাখলেন আবেগান্বিত ভজহরিবাবু এবং তাঁর পরিবার। স্ত্রী কাঞ্চনলতা (৪৫), তিনপুত্র হরিশচন্দ্র (২৯), হরেকৃষ্ণ ও হরিপদ এবং এক পুত্রবধূ কবিতা (২৬), ভ্রাতুষ্পুত্র চন্দ্রকান্ত (২৮) সহ মোট দশজন সদস্য নিয়েই ভজহরি পাত্রের পার্থিব জগৎ-সংসার। কষ্টের সংসার। কিন্তু তবুও একবেলা কাজ ভুলে পুরনো স্মৃতি রোমন্থনে ভেসে গেলেন। পরিবারের মধ্যে একমাত্র ইনিই “সিয়ালগির' ভাষায় কথা বলতে পারেন। এখনও ভাষার গাম্ভীর্যে ধরে রেখেছেন পূর্বপুরুষের স্মৃতি। কিন্তু প্রশ্ন হল এই “সিয়ালগিরি” কারা? কেবলমাত্র বাংলা-ওড়িশা সীমানাবর্তী দাতন-মোহনপুর ও ওড়িশার জলেশ্বর থানার বিভিন্ন প্রান্তের মধ্যে এদের বসবাসক্ষেত্রের সীমাবদ্ধতাইবা কেন? কি এদের পরিচয়?

শুনেছি এরা নাকি যাযাবর জাতি। নৃতত্ত্বের ভাষায় 'semi-nomadic' ধরনের মানুষ। জীবনযাপনের প্রয়োজনে দল বেঁধে একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে বাসা পরিবর্তন করে। ভবিষ্যৎ্বাণী করে, যাদু দেখিয়ে, বিষাক্ত সর্প সম্মোহিত করে এবং জড়ি-বুটি ওষুধ বিক্রি করে উপার্জন করে। আর বন্যপ্রাণী শিকার করে ভক্ষণ করে।

দাঁতন-মোহনপুরের বিলুপ্তপ্রায় 'সিয়ালগিরি' সম্প্রদায়ের কথা  | Extinct 'Sialgiri' Community of Dantan-Mohanpur

চকিতে মনে পড়ল সুদূর শৈশবের ছায়াছবি। তখন ১৯৯২ সাল। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়াশুনো করি। বেশ মনে আছে, দাঁতনের সরাইবাজার অঞ্চলে আমাদের বাড়ির উঠোনে বিশালাকায় আম্রকুঞ্জের ছায়ায় পসার পেতে বসেছিল একটি গল্প-বলিয়ের দল। দুজন মহিলা, দুজন পুরুষ আর ওদের চার সন্তান। মলিন দেহ, তেলবিহীন জটপাকান কেশরাশি, অবাঙালী কায়দায় পুরনো ময়লা পোষাক পরিহিত মানুষগুলো বিভিন্ন রকমের মাটির পুতুল, পুঁথির গয়না, বাসনপত্র, হস্তশিল্প ও চিত্র সহযোগে হাত-সাফাইয়ের খেলা দেখাচ্ছে আর অনর্গল কোন এক দুর্বোধ্য ভাষায় গল্প বলে চলেছে। ওরা যাযাবর। ওরা নাকি চৌর্যবৃত্তির মাধ্যমে অন্নসংস্থান করে। মাঝে মধ্যেই দাঁতন শহরে এসে ঘাঁটি গেড়ে বসত শুনেছি। প্রায় ২৫ বছর আগে দাঁতনের ভট্টর মহাবিদ্যালয়ের পার্বতী পুকুরের পাড়ে অসংখ্য ঝাউগাছের আবডালে তাবু খাটিয়ে ওরা মাসখানেক সময় অতিবাহিত করেছিল।

ছেলেবেলায় যাদের অদ্ভুত পোশাক-আশাক, চালচলন, উচ্চারণের দুর্বোধ্যতায় অনুপ্রবেশ করেছি পরিচিত জগতের বাইরে অন্য কোন এক দেশে। বিভিন্ন প্রকার কাক-পক্ষী, বাদুড়, শিকার করে ভক্ষণ করত বলে অপরিপক্ক কৈশোরের দলে ভিড়ে গিয়ে যাদের ভেংচি কেটে ডেকেছি 'সিয়ালখিয়া' বলে। ভাষার স্বাভাবিক বিবর্তনের নিয়মে 'সিয়ালগিরি' সম্প্রদায়টি এই 'সিয়ালখিয়া' নাম রূপান্তরিত হয়নি তো ? (সিয়ালগিরি » সিয়ালগিরা » সিয়ালগিয়া » সিয়ালখিয়া)। আমার শৈশবের স্মৃতিতে ঘেরা 'সিয়ালখিয়া”-র দলই বিলুপ্তপ্রায় উপজাতি 'সিয়ালগিরি' কিনা এ বিষয়ে সম্পূর্ণ নিশ্চয়তা নেই। কারণ মেদিনীপুরের কাঁথি, পটাশপুর, খেজুরি, এগরা, দাঁতন, তমলুক, সুতাহাটা, মহিষাদল এলাকায় “কাকমারা” নামে একটি ছিন্নমূল ভবঘুরে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীও ঘুরে ঘুরে বেড়ায়, গ্রামে গ্রামে ভিক্ষাবৃত্তি করে, কাক-পক্ষী শিকার করে ভক্ষণ করে এবং ছেঁড়া কাপড়-চোপড় দিয়ে আস্তানা তৈরী করে কোনমতে দিন গুজরান করে। বিচিত্রদর্শন মানুষগুলো কর্কশ স্বরে ভিক্ষার আবেদন করে- “লেড়িদি লেড়িদি। বুমি দেওয়া ওরা রাজা। বালু ওরা।” অর্থাৎ “জয় সীতারাম। আমরা এসেছি। জলদি ভিক্ষা দিন।” “কাকমারা”-রা তেলেগু উপজাতির মানুষ ওদের ভাষায় তেলেগু শব্দের আধিক্য দেখা যায়। সম্ভবত, দাক্ষিণাত্যের কোন রাজন্যবর্গের 'উত্তরাপথ অভিযানে'র সময়কাল থেকে অন্ধ্রপ্রদেশ-তামিলনাড়ু সীমানা থেকে রাজার কর্মচারী হিসাবে ওরা ওড়িশা অতিক্রম করে বাংলার মেদিনীপুর অঞ্চলে প্রবেশ করেছিল। পরে যে কোন কারণেই হোক আর দেশে ফিরে যেতে পারেনি।

কিন্তু “সিয়ালগিরি” দের সঙ্গে এদের সম্পর্ক নেই বলেই অনুমিত হয়। কারণ, “সিয়ালগিরি” ভাষায় তেলেগু শব্দ নেই। বরং প্রভূত পরিমাণে গুজরাটি শব্দের আধিক্য পরিলক্ষিত হয়। অপরপক্ষে, বহু যুগ ধরে এদেশে বসবাস করেও তেলেগু কাকমারারা এখনও রয়ে গেছে একটি শিকার নির্ভর ভিক্ষাজীবি, যাযাবর জাত হয়ে। কিন্ত “সিয়ালগিরি” সম্প্রদায়ের মানুষজন কাকমারা-দের মত স্বতন্ত্র না থেকে প্রায় ২৫০ বছর ধরে ক্রমশ এই বাংলার সভ্য জনজীবনে বিলীন হয়ে গেছে। অন্ত্যজ শ্রেণির হিন্দু-শবর উপজাতিতে রুপান্তরিত হয়ে একটি নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেই প্রতিনিয়ত জীবন-সংগ্রাম করে চলেছে।


midnapore.in

(Published on 15.06.2020)