শ্যামল বেরা।
মৌখিক ঐতিহ্যে, ব্রতকথায়, আমরা দেবী চণ্ডীকে পাই, পটুয়ারা পটের গানে চণ্ডীকে এনেছেন, তৈরি হয়েছে চন্ডীপট বা 'কমলেকামিনী পট। এর কাহিনি নিয়ে তৈরি হয়েছে গান। মৌখিক ঐতিহ্যের এ কাহিনির লিখিত রূপ পাচ্ছি পুঁথিতে। পুঁথির কথা নিয়ে চন্ডীর পালাগান নানা ভাবে আমাদের.গ্রাম সমাজে প্রচলিত। এ ধারার.নানান রূপ ও রূপান্তর লক্ষ করা যাচ্ছে। এসব কাহিনি বর্তমানে লোকনাট্যের আঙ্গিকে পরিবেশিত হচ্ছে। মৌখিক ঐতিহ্যানুসারী একই কাহিনি এসেছে পটের গানে - পুথিতে লোকনাট্যে। চণ্ডীকে নিয়ে এই রূপ-রূপান্তরের দিকটি আলোচ্য প্রতিবেদনের বিষয় ভাবনা।
দেবী চণ্ডীকে নিয়ে কোন তাত্বিক আলোচনা না করে নানান লোকায়ত অনুষঙ্গে চন্ডী কিভাবে এসেছে, তা-ই তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কোলাঘাট, তমলুক, পাঁশকুড়া ইত্যাদি থানা এলাকার ৭টি চণ্ডী নিয়ে ৭ বোন চণ্ডী নামে জনশ্রুতি রয়েছে।
১. খারুই চণ্ডী,
২. কাউর চণ্ডী,
৩. বাবুই চণ্ডী,
৪. গুড়াইৎ চণ্ডী,
৫. আচাই চন্ডী,
৬. সিদ্ধেশ্বরী চণ্ডী,
৭. খুকুড়দহ চন্ডী।
গ্রামের নামেই দেবীর নামকরণ হয়েছে। যেমন খারুই গ্রামের চন্ডির নামকরণ হয়েছে খারুই চন্ডী। চন্ডী এখানে গ্রামদেবী।
বাঁকুড়া জেলার 'সাত বৌন' নামে লৌকিক দেবী রয়েছে। সাতটি স্থানে সাত বৌনির অবস্থান। ব্রাহ্মণ ডিহা এবং নছিপুরে 'সাতবৌনি'র অবস্থান সাত বোন থেকে এরূপ নাম। পৌষ সংক্রান্তি থেকে শুরু করে ছয় দিন এর পূজা হয়।
পশ্চিম মেদিনীপুরের খড়গপুর রেলস্টেশনের অনতিদূরে আর. পি. এফ. ক্যাম্পের কাছে একটি নিমগাছের তলায় সাত মায়ের পূজা হয়। সাতটি .ঝামাপাথর পরপর সাজিয়ে পূজা হতো। সম্প্রতি, সাতটি ছোট ছোট মূর্তি করা হয়েছে এবং স্বল্প-উচ্চতার একটা আচ্ছাদনও হয়েছে।
হাওড়া জেলার বাগনান থানার মানকুর গ্রামে সপ্তমাতৃকার পূজা বহু প্রাচীন। ৭টি বিভিন্ন আকৃতির পাথর সাত মা-ইন্দ্রানী, ব্রাহ্মাণী, রুদ্রানী, চামুণ্ডা, কৌমারী, ভৈরবী এবং ব্রাহ্মণী নামে পূজিত হন।
গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসু'র 'বাংলার লৌকিক দেবতা' গ্রন্থের একটি উল্লেখ এইরকম চব্বিশ পরগনা জেলায় সাতদেবীদের মুসলমানী সাতবিবি রূপে দেখা যায়; নামও সেই রূপ- যথাক্রমে আসানবিবি, ওলাবিবি, ঝোলাবিবি, মড়িবিবি ইত্যাদি, তাঁদের থান বা আস্তানাগুলি “সাতবিবির" থান বলে পরিচিত। এ অঞ্চলে সাতবিবির কাহিনি ও গান প্রচলিত রয়েছে।
যাইহোক, ৭ বোন চন্ডীর ধারনাটি আর এক নতুন ভাবে পাওয়া যাচ্ছে। ৭টি গ্রামের পারস্পরিক সম্পর্ক ও সদ্ভাব এই লৌকিক চণ্ডীকে ঘিরে গড়ে উঠেছে। এক চণ্ডীর পূজায় অপর চণ্ডীকে আমন্ত্রণ তথা গ্রামকে আমন্ত্রণ করার রীতি ছিল। এই সাত বোন চন্ডীর বর্তমান পূজক ব্রাহ্মণ। এই সাত বোন চন্ডীর সঙ্গে বাঁকুড়ার সাতবোন, কিংবা খড়গপুরের সাত মা, কিংবা হাওড়ার সপ্তমাতৃকার পুজার কোন অতীত ঐতিহ্য বা উপাদান নিহিত রয়েছে কিনা তা আরো অনুসন্ধানের বিষয়। তবে, একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়- তা হল সপ্তমাতৃকা, সাত মা, সপ্তবৌন বা সাত বোন চণ্ডী সবই পাথর পুজা, পরবর্তী কালে কোন কোন জায়গায় মুখা লাগানো হয়েছে বা মূর্তি কল্পনা করা হয়েছে। বলা যায়- লৌকিক থেকে শাস্ত্রীয় স্তরে উন্নীত করা হয়েছে।
পট, পটের গান আমাদের লোক ঐতিহ্য ও মৌখিক ঐতিহ্যের ধারানুসারী। দেবী চণ্ডীকে নিয়ে লেখা হয়েছে চন্ডীমঙ্গল। এই লিখিত রূপের আগে এ কাহিনি লোকসামাজে প্রচলিত ছিল,তার এক নিদর্শন পট ও পটের গান। চন্ডীমঙ্গল কাব্যে কালকেতু উপাখ্যান এবং ধনপতি উপাখ্যান দুটি পৃথক উপাখ্যান। পটের গানে কিন্তু একটি ক্ষীণ যোগসূত্র লক্ষ করাযায়।
এক দিন দুর্গাদেবীর হয়ে ছিল দয়া/ডালিমতলাতে ধন দিল দেখাইয়া
সেই ধোন কালকেতু লয়ে গেল ঘরে / (আর) খুল্লনা বসিয়ে দেখে কুঁড়ের দুয়ারে
কালকেতুর ধনপ্রাপ্তি এবং সে দৃশ্য খুল্লনা কর্তৃক দৃষ্ট হওয়ার কল্পনাটি পটের গানেই পাওয়া যায়। দেবীচণ্ডীকে দূর্গা নামেই বারেবারে অভিহিত করা হয়েছে।
দশবাহু চণ্ডী মায়ের দশ দিকে সাজে / (আর) ত্রি নয়ন জ্বলেছে প্রাণ কপালেরই মাঝে।
আবার, গানের শেষ রয়েছে -
বিয়ে করে পিতাপুত্র দেশে ফিরে গেল / (আর) চৈত্রমাসে বাসন্তী পূজা শ্রীমন্ত যে দিল -
পটের গানে আমরা যে চণ্ডীকে পাচ্ছি- সেখানে তাকে দশ ভূজা দুর্গা, আঠারো ভূজা শঙ্কর ভবানী, দেবী বাসন্তী, কমলেকামিনী প্রভৃতি অনুষঙ্গে দেখা যাচ্ছে। এইসব অনুষঙ্গ ধরে শ্রীমন্তের কাহিনীকে দ্রুততায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এ পটকে চন্ডী পট বা দুর্গা পট বা কমলেকামিনী বলা হয়। এই চণ্ডী পটে অপর একটি কাহিনি “দুর্গার শঙ্খ পরা”। পাটের গানে যে চণ্ডীকে পাওয়া যায়, সেখানে শাস্ত্রীয় প্রসঙ্গ মিশ্রণ ঘটেছে। তবে, মূল কাহিনি অংশে লোকায়ত জীবনের কথাই এসেছে। উল্লেখ্য, পটের গানে চণ্ডীর মাহাত্ম তথা কাহিনি বর্ণনা খুবই সংক্ষেপে সারা হয়েছে। এক একটি গান আট থেকে দশ মিনিটের মধ্যেই পরিবেশিত হয়।
নদীর পাড় বাধানোর সময় বা কলের পাইপ পোঁতা কিংবা তোলার সময় শ্রমিকদের কণ্ঠে গান শোনা যায়। এই গান শ্রমলাঘবের গান। একজন মূল গান ধরেন, বাকিরা ধুয়া ধরেন। বহু বিচিত্র প্রসঙ্গ উঠে এসেছে এই শ্রমসংগীতে। সামাজিক কাহিনি, মনসার কাহিনি, চণ্ডীর কাহিনি তথা শ্রীমন্ত সদাগরের কাহিনি। এ গানের ধুয়া হল 'যেতে তে দেবো না'। একজন গানের এক এক কলি গাইবেন আর, বাকিরা সমস্বরে বলবেন- “যেতে তো দেবো না"। শ্রীমন্তের- গানের অংশ এই রকম-
পায়ে ধরি অনুরোধ করি গো/যেতে তো দেবো না।
তোমাকে ওই ফেলে একা একা/থাকবো কেমন, কেমন করে গো
বড় দিদি লহনা গো/দেয় শুধু গঞ্জনা গো
যেও না যেও না/কেমন করে থাকবো স্বামী গো
midnapore.in
শ্যামল বেরা। অধুনা পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কোলাঘাট থানার জশাড় গ্রামে জন্ম (২৬.০১.১৯৬৩)। একদা কর্মস্থল এবং বাসস্থান কোলাঘাট । উত্তর-পূর্ব মেদিনীপুরের লোকজীবন ও লোকসংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা করেছেন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে । লোকনাট্য ও পুথি নিয়ে বেশ কয়েকটি গ্রন্থ প্রনয়ণ করেছেন । মধ্যেযুগের কবি দ্বিজ নিত্যানন্দ ও দয়ারাম দাস-এর পুথি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। বর্তমানে তারাপদ সাঁতার রচনা সংগ্রহ সম্পাদনার কাজে নিবিষ্ট রয়েছেন। শ্যামল বেরা 'মিডনাপুর-ডট-ইন' এর সম্মানীয় সদস্য ও পুথি বিষয়ক উপদেষ্টা।