শ্যামল বেরা।
সিংহলে তে যারা গেছে গো/কেউ তো নাহি ফিরে এলো গো
তুমি তো জান স্বামী গো/গর্ভ পঞ্চ মাসের গো
কেমনে তে ছাড়িয়া যাবে গো/কেমনে ছাইড়্যা যাবে গো
পায়ে ধরি অনুরোধ করি/কালীদহে ওই কমলে কামিনী
বন্দী হবে সিংহলে গো/কার কাছে ওই থাকবো স্বামী গো
শ্রমসংগীতের এ গানে খুল্লনার নারী হৃদয়ের দুঃখ কাতরতার দিকটি, নিরাপত্তাহীনতার দিকটি বেশী করে প্রকাশ পেয়েছে। চন্ডীদেবীর দৈবী মহিমা এখানে গৌন। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে শ্রমিকদের কষ্ঠে এ গান আজও শোনা যায়। এখানে চন্ডীর পৌরাণিক মহিমা অপেক্ষা লোককথাশ্রয়ী লোকজীবনের, তথা নারী হৃদয়ের বেদনার দিকটিই অধিকতর গুরুত্ব পেয়েছে।
নিম্নবঙ্গের প্রায় প্রতিটি গ্রামেই মনসা-শীতলা-চন্ডীর পূজা এবং পালাগান পরিবেশনের ধারাটি বহমান। তবে গায়েন রীতি কিংবা উপস্থাপন কৌশলের বহু পরিবর্তন ঘটে চলেছে। ২০/২৫ বছর আগে মূলত গান হিসেবেই পরিবেশিত হতো, কিন্তু বিগত ১০/১২ বছর, এসব পালা যে আঙ্গিকে পরিবেশিত হচ্ছে, তা লোকনাট্যের আঙ্গিক। দল রয়েছে অগুনতি। কিন্তু এসব দল নিয়ে বা অঙ্গিক নিয়ে পূর্ণাঙ্গ কোন কাজ হয় নি। যাইহোক, আমাদের আলোচ্য লোকনাট্যে দেবী চন্ডী। এই লোকনাট্য বলতে শয়াল বা দেশপূজা উপলক্ষে চণ্ডীদেবীর মাহাত্ম্য সূচক পালা। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার তমলুক থানা এলাকার একটি শয়াল-দলের নাম “খারুই চন্ডীমাতা শয়াল ইউনিট”। এই দলের জন্য রমেশ চক্রবর্তী যে পালা তৈরি করেছেন-তা বহু স্থানে অভিনীত হচ্ছে। প্রচলিত কাহিনিকে অবলম্বন করেই- এর বিস্তার. ঘটেছে। পালার নাম দেয়া হয়েছে- স্বামী, পুত্র ও পুত্রবধূ”। কাহিনি কাঠামো এরকম-
সূচনা - ইন্দ্রের নর্তকিশালা। ইন্দ্র, রত্নমালা, চন্ডী
প্রথম অঙ্ক - খুল্লনার কক্ষ, ধনপতির বাড়ি, নিয়ে ৩টি দৃশ্য।
দ্বিতীয় অঙ্ক - বিক্রমকেশরীর বাড়ি, ধনপতির বাড়ি, নিয়ে ২টি দৃশ্য।
তৃতীয় অঙ্ক - চণ্ডী ও পদ্মার যুক্ত, শালিবাহনের রাজপ্রাসাদ, খুল্লনার কক্ষ, চন্ডীমায়ের মন্দির, ছোট শ্রীমত্ত, লহনার কক্ষ-নিয়ে ৭ টি দৃশ্য।
চতুর্থ অঙ্ক - জনার্দন শর্মার পাঠশালা, শ্রীমন্তের পাঠশালায় যাওয়া-অপমানিত হওয়া-পিতৃঅন্বেষণে শ্রীমস্তের যাওয়া নিয়ে, ১০টি দৃশ্য।
পঞ্চম অঙ্ক - কমলেকমিনী দর্শন, শালিবাহনের রাজপ্রাসাদে যাওয়া- কমলে কামিনী না দেখাতে পারা নিয়ে ৮টি দৃশ্য।
ষষ্ঠ অঙ্ক - সুশীলার কক্ষে সুশীলা, চণ্ডী, শান্তি, কারাগারে শ্রীমন্ত, মশানে শ্রীমন্তের গর্দান যাওয়ার উপক্রম, কমলেকামিনীর আবির্ভাব, মুক্তি নিয়ে ৮টি দৃশ্য।
সপ্তম অঙ্ক - ধনপতির বাড়ি- সিংহল থেকে ফিরে আসা-চন্ডী পুজা ইত্যাদি নিয়ে ৪টি দৃশ্য।
মোট ৭টি অঙ্কে ৪২টি দৃশ্যে এই কাহিনি সাজানো হয়েছে। সংলাপের পাশাপাশি পুঁথির অংশ যেমন গায়কের কণ্ঠে এসেছে। তেমনি চরিত্র অনুযায়ী গানও পরিবেশিত হয়েছে। সংলাপ-পুঁথির অংশ- গান মিলে মিশে এসব পালা গঠিত হয়েছে।
চতুর্থ অঙ্কের পাঠশালার দৃশ্যটির পরিকল্পনায় এবং সংলাপে ভাঁড়যাত্রার এরূপ একটি দৃশ্যের সদৃশ্য লক্ষ করা যায়। পাঠশালার গুরুদেবকে নিয়ে রসিকতা এবং মূল ভাঁড়ামোর পরিচয় পাওয়া যায়। যেমনঃ
১ম ছাত্র - (গুরুদেবকে দেখে) চুপ চুপ ওই শালা বুড়ো আসছে। পড় পড়-
২য় ছাত্র - গরু উড়িতেছে- পাখি চরিতেছে- আমি বাড়ি যাবো।
এ ধরনের বহু সংলাপ রয়েছে। যাই হোক, এই পাঠশালায় গুরুদেবের কাছে পিতার নাম বলতে না পারায় শ্রীমন্তকে শুনতে হয়েছে- তাহলে তুই ব্যাটা জারজ সন্তান। না, আমার পাঠশালা থেকে দূর হয়ে যা- নইলে তোকে-
সংলাপ যাইহোক, দেবী চন্ডী ধনপতি ও শ্রীমন্তকে সংকটে ফেলেছেন। আবার, দেবীর স্তব করায় শ্রীমন্ত সহ ধনপতিকে উদ্ধার করেছেন। শ্রীমন্তের সঙ্গে সুশীলার বিবাহ পর্বটিও বিস্তারিত ভাবে দেখানো হয়েছে। দেবী চন্ডীর পূজা, তথা মাতৃপূজা প্রচলনের দিকটি এ নাটকে উঠে এসেছে। এখানে, চন্ডীর দেবী মহিমার চেয়ে তার কুট কৌশল পরায়নতার দিকটি বেশী করে প্রকাশ পেয়েছে।
সমগ্র পালায় গান রয়েছে প্রচুর। প্রচলিত কাহিনিকে লিখিত ভাবে পালায় রূপ দেয়ার ধারাটি আজ শতবর্ষ অতিক্রান্ত হতে চলল- ১৩০০ সালে শ্রী কালীপ্রসন্ন বিদ্যারত্নের 'সচিত্র শ্রীমন্তের মশান বা কমলেকামিনী দর্শন' প্রকাশিত হয়েছিল, কলকাতার নিউ-ভিক্টোরিয়া প্রেস থেকে। ১৭৫ পৃষ্ঠার বইটি গীতবহুল। সংলাপের বানান ব্যবহৃত হয়েছে একবোরে উচ্চারণ অনুযায়ী দেবী চণ্ডীকে নিয়ে বর্তমান পালাগুলি অনেকাংশেই কালীপ্রসন্ন বিদ্যারত্বের-ধারানুসারী। তা বলে, এই নয় কালীপ্রসন্নের পুস্তক পড়ে পালাকারগণ প্রভাবিত হয়েছিলেন। আসলে, বাংলাদেশের জলবায়ুর তথা
পরিবেশ মন্ডল তৈরি হয়েছে- আর আমরা নানা ভাবে পেয়েছি দেবী চণ্ডীকে।
দুর্গে দুর্গে তারা মা-গো-দুঃখ বিনাশিনী / দুর্জয় দক্ষিণে মা - গো-নগর-নন্দিনী
দশ বহু চন্ডী মায়ের দশ দিকে সাজে / (আর) ত্রিনয়ন জ্বলেছে প্রাণ কপালেরই মাঝে
লক্ষী সরস্বতী বামে কার্তিক গণেশ / সিংহ অসুর জয়-বিজয় চলে মায়ের সনে
এক দিন দূর্গাদেবীর হয়ে ছিল দয়া / ডালিমতলাতে ধন দিল দেখাইয়া
সেই ধন কালকেতু লয়ে গেল ঘরে / (আর) খুল্লনা বসিয়া দেখে কুঁড়ের দুয়ারে
বারো বছর ছিলেন সাধু বন্দী কারাগরে / (আর) শ্রীমন্ত যে জন্ম নিল খুল্লনার ঘরে
লিখাপড়া শিখে শ্রীমন্ত বাসনা করিল / পিতৃ অন্বেষণে যাবে মায়েরে বলিল
তুমি বাবা একই পুত্র নয়নেরই তারা / (আজ) তোমায় ছেড়ে দিলে বাবা করে ফেলি হারা
তোমায় ছেড়ে দেবো বাবা দুর্গা ডেকে আনো / (আর) স্মরণ করিতে দুর্গা আসিল তখন
দুর্গার হাতে শ্রীমন্তকে দিল উঠাইয়া / (আর) জয় ভবানী বলি ডিঙ্গা-চলিল ভাসিয়া
ডিঙ্গা মাঝি কর্ণধর বাহিয়া চলিল / বাহ বাহ বলে ডিঙ্গা বাহিতে লাগিল
আর কামিনী একদেখা দিলেন শতদলে / শতদল পদ্মের মাঝে কমলেকামিনী
(আর) নারী হয়ে গিলে গজ জগং-জননী / যেই গজ গিলে নারী সেই গজ উগরে
(আর) শ্রীমন্ত দেখিয়া তারে প্রণাম যে করে/ সেখান হতে শ্রীমন্ত সে বহিয়া চলিল
midnapore.in
শ্যামল বেরা। অধুনা পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কোলাঘাট থানার জশাড় গ্রামে জন্ম (২৬.০১.১৯৬৩)। একদা কর্মস্থল এবং বাসস্থান কোলাঘাট । উত্তর-পূর্ব মেদিনীপুরের লোকজীবন ও লোকসংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা করেছেন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে । লোকনাট্য ও পুথি নিয়ে বেশ কয়েকটি গ্রন্থ প্রনয়ণ করেছেন । মধ্যেযুগের কবি দ্বিজ নিত্যানন্দ ও দয়ারাম দাস-এর পুথি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। বর্তমানে তারাপদ সাঁতার রচনা সংগ্রহ সম্পাদনার কাজে নিবিষ্ট রয়েছেন। শ্যামল বেরা 'মিডনাপুর-ডট-ইন' এর সম্মানীয় সদস্য ও পুথি বিষয়ক উপদেষ্টা।