শম্ভু রক্ষিত , Sambhu Rakshit, सम्भू रक्षित, poet, Mahaprithibi, Hungryalist movement, BLUES

শম্ভু রক্ষিত

Sambhu Rakshit | सम्भू रक्षित

(16 August 1948 – 29 May 2020)

বিরিঞ্চিবেড়িয়া, পূর্বশ্রীকৃষ্ণপুর, পূর্ব মেদিনীপূর ৭২১৬৩৫

আমার মৃত্যুর পর তোকে আর যন্ত্রণার তাঁত বুনতে হবে না

বল দেখি, আমার লেখা গল্পের,আঁকা-মানচিত্রের মধ্যে তুই কে?


Born on 18th August 1946 at his maternal uncles house. Father Nandalal Rakshita was a businessman; he had an iron chest factory in Dashnagar, Howrah. Mother Radharani Devi was a housewife. His primary education was at East Srikrishnapur Primary School in Sutahata. After passing the scholarship examination, he moved to Kadamtala in Howrah. There he studied secondary education from Batra Madhusudan Palchowdhury School.

Later he moved to his ancestral village to live with his father. Sambhu Rakshit started helping his father in cultivation and did everything that a cultivator does. However, he continued visiting Calcutta to compose his poems.

Sambhu Rakshit was the youngest poet of the Hungryalist movement. He started with the publication of a Hungryalist periodical named BLUES. Sambhu Rakshit was a poet who did nothing in his life other than writing poems. Since he had no job he had to create his own poems in letterpress institutions, which they permitted because of his tenacity. He was quite brave and was incarcerated during Emergency regime of Indira Gandhi.

He started editing a poetry periodical titled "Mahaprithibi" and continues to publish it while composing the poems contributed by poets. Several poets helped him by offering their poetry manuscripts to be published by "Mahaprithibi" publications. His poems are completely different from others. This has given him a position matchless by any other Bengali poet.

শম্ভু রক্ষিত   | Sambhu Rakshit | सम्भू रक्षित

২০২০ সালের মে মাসের ২৯ তারিখের একটি দৃশ্য -" খালের পাড় ধরে গ্রামের সরু রাস্তা। চারজন মানুষের কাঁধে বাঁশের মাচায় চেপে চলেছেন বাংলা ভাষার বোহেমিয়ান কবি শম্ভু রক্ষিত। কোনো ভিড় নেই, চমক নেই, নেই কোন নাম-সংকীর্তনের দল বা ধুপ-ধুনোর ঘটা। মুখভর্তি খোঁচা-খোঁচা দাড়ি নিয়ে একটি মাত্র মাদুর জড়িয়ে মহাপৃথিবীর উদ্যেশে চলেছেন সত্তরের দশকের অন্যতম শক্তিমান কবি। ময়লা ধূসর জামা প্যান্ট, পায়ে ধুল মাখা জুতো, কাঁধে ঝোলা নিয়ে দূর থেকে অদৃশ্য হয়ে তিনি হয়ত উপভোগ করছেন এই দৃশ্য। "

১৯৪৮ সালের ১৬ অগস্ট জন্ম হাওড়া'র কদমতলায় ১১, ঠাকুরদাস দত্ত বই লেনে মামার বাড়িতে। পিতা নন্দলাল রক্ষিত ছিলেন ব্যাবসায়ী, হাওড়ার দাশনগরে তাঁর একটি লোহার সিন্দুকের কারখানা ছিল। মা রাধারানী দেবী ছিলেন গৃহবধূ। কবির প্রাথমিক শিক্ষা সুতাহাটার পূর্ব শ্রীকৃষ্ণপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বৃত্তি পরীক্ষা পাশ করে হাওড়ার কদমতলায় চলে আসেন। মাধ্যমিক পড়েন ব্যাটরা মধুসূদন পালচৌধুরী স্কুল থেকে। প্রথাগত শিক্ষায় অনাগ্রাহী কবি হাওড়ার নরসিংহ দত্ত কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হলেও পড়াশোনা শেষ করেননি।

শম্ভু রক্ষিত   | Sambhu Rakshit | सम्भू रक्षित

তারপর থেকে কবিতা এবং পত্রিকা প্রকাশই ছিল তাঁর সর্বক্ষণের যাপন। লেখালেখি শুরু স্কুলে হাতে–লেখা পত্রিকায়। স্কুলপত্রিকা এবং ‘মা’ নামের একটি পত্রিকা সম্পাদনা দিয়ে সম্পাদক জীবনের শুরু। হাংরি জেনারেশন নিয়ে ‘ব্লুজ’ নামে একটি সাময়িকী প্রকাশ করেন কলকাতা থেকে। অক্ষয়কুমার রমনলাল দেশাই সম্পাদিত "Violation Of Democratic Rites"-এর তৃতীয় খন্ডে উল্লেখ করা হয়েছে যে ১৯৭৬ সালে পুলিশ শম্ভু রক্ষিতের উপর হাজতে অকথ্য অত্যাচার চালিয়েছিলো আর তারপর বিনা বিচারে তাঁকে আট মাস আটক রাখা হয়েছিলো, ১৯৬৪ সালে শুরু হওয়া মামলার জেরে "ব্লুজ" পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়।


তাঁর কবিতাচর্চার সূত্রপাত ষাটের দশকে। প্রথম থেকেই তিনি বিশিষ্ট, তাঁর বোধে ; বাকভঙ্গির অনন্যসাধারণ স্বকীয়তায়। তাঁর কবিতায় সংস্কৃত, গ্রীক, ইংরেজি, ফার্সি, আরবি, উর্দু, হিন্দি প্রভৃতি বহুভাষাপ্রবাহ লক্ষণীয়। কিন্তু ভাষিক স্তরের ঊর্ধে এক বহুমাত্রিক ধ্বনিপ্রবাহ, এক ব্যঞ্জনাময় গূঢ় চৈতন্যপ্রবাহই তাঁর নিজস্বতার দ্যোতক ৷ মাত্র তেইশ বছর বয়সে "তুমি কণিকা ও সূর্যের মধ্যে বিন্দু ও বিস্ফোরণজাত গোলাপ" -এর মতো লাইন সংবলিত শম্ভু রক্ষিতের প্রথম গ্রন্থ ‘সময়ের কাছে কেন আমি বা কেন মানুষ’(১৯৭১)। দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না’। যেটা তাঁকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে অনন্য কবি হিসাবে। যে গ্রন্থের প্রচ্ছদ পরিকল্পনা ও অঙ্কন করেন রঘুনাথ গোস্বামী। প্রচ্ছদের রমণীর চোখ শ্বেতবর্ণের, চোখের জলের ফোঁটাও। এই নারী দেবী কালিকা ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। আবার নীল সরস্বতীও। শম্ভুর কবিতায়— ‘তুমি স্থির, নিঃশব্দ রক্তমাংস, তোমার যৌনাঙ্গকে আমার প্রণতি/ তোমার উন্মুখ স্তনে মুখ দিয়ে আমি ব্যবধানহীন বেঁচে আছি’। এই কবিতা মাতৃস্তব এবং প্রেমের।

শম্ভু রক্ষিত   | Sambhu Rakshit | सम्भू रक्षित
শম্ভু রক্ষিত   | Sambhu Rakshit | सम्भू रक्षित

.

প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ আটটি। তাঁর উল্লেখ্য কাব্যগ্রন্থ "সময়ের কাছে কেন আমি বা কেন মানুষ ( ১৯৭১)", "প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না(১৯৭৩)", "রাজনীতি(১৯৭৫)", "পাঠক, অক্ষরগুলি( ১৯৮২)", "সঙ্গহীন যাত্রা (১৯৯১)", "আমি কেরর না অসুর ( ২০০৪)" । ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত তাঁর গল্প সঙ্কলন 'শুকনো রোদ কিংবা তপ্তদিন অথবা নীরস আকাশ প্রভৃতি' এবং একমাত্র উপন্যাস 'অস্ত্র নিরস্ত্র' (১৯৮০)।

তিনি আমেরিকা নিবাসী বাংলাদেশের সাহিত্যানুরাগীদের দেওয়া 'শব্দগুচ্ছ' পুরস্কার প্রাপ্ত। পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ লিটল ম্যাগাজিন মেলার ‘মধুপর্ণী’ পুরস্কার, ‘শব্দগুচ্ছ’ ও ‘তিতীর্ষু’ সম্মান। কবি, সম্পাদক চন্দন দাস তথ্যচিত্রে ধরে রেখেছেন কবির জীবন ও সৃজন।

শম্ভু রক্ষিত   | Sambhu Rakshit | सम्भू रक्षित

জরুরি অবস্থার সময় কবি সাত মাস জেল খেটেছেন। সে সময়ে কবির পাশে আর্থিক সহযোগিতা নিয়ে দাঁড়ানোর জন্য বাংলা তথা দেশের বিখ্যাত চিত্রশিল্পীরা ছবি এঁকে প্রদর্শনী করেছিলেন। চিত্রপ্রদর্শনীর মূল উদ্যোক্তা ছিলেন রবীন মন্ডল ও কবি কালী কৃষ্ণ গুহ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও ছবি কিনেছিলেন।

কারাবাস সম্পর্কে শম্ভু রক্ষিত বলেছেন :

"দেখুন জেল খুব ভালো জায়গা । এই জেলখানাতে খুব সহজে যাওয়া যায় না । আপনার টাকাপয়সা থাকলে আপনি পৃথিবী ভ্রমণ করতে পারবেন, কিন্তু আপনি ইচ্ছেমতো জেলখানায় যেতে পারবেন না । আমার তো জেলখানা খুব ভালো লেগেছে । আমার মনে হয় প্রত্যেক কবি যদি একবার করে জেলখানায় ঘুরে আসতে পারতেন তো খুব ভালো হত "।


তাঁর বিরিঞ্চিবেড়িয়া গ্রামের (পূর্ব মেদিনীপুর) বাড়িটি সামান্য ইঁট মাটি দিয়ে তৈরী। সামনে ছোট্ট উঠোন ও একটি পুকুর। বাড়ির নাম নন্দায়ন।

শম্ভু রক্ষিত   | Sambhu Rakshit | सम्भू रक्षित
শম্ভু রক্ষিত   | Sambhu Rakshit | सम्भू रक्षित

.

শব্দ আর জীবনচর্চায় তিনি বরাবরই প্রচলিত ধারার বাইরে। কফি হাউসে মাথায় ফেট্টি বাঁধা আর মলিন পোশাকের শম্ভু রক্ষিতকে সমীহ করতেন অনেক সাহিত্যিক। ময়লা ধূসর জামা প্যান্ট, পায়ে ধুল মাখা জুতো, কাঁধে ঝোলা। ঝোলায় পাণ্ডুলিপি, পত্রিকা, দাঁত মাজার গুড়াকু। ৪৫ বছর মামার বাড়ি হাওড়ার ঠাকুর দাস দত্ত লেনে। ৩০ বছর কাটিয়েছেন পূর্ব মেদিনীপুরে। ইচ্ছে হলে ব্যাগ মাথায় দিয়ে শুয়ে যেতেন কলেজ স্কোয়ারের পুকুরপাড়ে। কফি হাউসের চেয়ারে পা তুলে বসতেন একমাত্র মহাপৃথিবীর কবি শম্ভু রক্ষিত।

২০২০ সালের ২৯ মে শুক্রবার সকাল আটটা নাগাদ তিঁনি প্রয়াত হন। ঐদিন বিকেলে সুতাহাটার চাঁপি শ্মশানে সম্পন্ন হয় তাঁর শেষকৃত্য। দু বছর ভুগছিলেন পারকিনসন্স রোগে। রেখে গেলেন স্ত্রী অঞ্জলি, পুত্র কীর্তিকর, দুই মেয়ে দিওত্তিমা ও পৃথা, কবিভ্রাতা শ্যামল রক্ষিত এবং নাতি নাতনিদের।

তাঁর সম্পর্কে কিছু মন্তব্য -


হাংরি জেনারেশনের রূপকার মলয় রায়চৌধুরী শম্ভু রক্ষিতকে "সর্বশ্রেষ্ঠ জীবিত কবি" স্বীকৃতি দিয়ে লিখেছেন - " শম্ভুর একটি লেখা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কেমন করে গজিয়ে ওঠে তা এক রহস্য,কবিতা বিশেষটি আরম্ভ করে শম্ভু ক্রমশঃ ভঙ্গুর ডিকশানের মাধ্যমে তার গঠনবিন্যাসের ল্যাবিরিন্থে নিয়ে যান, ছবি পুরো গড়ে ওঠার আগেই অন্য ছবিতে চলে যান,ষাট,সত্তর,আশি,নব্বই দশকের কবিতার যে ধারা তার সঙ্গে শম্ভুর কবিতার মিল নেই, তিনি নিজের বাক্য সাজানোর কৌশল গড়ে ফেলেছেন এবং তা থেকে কখনও সরে যাননি,আশে পাশে নানারকম আন্দোলন ও শৈলী নিরীক্ষা সত্বেও"

মলয় রায়চৌধুরীর বিশ্লেষণ অনুসারে - "শম্ভু রক্ষিতের কবিতাগুলি রাইজ্যোম্যাটিক, বহুরৈখিক, ম্যাক্সিমেলিস্ট, ফ্র্যাগমেন্টারি, নন-টাইটেল হোল্ডিং, আয়রনিকাল এবং অবশ্যই টেকনিক্যালি আঁভা গার্দ।"

শক্তি চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন - "সত্তরের আধুনিক কবিদের মধ্যে সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিমান ও সম্ভাবনাময় কবি শম্ভু রক্ষিত। "

শঙ্খ ঘোষ বলেছিলেন - "তার কবিতা সমকালের পাঠকরা সেভাবে অনুধাবন করতে না পারলেও আগামী দিনের পাঠকরা সঠিক মূল্যায়ন করবে।"

দীপক রায় লিখেছেন - "ওই ছোটো খাটো মানুষটা যাকে আমি চার দশক ধরে চিনি, সে ক্রমশ রহস্যময় হয়ে উঠছে আমার কাছে। কী বলব আমরা তাকে? লিটল ম্যাগাজিনের যুবরাজ? লিটল ম্যাগাজিনের রাজা? নাকি সম্রাট? নাকি রাজাধিরাজ? কী বলব তাকে?"

শম্ভু রক্ষিত তাঁর গ্রাম বিরিঞ্চিবেড়িয়া থেকে সম্পাদনা করেছেন " মহাপৃথিবী " পত্রিকা যা ৫০ বছর অতিক্রম করেছে। প্রচ্ছদ এঁকেছেন রবীন মন্ডল, হিরণ মিত্র, শ্যামল জানা, সুকুমার মিস্ত্রি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত প্রুফ দেখা থেকে শুরু করে ছাপা অবধি তিঁনি নিজেই করে গেছেন। তাঁর অমোঘ উচ্চারণ -

"কবিতা ছাড়া অন্য কোনও পবিত্রতায় আমার বিশ্বাস নেই"


- অরিন্দম ভৌমিক। ।

midnapore.in

(Published on 12.06.2020)