৩০ এপ্রিল রাত্রি ৮.৩০-এ মুজাফ্ফরপুরে বোমা ছুড়লেন ক্ষুদিরাম।
অরিন্দম ভৌমিক।
ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল মুজাফ্ফরপুর পৌঁছনোর আগের দিন থেকেই কিংসফোর্ডের দু'জন দেহরক্ষী বহাল হওয়ায় তাঁদের কাজ আরো কঠিন হয়ে পড়ে। প্রথম কয়েকদিন তাঁরা কিংসফোর্ডের বাড়ি, কোর্ট, ক্লাব এই জায়গাগুলি ঘুরে ঘুরে ভাল করে দেখলেন। কিংসফোর্ডকে সতর্ক করা হয়েছিল বলে তিনি বাড়ির বাইরে প্রায় বেরোতেন না বললেই চলে। তাই তাকে একা পাওয়ার সুযোগ ছিল না। সম্ভবত ২৮শে এপ্রিল তাঁরা কোর্টে গিয়ে কিংসফোর্ডকে মারার সুযোগ খুঁজতে থাকেন, কিন্তু সেখানে অনেক নিরপরাধ লোক মারা যাবে বলে সেই চেষ্টা বাতিল করেন। পরের দিন ২৯শে এপ্রিল কিংসফোর্ডের গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য তাঁরা `রাকেট কোর্টের' কাছে গিয়েছিলেন। সেখানে আব্দুল করিম নামে এক ছাত্রের সঙ্গে তাঁদের আলাপ হয়। কোর্টের কাছে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরে তাঁরা আব্দুল করিমের সঙ্গে কাছেই একটি মাঠে ফুটবল খেলা দেখতে যান। সেখানে আব্দুল করিম তাঁদেরকে খেলতে অনুরোধ করলে, প্রফুল্ল খেলতে নামেন এবং প্রফুল্ল যে দলের হয়ে খেলেছিলেন সেই দল ৩ গোলে জয়ী হয়। আব্দুল করিম ও মাঠের অন্যান্যরা পরের দিনও তাঁদেরকে খেলতে আসার অনুরোধ করে। সেদিন তাঁরা কিংসফোর্ডের দেখা না পেয়ে ধর্মশালায় ফিরে আসেন। খেলার মাঠে তাঁরা বলেছিলেন যে তাঁরা নৈহাটী থেকে মুজাফফরপুর বেড়াতে এসেছিলেন।
সুযোগ পাওয়া যাচ্ছেনা দেখে তাঁরা ঠিক করলেন পরের দিন বিকেল পর্যন্ত কোন সুযোগ না পাওয়া গেলে, সন্ধ্যায় ক্লাবে যাওয়ার সময় তাঁরা কিংসফোর্ডকে মারার চেষ্টা করবেন। তাঁরা লক্ষ্য করেছিলেন যে প্রতিদিন সন্ধ্যায় ঘোড়ায় টানা ল্যােন্ডোলেট (landaulet) গাড়ি চড়ে ইউরোপিয়ান ক্লাবে যান কিংসফোর্ড এবং রাত্রি ৮টার দিকে ফিরে আসেন। পরের দিনটি ছিল অমাবস্যা, তাই তাঁদের কাজের জন্যও দিনটি ভালো ছিল।
৩০শে এপ্রিল বৃহস্পতিবার সকাল থেকে তাঁরা কোন সুযোগ না পেয়ে ধর্মশালায় ফিরে আসেন। সন্ধের আগে আবার তাঁরা কিংসফোর্ডের বাংলোর কাছে গিয়ে আলাদা ভাবে বাংলোর দুদিকে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন। সন্ধে তখন ৭.৩০ (সাড়ে সাতটা), ফয়েজউদ্দিন ও তহসিল খাঁন নামে দুই কনস্টবল কিংসফোর্ডের জন্য রাস্তায় পাহারা দিচ্ছিলেন। ক্ষুদিরামদের দেখতে পেয়ে, তারা জিজ্ঞেস করল যে তাঁরা কোথায় থাকে এবং এখানে কি করছে? জবাবে ভাঙা-ভাঙা হিন্দিতে তাঁরা উত্তর দেন যে তাঁরা ছাত্র এবং কিশোরীবাবুর বাড়িতে থাকেন, সেইখানে তাঁরা এক বন্ধুর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন।
কনস্টেবলরা বলেন যে এই রাস্তা দিয়ে সাহেবরা যাতায়াত করেন, তাই তারা যেন তাড়াতাড়ি চলে যায়। তাঁরা একটু সরে গিয়ে আবার নজর রাখতে লাগলেন। কিছুক্ষন পরেই ক্ষুদিরাম এসে প্রফুল্লকে খবর দেন যে কিংসফোর্ড গাড়ি করে ক্লাবের দিকে গেছেন, ক্লাব থেকে ফেরার সময় যে ভাবেই হোক তাঁদেরকে কাজটা করতেই হবে। কারণ মুজাফফরপুরে অনেকেই তাঁদেরকে প্রতিদিন রাস্তায় দেখছেন ও খেলার মাঠের ছেলেরাও তাঁদেরকে চিনেছে। তাঁদের মুজাফফরপুরে বেশিদিন থাকা আর নিরাপদ নয়।
অস্ত্রগুরু হেমচন্দ্র কানুনগোর (দাস) তৈরী বোমাটি একটি টিনের বাক্সে করে নিয়ে গেছিলেন। ক্ষুদিরাম সেই টিনের বাক্সটি ফেলে বোমটি হাতে নিলেন। তাঁরা ক্লাবের কাছে গিয়ে দেখলেন কিংসফোর্ড ও তার স্ত্রী, ব্যারিস্টার প্রিঙলে কেনেডির (Pringle Kennedy) স্ত্রী ও মেয়ের সঙ্গে ব্রিজ খেলায় মত্ত। কিংসফোর্ড ক্লাবে আরো কিছুক্ষন থাকবে বুঝতে পেরে ক্ষুদিরামকে রেখে প্রফুল্ল একবার ধর্মশালা থেকে ঘুরে এলেন।
তাঁদের শরীর উত্তেজনায় টানটান, এ সুযোগ হারালে চলবে না। রাতের অন্ধকারে তাঁরা রাস্তার ধারে কিংসফোর্ডের বাংলোর পূর্বদিকের গেটের কাছে একটি গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে রইলেন। এদিকে ব্রিজ খেলার শেষে কিংসফোর্ডকে বিদায় জানিয়ে তাঁর আগেই কেনেডির স্ত্রী ও মেয়ে গাড়িতে চাপেন। তাঁদের গাড়িটি হুবহু কিংসফোর্ডের গাড়ির মত দেখতে ছিল। দেখে বোঝার উপায় ছিলো না কোনটা কার এবং তাঁদের বাড়ি যেতে হলে কিংসফোর্ডের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়েই যেতে হবে। তাঁদের গাড়ি ছাড়বার পর কিংসফোর্ড তাঁর নিজের গাড়িতে চাপলেন।
এদিক অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল কিছুক্ষন পরেই গাড়ি আসার ঘড় ঘড় আওয়াজ শুনতে পেলেন। তাঁরা ঠিক করে রেখেছিলেন যে কোনো ভাবে বোম না ফাটলে তাঁরা বন্দুক নিয়ে গাড়িতে উঠে কিংসফোর্ডকে মারবেন। তাঁরা দুজনেই জুতো খুলে ফেললেন, ক্ষুদিরামের হাতে বোমা ও সঙ্গে আরো দুটো বন্দুক, প্রফুল্লর হাতে একটি বন্দুক। রাত্রি তখন ৮.৩০ (সাড়ে আটটা), গাড়িটি দেখেই তাঁরা চিনতে পারলেন যে সেটা কিংসফোর্ডের গাড়ি। গাড়ি পূর্ব-গেটের সামনে গাছের কাছে আসতেই ক্ষুদিরাম দৌড়ে গিয়ে তাঁর হাতের বোমা গাড়ির মধ্যে ছুডে় মারলেন।
বোমার প্রচন্ড শব্দে সমস্ত শহর কেঁপে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটি দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো, ঘোড়া লাফিয়ে উঠল এবং সহিস আহত অবস্থায় অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। কিংসফোর্ড শেষ হয়েছে মনে করে প্রফুল্ল ও ক্ষুদিরাম সেখান থেকে ধর্মশালার দিকে দৌড় লাগালেন।
মিঃ উইলসন নামে এক সাহেব নিজের বাংলোতেই ছিলেন, তিনি ছুটে এসে দেখলেন, তখনও গাড়িটি জ্বলছে। কনস্টেবল তহসিল খাঁন দৌড়ে গিয়ে থানায় খবর দিল। শহরে ঢোল পিটিয়ে বলা হল যে, তাঁদের ধরিয়ে দিতে পারলে ১,০০০ টাকা পুরষ্কার দেওয়া হবে। প্রতিটি রেলস্টেশনে টেলিগ্রাম করে জানিয়ে দেওয়া হল নজর রাখার জন্য।
এদিকে প্রফুল্ল ও ক্ষুদিরাম দৌড়ে ধর্মশালা পর্যন্ত যান, সেখানে একদল কনস্টেবল তাঁদের ডাকলেও, তাঁরা না থেমে দৌড়োতে থাকেন। রেললাইন পেরনোর পর তাঁরা আলাদা রাস্তায় সমস্তিপুরের দিকে রওনা হলেন।