কমলেশ নন্দ।
নিউবেঙ্গল থিয়েটারের যখন এই অবস্থা তখন অন্যদিকে হিন্দু থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা গোপালবাবুর মৃত্যুতে আর এক বিপত্তির সৃষ্টি হয়। তাঁর মৃত্যুর পর দলের অবস্থা বেহাল হয়ে পডে়। গোপালবাবুর অবর্তমানে সদস্যদের মধ্যে নানান বিশৃঙ্খলার পাশাপাশি বহু মতের কারণে দলে চরম অশান্তির সৃষ্টি হয়। অবশ্য এরপরেও হিন্দু থিয়েটার নাটক অভিনয়ে উৎসাহী হয়েছিল। কিন্তু ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের সরস্বতী পূজার দিন হিন্দু থিয়েটারের উদ্যোগে শেষবারের মতো নাটক অভিনীত হয়।
একদিকে হিন্দু থিয়েটার এবং অন্যদিকে নিউবেঙ্গল থিয়েটার যখন পাকাপাকি ভাবে বন্ধ হয়ে গেল তখনও শহরে দুটি এ্যামেচার দল কিন্তু তাদের অভিনয় চালিয়ে গেল। এ্যামেচার দল দুটি নিয়মিত নাট্য অভিনয়ে নিযুক্ত ছিল। তাঁরা একের পর এক মঞ্চসফল নাটক অভিনয় করে যাচ্ছিলেন। ১৯০২-এ বান্ধব নাট্য সমাজের উদ্যোগে `হরি অন্বেষণ' এবং `বিজয় বসন্ত' নাটক দুটির অভিনয় দর্শকদের মন আকর্ষন করে। একইভাবে এদেরই উদ্যোগে ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে `রঘুবীর' এবং `সংসার' নাটকদুটিও দর্শকদের আলোড়িত করে।
শহর এ্যামেচার থিয়েটারের দুটি দল যখন গৌরবের সঙ্গে তাদের অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছিল তখন আর একটি দলের জন্ম হয়। নতুন এই দল গঠিত হোল `বীণা থিয়েটার' নাম নিয়ে। বীণা থিয়েটার ১৯১২-র মে মাসে `তপোবন' নাটক অভিনয়ের মধ্য দিয়ে নাট্যাভিনয়ের পথচলা শুরু করে। এই থিয়েটারের সর্বময় কর্তা ছিলেন অতুলবাবু।
মেদিনীপুর শহরে নাট্যচর্চার গতি যখন নানাভাবে সঠিক পথের দিশারী তখন সাহিত্য পরিষদের ভূমিকা সেই গতিকে আরো বেশিদূর এগোতে সাহায্য করে। ১৩১৮ সালের ভাদ্র মাসের (১৯১১ খ্রিস্টাব্দে) এক রবিবার মেদিনীপুরে প্রথম সাহিত্য পরিষদের মঙ্গলঘট স্থাপিত হয়। সাহিত্য পরিষদের উদ্যোগে সমগ্র মেদিনীপুরের সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে জোয়ার আসে। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে মেদিনীপুরে বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মিলনের ত্রয়োদশ অধিবেশন শুরু হয়। অধিবেশন চলে ১৩-১৫ এপ্রিল পর্যন্ত। এই অধিবেশনের মাঝেই একদিন `প্রফুল্ল' নাটকটি অভিনীত হয়। এমনিভাবে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নানান নাট্য অভিনয় মেদিনীপুরে প্রতিষ্ঠিত সাহিত্য পরিষদের গৌরব বৃদ্ধি করে।
বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের এই গৌরবময় ভূমিকায় সমগ্র জেলায় নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে নতুন মোড় আসে। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে `টাউন ক্লাব'-এর প্রতিষ্ঠা হয়। একইসঙ্গে `পুলিশ ক্লাব'-এরও উত্থান ঘটে। পুলিশ ক্লাবের উদ্যোগে `রিজিয়া' নাটক অভিনয় এবং পরবর্তীকালে `ভ্রমর', `বলিদান' প্রভৃতি নাটকও এই গোষ্ঠীর উদ্যোগে অভিনয় সার্থকতা লাভ করে।
নতুন দলের পাশাপাশি সে সময় মেদিনীপুর কলেজের ছাত্ররাও নাট্যচর্চায় নিজেদের নিয়োজিত রেখেছিল। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে মেদিনীপুর কলেজের ছাত্রদের দ্বারা অভিনীত নাটক দেখেছেন বলে চারুচন্দ্র সেন তাঁর লেখায় উল্লেখ করেছেন। এই মেদিনীপুর কলেজের ছাত্রদের উদ্যোগে ১৯১৪-এ `ভীষ্ম' এবং পরে `সাজাহান' ও `Merchant of Venice' নাটকগুলি অভিনীত হয়। কলেজের ছাত্রদের এই উদ্যোগের পাশাপাশি শহরের কয়েকজন উদ্যোগী যুবক গঠন করেন Midnapore Institute। মেদিনীপুর ইনস্টিটিউট শহরে পরপর দুটি নাটক অভিনয় করে। মীরবাজারে `খাসদখল' এবং পরে মাণিকপুরে `সাজাহান' নাটক দুটি অভিনীত হয়।
মেদিনীপুর ইউনিটের পাশাপাশি মাণিকপুরে Evening Club নামে একটি প্রতিষ্ঠানের উদ্ভব ঘটে। ইভিনিং ক্লাবের উদ্যোগে প্রথম অভিনীত নাটক `অহল্যাবাঈ'। এদের পাশাপাশি বল্লভপুরের Joints Club নামে একটি নাট্যগোষ্ঠী `সাবিত্রী', `ক্ষত্রবীর' এবং `শ্রীকৃষ্ণ' নাটকগুলি অভিনয় করেন। পাটনাবাজারে আর একটি নতুন নাট্যগোষ্ঠী `অতুল এ্যামেচার থিয়েটার', `দেবলাদেবী' নাটকটি অভিনয় করেন। আবার বড়বাজার সংলগ্ন বাসন্তীতলার কয়েকজন নাট্যপ্রেমী যুবকের গড়ে তোলা `রাঘব এ্যামেচার' কর্তৃক অভিনীত হয় বেশ কয়েকটি নাটক। অন্যদিকে Collectorate Recreation Club-এর প্রতিষ্ঠা ও নাট্য-উদ্যোগও এক্ষেত্রে স্মরণযোগ্য। প্রসঙ্গত বলে রাখা দরকার যে এইসকল দল বা গোষ্ঠীগুলি কিন্তু কেবলমাত্র সখের বশবর্তী হয়ে আনন্দ উপভোগের জন্যই নাটক অভিনয় করেছে। তাছাড়া এইসকল দলগুলি বাদেও আরো বেশকিছু নাট্যগোষ্ঠীর অভিনয় সফলতা মেদিনীপুরের নাট্যগেৌরবকে বৃদ্ধি করেছিল। এমনিভাবে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মেদিনীপুরের নাট্যপ্রেমিকগণ নাট্যচর্চায় বিভিন্ন ভাবে মনোনিবেশ করে নাট্যরস আস্বাদনে নাট্যমোদীদের উৎসাহিত করেছিলেন।
১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মেদিনীপুরের সাংস্কৃতিক কর্মীদের সংকটকাল গেছে। বিশেষত নাটকের উপর এই আঘাত এতটাই তীব্র ছিল যে তা নাট্য-উদ্যোগীদের কাছে প্রবল প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। জেলাশাসক বার্জ হত্যা, কারফিউ জারি ও যুবশক্তির উপর নির্মম অত্যাচার সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তবু এই সংকটের মাঝেও কলিজিয়েট স্কুলের ছাত্রদের দ্বারা `পথভ্রষ্ট' নাটিকাটি একপ্রকার জোর করে মঞ্চস্থ করা হয়। অতঃপর কারফিউ উঠে গেলে (১৯৩৭) সাহিত্য পরিষদ কর্তৃক `কর্ণার্জুন', `বাংলার মেয়ে', `পতিব্রতা' প্রভৃতি নাটকগুলি অভিনয় সফলতা পায়।
মেদিনীপুরে নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে মেদিনীপুর কলেজের ছাত্রগোষ্ঠীর পাশাপাশি বঙ্কিমদাস বন্দোপাধ্যায়, অধ্যাপক সুধীর দেব, সুনীল মিত্র প্রমুখ ব্যক্তির উদ্যোগে `বিজয়া', `শেষরঙ', `বৈকুণ্ঠেখাতা' প্রভৃতি সামাজিক নাটকগুলি মঞ্চস্থ হয়। এঁদের পাশাপাশি সর্বশ্রী পূর্ণেন্দু মাইতি, অজিত বন্দোপাধ্যায় ও সুধীর দাস মাল-এর নাম সবিশেষ উল্লেখ্য। তাছাড়া খগেন্দ্রনাথ রায়, নূটবিহারী বন্দোপাধ্যায় (পটলবাবু), কালী বন্দোপাধ্যায়, পঞ্চানন দে এঁদের সহযোগিতা ও উদ্যোগ মেদিনীপুরের নাট্যগতিকে ত্বরান্বিত করেছে।
ডায়মণ্ড এ্যামেচার থিয়েটারের অভিনয় দেখে সারা শহর তখন মুগ্ধ। সাফল্যের সঙ্গে অভিনেত্রী বর্জিত নাটক তাঁরা করে যাচ্ছিলেন। তাঁদের এই অভিনয় দেখে কিছু নাট্যমোদী ও নাট্যরসিক ব্যক্তির মধ্যে আর একটি দল গঠনের উদ্যোগ দেখা যায়। নতুন এই নাট্যদলের নাম হোল `বান্ধব নাট্য সমাজ'। এঁদের উৎসাহ ও উদ্দীপনায় ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে দীপাবলীর রাতে রুদ্রনারায়ণ রায়ের বাড়িতে `মেঘনাদবধ' ও পরের দিন `পূর্ণচন্দ্র' নাটক দুটি অভিনীত হয়।
১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যাসাগর স্মৃতিমন্দির প্রতিষ্ঠার পর ১৯৪০ সাল থেকে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ-এর মেদিনীপুর শাখা শহরে সামাজিক নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করে। ১৯৪২-এ `নাট্যশ্রী' প্রতিষ্ঠানের জন্মলাভ। বিয়াল্লিশের দুর্ভিক্ষ কবলিত মানুষের সাহায্যার্থে নাট্যশ্রী-র উদ্যোগে এবং পূর্ণেন্দু মাইতির পরিচালনায় `মেঘমুক্তি', `মাটির ঘর', `বন্ধু' প্রভৃতি নাটক সাফল্যের সঙ্গে একাধিক রাত্রি মঞ্চস্থ হয়। অন্যদিকে ১৯৪৮-৫৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত `ডায়মণ্ড ক্লাব'-এর ভূমিকা উল্লেখ করার মতো। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ১৯৫৪ সালে নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ি তাঁর জন্মভূমি মেদিনীপুরে সতীর্থদের নিয়ে `প্রফুল্ল' নাটক অভিনয় করেন। ১৯৪০ থেকে ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মেদিনীপুর শহরে দিকপাল অভিনেতা হিসেবে যাঁরা সুপ্রতিষ্ঠিত হন তাঁরা হলেন, `ডায়মণ্ড ক্লাব'-এর পটল ব্যানার্জী, কালী ব্যানার্জী, মৃতুঞ্জয় সাউ; `তারা নাট্যপীঠ'-এর হিমাংশু রায়; `মেদিনীপুর নাট্য পরিষদ'-এর পূর্ণেন্দুকুমার মাইতি; `বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ'-এর অজিতকুমার বন্দোপাধ্যায় প্রমুখ।
midnapore.in