ভারতের মুক্তিযুদ্ধে ক্ষুদিরাম-এর আত্মবলিদানের প্রভাব
Impact of Khudiram's Sacrifice in India's freedom struggle
भारत के स्वतंत्रता संग्राम में खुदीराम के बलिदान का प्रभाव
অরিন্দম ভৌমিক।
১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে এ.ও. হুম (A.O. Hume)-এর পরামর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ৭২ জন প্রতিনিধি বোম্বেতে মিলিত হয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস (Indian National Congress)। কিন্তু এরা সবাই ছিলেন পাশ্চাত্য-শিক্ষায় শিক্ষিত সফল গন্যমান্য ব্যাক্তি। প্রথমদিকে বার্ষিক সভায় আলোচনার পরে ব্রিটিশ রাজের প্রতি অনুগত্য প্রকাশ করাই যেন ছিল সংগঠনের প্রধান কাজ। যদিও এই সময় থেকেই প্রথম ছোট ছোট স্বাধীন রাজ্যের পরিবর্তে একটাই দেশ ভারতবর্ষ এই ধারণা জনগনের মধ্যে সুস্পষ্ট রূপ পায়। কিন্তু ব্রিটিশ রাজের ভুলনীতি বা অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মত নেতৃত্ত বা জনমত প্রায় ছিলনা বললেই চলে।
ঠিক এরকম সময়েই ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে আমাদের ক্ষুদিরামের জন্ম। ক্ষুদিরামের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, ফাঁসির মঞ্চে আত্মবলিদান দিতে পারলে ভারতের ঘরে ঘরে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠবে। আর সেই আগুনেই পুড়ে ছাই হবে অত্যাচারী ব্রিটিশের সাজানো সাম্রাজ্য। মুজাফ্ফরপুরে বোমা ছুড়লেন ক্ষুদিরাম এবং প্রফুল্ল। সেই বোমের আগুন এবং শব্দ ছড়িয়ে পড়ল দিকে দিকে। ফাঁসির মঞ্চে প্রহরীরা যখন তাঁকে নিয়ে যাচ্ছিল, দেখে মনে হয়েছিল যেন ক্ষুদিরাম ওই প্রহরীদের টেনে নিয়ে যাচ্ছেন ফাঁসির মঞ্চে দিকে। মুজাফ্ফরপুরে হাঁসি মুখে মাথা উঁচু করে ফাঁসির দড়ি গলায় পরেছিলেন আমাদের ক্ষুদিরাম।
মুজাফ্ফরপুর থেকে অনেক দূরে কটক শহরে একটি ছোট্ট ছেলের মন আকুল হয়েছিল এই ঘটনায়। সেদিনের সেই ছোট্ট ছেলেটি ক্ষুদিরামের স্বপ্ন বুকে নিয়ে বড় হয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে এক ঐতিহাসিক সংগ্রাম পরিচালনা করেছিলেন। তাঁর নাম নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস।
শুধু নেতাজি নয়, ক্ষুদিরামের আত্মবলিদান সেদিন দেশের সমস্ত মানুষকেই অনুপ্রাণিত করেছিল। ১৯০৮ সালে ক্ষুদিরামের ফাঁসির ঠিক ৩ মাস পরে আলিপুর জেলের মধ্যেই বিশ্বাসঘাতক নরেন গোস্বামীকে গুলি করে মেরেছিলেন বিপ্লবী কানাই দত্ত ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু। আদালতে কানাইকে যখন জিজ্ঞেস করা হয় যে, সে জেলের মধ্যে বন্দুক কোথা থেকে পেল, উত্তরে সে বলেছিল— ‘‘ক্ষুদিরামের ভূত এসে আমাকে জেলের মধ্যে বন্দুক দিয়ে গেছে।’’
বিচারে ফাঁসি হয় কানাই এবং সত্যেনের। ক্ষুদিরামের আত্মবলিদান প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবীদেরও অনুপ্রাণিত করেছিল। একই বছর লন্ডনের ইন্ডিয়া-হাউসের সভায় মাদাম কামা তাঁর ভাষণের সময় একটি পতাকা তুলে ধরেন (flag woven in silk and gold)। পতাকার মধ্যে সোনালি অক্ষরে লেখা ছিল—‘‘In memory of the Martyrs of 1908’’। তিনি সবাইকে ক্ষুদিরামের মতো আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত হতে বলেছিলেন।
১৯০৯ সালে মদনলাল ধীঙড়া (MadanLal Dhingra) লন্ডনে কার্জন ওয়াল্লি (Curzon Wyllie)-কে গুলি করে হত্যা করেন। বিচারে তাঁর ফাঁসি হয়। এইভাবে ক্ষুদিরামের আত্মাহুতির আগুন দেশের সীমানা পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল ইংল্যান্ড পর্যন্ত।
তাঁর আত্মবলিদান মেদিনীপুরে যে বিদ্রোহের আগুন জেলেছিল তা সময়ের সঙ্গে এতটাই প্রবল হয়েছিল যে ১৯৩০ সালে মেদিনীপুরের বিপ্লবীরা সরাসরি ব্রিটিশ শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করে ঘোষণা করলেন - কোন ব্রিটিশ জেলা-শাসককে মেদিনীপুরে থাকতে দেওয়া হবেনা। ১৯৩১ সালে বিমল দাসগুপ্ত এবং জ্যোতিজীবন ঘোষ হত্যা করলেন অত্যাচারী জেলাশাসক জেমস প্যাডিকে। পরের বছর ১৯৩২ সালে প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্য এবং প্রভাংশু পাল-এর গুলিতে প্রাণ হারালেন জেলাশাসক ডগলাস। উল্লেখযোগ্য যে ডগলাসকে মারার কিছুক্ষন আগেই প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্য ঠান্ডা মাথায় কেরাম খেলছিলেন ক্ষুদিরামের দিদি অপরূপা দেবীর বাড়িতে। কেউ বিন্দুমাত্র অনুমান করতে পারেননি যে কিছুক্ষন পরে তিনি শহীদ হতে চলেছেন। - ১৯৩৩ সালে শতচেষ্টার পরেও ইংরেজ শক্তি তৃতীয় জেলাশাসকের প্রাণ রক্ষা করতে পারলোনা। মৃগেন্দ্রনাথ দত্ত এবং অনাথবন্ধু পাঞ্জার গুলিতে প্রাণ হারালেন বার্জ। পর পর তিন বছর প্যাডি, ডগলাস ও বার্জ নামে তিনজন ব্রিটিশ জেলা-শাসককে হত্যা করলেন মেদিনীপুরের বিপ্লবীরা। শহীদ হলেন প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্য, মৃগেন্দ্রনাথ দত্ত, অনাথবন্ধু পাঞ্জা, রামকৃষ্ণ রায়, ব্রজকিশোর চক্রবর্তী এবং নির্মলজীবন ঘোষ। এর পরে ব্রিটিশ সরকারের আর কোন দিনই সাহস হয়নি কোন ইউরোপীয় জেলা শাসককে মেদিনীপুরে পাঠানোর।
১৯৪২ সালে মেদিনীপুর জেলার বিভিন্ন প্রান্তে ইংরেজ শাসন বন্ধ করে গঠিত হয় বেশ কিছু জাতীয় সরকার। স্বাধীনতার আগেই স্বাধীন হয় এই সমস্ত অঞ্চল। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল "তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার"। এই সরকারের নিজস্ব প্রতিরক্ষা বিভাগ, আইন-শৃঙ্খলা বিভাগ, স্বাস্থ বিভাগ, শিক্ষা বিভাগ, বিচার বিভাগ, কৃষি বিভাগ, অর্থ দপ্তর, প্রচার বিভাগ ইত্যাদি ছিল। ১৯৪৪ সালে গান্ধীজির নির্দেশে এই সরকারের কার্যকলাপ বন্ধ করা হয়।
ঘোষণা হল যে ১৯৪৭ সালে ১৫ই আগস্ট দেশ স্বাধীন হবে। ১৪ই আগস্ট বিকেল বেলায় ক্ষুদিরামের মাতৃসম দিদি অপরূপাদেবীকে ঘোড়ার গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হল হবিবপুরের সেই জায়গায় যেখানে জন্ম নিয়েছিলেন ক্ষুদিরাম। সেই নিদৃস্ট জায়গাটি চিহ্নিত করলেন অপরূপাদেবী। কিছুক্ষনের মধ্যেই সেই জায়গায় বানিয়ে ফেলা হল একটি বেদি। সেইদিন রাত ১২ টার সময় যখন দেশ স্বাধীন হল, তখন সেই বেদি থেকেই বহু মানুষ মশাল ও জাতীয় পতাকা হাতে শহর প্রদক্ষিণ করেছিলেন। আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হচ্ছিল দেশমাতৃকার জয়োধ্বনি। মুজাফ্ফরপুরের সেই বোমার আগুন এবং শব্দ যেন তখনও ঘুরছিল দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।