কিয়ারচাঁদ- অতীত বাঙলার এক প্রধান জৈনপীঠ
Kiarchand - a major Jain Peeth of Bengal in the past
সুশীলকুমার বর্মন।
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার পশ্চিম প্রান্তে কেশিয়াড়ি ব্লকের কিয়ারচন্দ্র বা কিয়ারচাঁদ গ্রাম সুবর্ণরেখার উপকূলে অবস্থিত। গ্রামের বাসরাস্তার ধারে ফুটবল মাঠের চারপাশে সার দিয়ে দেউলাকৃতি পাথরের স্তম্ভ ও নক্সা করা চাঁই দেখে অবাক হতে হয়। বিস্ময় জাগে এত স্তম্ভ, এত চাঁই এল কোথা থেকে ! এই অঞ্চলের ঐতিহাসিক কুসমাদিঘির পাড়ে ও পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলিতে ছড়িয়ে আছেএরকম বহু স্তম্ভ, চাঁই, খাঁজকাটা আমলক ও ভগ্ন প্রস্তরফলক। আর রয়েছে জৈন তীর্থঙ্কর ও জৈন দেবদেবীর অনেক মূর্তি। এসব দেখে বোঝা যায় অতীতে এখানে ছিল এক বৃহৎ জৈন ধর্মকেন্দ্র। এই জৈন কেন্দ্রে ছিল বেশ কয়েকটি দেউল। জৈনদের পরিত্যক্ত প্রস্তর দেউলগুলি কালের নিয়মে ভূমিশয্যা গ্রহণ করেছে এবং প্রস্তর নির্মিত মূর্তিগুলি ভগ্ন, অর্ধভগ্ন ও ক্ষয়িত হয়ে এখানে ওখানে ছড়িয়ে পড়েছে। সেই জৈন মূর্তিগুলিকে গ্রামবাসীরা স্থানীয় দেবদেবী বা লৌকিক দেবদেবী জ্ঞানে পুজো করছেন।
কিয়ারচাঁদের পার্শ্বনাথ
কিয়ারচাঁদ গ্রামের পাত্রদের পুকুরপাড়ে মাটি চাপা পড়ে আছে মাকড়া পাথরের তৈরি খণ্ডবিখণ্ড শায়িত এক মূর্তি। বাঁশপাতার আস্তরণ সরিয়ে বৃহৎ মূর্তির যতটা অংশ দৃশ্যমান তাতে বোঝা গেল একটি খণ্ড আছে জানু থেকে পাদবেদি পর্যন্ত। এটি সর্পকুণ্ডলীবেদিতে পার্শ্বনাথের কায়োৎসর্গ মূর্তির নিম্নাংশ। খণ্ডটি লম্বায় প্রায় ৪ ফুট এবং প্রস্থে প্রায় তিন ফুট। মূর্তির ওপরে গাছের শিকড় বিস্তারলাভ করেছে।
কিয়ারচাঁদের মাটি আবৃত বিশালাকার পার্শ্বনাথ।
অপর খণ্ডটি বক্ষ থেকে শিরশ্ছত্র পর্যন্ত। ছাতি এবং দক্ষিণবাহু স্পষ্ট, মুখমণ্ডলক্ষতিগ্রস্ত, কর্ণলতিকায়কুণ্ডলের চিহ্ন, মস্তকে সপ্তফনাছত্র। চালি বা মেড়ে গ্রহাদি ও বিদ্যাধরের ক্ষয়ে যাওয়া মূর্তি। এই খণ্ডটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৩ ফুট। অর্থাৎ সম্পূর্ণ মূর্তিটির দৈর্ঘ্য ছিল কম পক্ষে ৭ ফুট। এটি জোইন ধর্মের ২৩তম তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথের মুর্তি। পাত্র পরিবারের প্রবীণা বৃন্দাবতী পাত্র জানালেন, পাদদেশে সর্পকুণ্ডলী এবং সর্পছত্র থাকায় মূর্তিটিকে তাঁরা মা মনসা জ্ঞানে পুজো করেন।
মৎনগরের ঋষভনাথ ও চক্রেশ্বরী
কিয়ারচাঁদের উত্তরে মৎনগর গ্রামে পলাশ বেষ্টিত ঢিবিতে বটতলার বাঁধানো চাতালেরক্ষিত আছে মাকড়া পাথরের দুটি অতীব ক্ষয়িত মূর্তি। একটি মূর্তি কায়োৎসর্গ মুদ্রায় দণ্ডায়মানতীর্থঙ্করের। হস্তদ্বয় আজানুলম্বিত, মুখমণ্ডল ক্ষতিগ্রস্ত, কর্ণদ্বয়ে কুণ্ডল, মস্তকে শিরস্ত্রাণের অবশেষ। চালির উভয় পার্শ্বে খোদিত মূর্তিগুলি প্রায় নিশ্চিহ্ন।চালিসহ মূর্তির উচ্চতা প্রায় সাত ফুট ও প্রস্থ চার ফুট। পাদবেদি ভগ্ন হওয়ায় এবং লাঞ্ছন চিহ্ন না থাকায় তীর্থঙ্করের পরিচয় অনুমান সাপেক্ষ।
মৎনগরের ঋষভনাথ ও চক্রেশ্বরী।
আমার অনুমান মুর্তিটি প্রথম তীর্থঙ্কর ঋষভনাথের। তীর্থঙ্করের বামে দণ্ডায়মান এক চতুর্ভূজা দেবীমূর্তি। চালিসহ প্রায় তিন ফুট উচ্চতার দেবীর নিম্নে প্রসারিত হস্তদ্বয়ে ধৃত দুটি চক্র। অপর দুটি হস্ত উর্দ্ধমুখী ও ভগ্ন। মূর্তির পদপার্শ্বে দুই সেবাদাসী। ইনি ঋষভনাথের শাসনদেবী চক্রেশ্বরীবা অপ্রতিচক্র। মথুরার জাদুঘরে দশম শতাব্দীর চক্রেশ্বরী মূর্তি রক্ষিত আছে। সম্ভবত এই দুটি মুর্তি একই দেউলে প্রতিষ্ঠিত ছিল। তাই গ্রামবাসীগণ দুটি মূর্তিকে একই স্থানে রেখেছেন। মৎনগর গ্রামবাসীগণ মূর্তিদ্বয়কে মা মনসা রূপে পুজো করেন।
মড়াদিঘির নেমিনাথ ও অম্বিকা
কিয়ারচাঁদের উত্তরে আর এক গ্রাম মড়াদিঘি। মড়াদিঘি ও রণবনিয়া গ্রামের সীমানায় শীতলামন্দিরের প্রাঙ্গণে রাস্তার কাছে একটি তীর্থঙ্কর ও একটি অষ্টভূজা দেবীমূর্তি রয়েছে। প্রস্তর নির্মিত বহু প্রাচিন মূর্তিগুলি এখানে চণ্ডীবুড়ি নামে পূজিত হয়। কায়োৎসর্গ মুদ্রায় দণ্ডায়মান দিগম্বর তীর্থঙ্কর মূর্তি মাকড়াপাথরের তৈরি। মূর্তির পাদবেদি ও পুরুষাঙ্গ নিশ্চিহ্ন, পদপার্শ্বে সেবাদাস, মুখমণ্ডল ক্ষতিগ্রস্ত, মস্তক-পশ্চাতে চক্র, মস্তকপার্শ্বে বিদ্যাধরের মূর্তি।
মড়াদিঘির নেমিনাথ ও অম্বিকা ।
তীর্থঙ্করের বামপার্শ্বে রক্ষিত বেলেপাথরের তৈরি দশভুজা দেবীমূর্তিটি দ্বিখণ্ডিত। দেবীর নিম্নে প্রসারিত দুটি হস্ত দুটি শিশুর মস্তক স্পর্শ করে রয়েছে। অপরাপর হস্তে সম্ভবত শঙ্খ,চক্র, ধনু, খড়্গ, শস্য, আম্রশাখা রয়েছে। মস্তকে চক্রাকারে বেষ্টিত যে চূড়াটি রয়েছে সেটি আম্রসহ আম্রশাখা হতে পারে। এই সমস্ত চিহ্ন থেকে অনুমান করা যায় ইনি নেমিনাথের শাসনদেবীঅম্বিকা এবং পাশে দণ্ডায়মান ২২তম তীর্থঙ্কর নেমিনাথ। এই দুটি মুর্তিও একই দেউল থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।
রানা গ্রামের অম্বিকা
মৎনগরের পূর্বে অবস্থিত রানা গ্রামের শিবামন্দির চত্বরে উঁচু বেদিতে রক্ষিত আছে মাকড়া পাথরের দ্বিভূজা অম্বিকা মূর্তি। বাম পা ভাঁজ করা ও ডান পা প্রলম্বিত অর্ধ-পদ্মাসনাদেবীর বাম জানুর ওপর বসে এক শিশু,ডান পাশে দণ্ডায়মান আর এক শিশু। দেবীর ডান হাতে ফলসহ আম্রশাখা।
রানা গ্রামের অম্বিকা।
দেবী কন্ঠহার, কর্ণকুণ্ডল,বাজুবন্ধ ও কটিবন্ধে সুসজ্জিতা। একটি বস্ত্রখণ্ড দেবীর গলদেশ থেকে উন্মুক্ত স্তনযুগলের মধ্যভাগ দিয়ে প্রলম্বিত হয়ে কটিদেশ অতিক্রম করেছে। অনিন্দ্যসুন্দর এই মূর্তিটির উচ্চতা প্রায় সাড়ে ৫ ফুট,প্রস্থ সাড়ে ৩ ফুট। দেবীর পাশে রাখা আছে মাকড়াপাথরের তৈরি এক অশ্বারোহী মূর্তি।
বেহারাসাইয়ের যক্ষ
কিয়ারচাঁদের উত্তর-পূর্বে বেহারাসাই। গ্রামের প্রবেশপথে বটতলায় একটি বেলেপাথরের দ্বিভূজ দেবমূর্তি মা বাসুলি রূপে পূজিত হন। বস্ত্র পরিহিত মূর্তির হস্তে কুঠার ও শক্তি। মাথায় সুদৃশ্য উষ্ণীষ, গলায় সুশোভন হার, বাহুতে বাজুবন্ধ। এটি সম্ভবত কোন যক্ষ মূর্তি। আমরা জানি প্রত্যেক তীর্থঙ্করের একজন যক্ষ বা শাসনদেবতা ও একজন যক্ষিণী বা শাসনদেবী থাকেন। ঋষভনাথের যক্ষের নাম গোমুখ, পার্শ্বনাথের ধরনেন্দ্র ও মহাবীরের মাতঙ্গ। তীর্থঙ্করের সঙ্গে দেউলে যক্ষ ও যক্ষিণীর প্রতিমা স্থাপন করেপুজো করা হয়। আমার অনুমান এই মূর্তিটি নেমিনাথের যক্ষ গোমেধের।
রণবনিয়ার যক্ষ ও বিজয়া
মৎনগরের উত্তরে রণবনিয়া গ্রামের শীতলামন্দির প্রাঙ্গণে রয়েছে দুটি মূর্তি। একটি প্রায় তিন ফুট উচ্চতার বস্ত্র ও অলঙ্কারে ভূষিত বেলেপাথরের পুরুষ মূর্তি। মূর্তির বাম হস্ত ও মস্তক নিশ্চিহ্ন। এটি কোন যক্ষমূর্তি। যক্ষমূর্তির পাশে রয়েছে প্রায় সাড়ে চার ফুট উঁচু মাকড়া পাথরের তৈরি ক্ষয়প্রাপ্ত চতুর্ভূজা যক্ষিণী মূর্তি। মূর্তির ডান হাতে ধনুক, বাম হাতে বাণ ও অন্যান্য আয়ুধ। মূর্তিটি সম্ভবত ত্রয়োদশ তীর্থঙ্কর বিমলনাথেরযক্ষিণী বিদিতা বা বিজয়ার। পাশে রাখা খাঁজকাটা অর্ধ চক্রাকার খণ্ডটি বিজয়ার চালির বা মেড়ের ঊর্ধ্বাংশ।
শ্রদ্ধা-ফলক ও আমলক
গ্রামের বিভিন্ন স্থানে, রাস্তার ধারে, ফুটবল মাঠের চারপাশে প্রোথিত রয়েছে ক্ষুদ্র দেউলাকৃতি শতাধিক প্রস্তর স্তম্ভ। স্তম্ভগুলির উচ্চতা আড়াই ফুট থেকে সাড়ে ৭-৮ ফুট পর্যন্ত। ‘পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি’ পুস্তকে বিনয় ঘোষ এই স্তম্ভগুলিকে স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কোন কোন গবেষক এগুলিকে বলেছেন প্রস্তর সৈন। আগেকার রাজারা নাকি এই প্রস্তর সৈনের সঙ্গে জ্বলন্ত মশাল বেঁধে শত্রুপক্ষের ভ্রম উদ্রেক করতেন। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস এগুলি জৈনদের স্মৃতিস্তম্ভ বা নিবেদন শিলা বা শ্রদ্ধাফলক। জৈন তীর্থঙ্কর বা জৈন দেবদেবীর উদ্দেশ্যে দেউলাকৃতি শিলা নিবেদন করার রীতি ছিল। মৃত ব্যক্তির মঙ্গল কামনায়ও এই ক্ষুদ্রাকার দেউল নিবেদন করা হত। তাই এগুলিকে নিবেদন দেউলও বলা হয়। একই রকম নিবেদন দেউল বা নিবেদন শিলা দেখা যায় ঝাড়গ্রাম জেলার রাজপাড়া ও নুনিয়ার ধ্বংসপ্রাপ্ত জৈনক্ষেত্রে।
কিয়ারচাঁদ গ্রাম-এর পাথরের স্তম্ভ। ছবিঃ অরিন্দম ভৌমিক (2009)।
মেদিনীপুরের একটি সংগ্রশালায় রক্ষিত কিয়ারচাঁদ গ্রাম থেকে প্রাপ্ত শিবলিঙ্গ। ছবিঃ অরিন্দম ভৌমিক (2009)।
নিবেদন দেউল ছাড়াও কিয়ারচাঁদ ও পাশাপাশি গ্রামগুলিতে যত্রতত্র ছড়িয়ে রয়েছে আমলক ও আমলক খণ্ড। সর্ববৃহৎ ও প্রায় অক্ষত আমলকটি রয়েছে কিয়ারচাঁদ গ্রামের খগেন মুর্মুর বাগানে। মাকড়া পাথরের তৈরি সুচারু খাঁজকাটা এই আমলকটির ব্যাস প্রায় পাঁচ ফুট। আর একটি আমলক পড়ে রয়েছে বেহেরাসাইয়ে প্রদীপকুমার মাইতির উঠোনে। পদ্মপাপড়ির আকারে খাঁজকাটা চক্রাকার আমলকগুলি যে অতীতে দেউলের চূড়ায় শোভাবর্ধন করত সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।
কিয়ারচাঁদ নিয়ে অন্যান্য প্রবন্ধ -
● কিয়ারচাঁদ- এক বিলুপ্তপ্রায় প্রত্নক্ষেত্র, চৈতালি কুণ্ডু নায়েক।
● উপেক্ষিত লোকেশ্বর বিষ্ণু, শুদ্ধসত্ত্ব মান্না।
● কিয়ারচাঁদ- অতীত বাঙলার এক প্রধান জৈনপীঠ।
● বেহেরাসাই এর সূর্য মূর্তি :: একটি পর্যবেক্ষণ।
midnapore.in
(Published on 20.08.2022)