Surya Murti of Beherasai :: An Observation | বেহেরাসাই এর সূর্য মূর্তি :: একটি পর্যবেক্ষণ

বেহেরাসাই এর সূর্য মূর্তি :: একটি পর্যবেক্ষণ

Surya Murti of Beherasai :: An Observation

শুদ্ধসত্ত্ব মান্না।


ঋগ্বেদের অন্যতম প্রধান দেবতা সূর্য। তেজ বা প্রাণশক্তি স্বরূপ সূর্য সমস্ত বিশ্ব চরাচরের আত্মা রূপে ঋগ্বেদে স্তুত হয়েছেন। অথর্ব বেদে বলা হয়েছে, সূর্য জল স্থল অন্তরীক্ষের দ্রষ্টা। সূর্য প্রাণীদের একমাত্র চক্ষু স্বরূপ। তিনি দ্যুলোক ও মর্ত্যলোকে অবস্থানকারী।


Surya Murti of Beherasai :: An Observation | বেহেরাসাই এর সূর্য মূর্তি :: একটি পর্যবেক্ষণ
Surya Murti of Beherasai :: An Observation | বেহেরাসাই এর সূর্য মূর্তি :: একটি পর্যবেক্ষণ

সারদা তিলকতন্ত্রে সূর্যের পাঁচটি মূর্তির কথা বলা হয়েছে। - সূর্য, ভাস্কর, ভানু, রবি ও দিবাকর। সায়নাচার্যের মতে, উদয়ের পূর্বে সূর্যের যে মূর্তি তা সবিতা। উদয় থেকে অস্ত পর্যন্ত যে মূর্তি তাকে সূর্য বলা হয়। সূর্য মূর্তির প্রাচীনতম বর্ণনা বৃহৎসংহিতার প্রতিমালক্ষণম্ অধ্যায়ে রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, দেবতা উদীচ্য বেশে (আজানুলম্বিত লম্বা গাত্রাবরণ) সজ্জিত হবেন, তাঁর পা থেকে বুক পর্যন্ত ঢাকা থাকবে। তাঁর দুই হাতে দুটি সনাল পদ্ম থাকবে। তাঁর মাথায় মুকুট, গলায় হার, কানে কুণ্ডল, কোমরে বিয়ঙ্গ বা অব্যঙ্গ নামক মেখলা থাকবে। বিশ্বকর্মা শিল্প অনুসারে, সূর্যের দক্ষিণে নিকুম্ভা বামে রাজ্ঞী থাকবেন। আবার, ভবিষ্য পুরাণ অনুসারে সূর্যের পাশে অশ্বিনীকুমারদ্বয় থাকবেন।



বাঙালির ইতিহাস : আদি পর্ব গ্রন্থে নীহাররঞ্জন রায় বলেছেন, সাম্প্রতিক বাংলায় এমনকি মধ্যযুগীয় বাংলায় সূর্য প্রতিমার স্বাধীন স্বতন্ত্র পূজার প্রমাণ কিছু দেখতে পাওয়া যায় না। অথচ গুপ্ত পর্ব থেকে উদীচ্যবেশী ইরানী ধ্যান কল্পনার সূর্য পূজা বাংলাদেশে সুপ্রচারিত ছিল ও আদি পর্বের শেষ পর্যন্ত তার প্রচার ও প্রসার বেড়েই গিয়েছিল। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে প্রাপ্ত অসংখ্য সূর্য মূর্তি তার প্রমাণ। সেন পর্বে বিশ্বরূপ ও কেশব সেন ছিলেন পরম সৌর। সেসময় এই ধর্ম রাজবংশের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিল।



পাল পর্বেও সূর্য পূজা যথেষ্ট প্রসার লাভ করেছিল। পাল পর্বের সূর্য প্রতিমা বৈদিক পৌরাণিক ধ্যান কল্পনায় রূপায়িত, দেবতার পদাবরণেই শুধু পারসিক প্রভাবের প্রতিফলন। সমকালীন এক মূর্তিলেখে সূর্যকে 'সমস্তরোগানাং হর্তা' বলে বর্ণনা করা হয়েছে। সূর্যের পূজা করলে আরোগ্য লাভ হবে - সূর্য পুজার পেছনে জনমানসে এমন ভাবনাই সক্রিয় ছিল।


Surya Murti of Beherasai :: An Observation | বেহেরাসাই এর সূর্য মূর্তি :: একটি পর্যবেক্ষণ
Surya Murti of Beherasai :: An Observation | বেহেরাসাই এর সূর্য মূর্তি :: একটি পর্যবেক্ষণ

গুরুত্বের দিক থেকে বাংলায় প্রাপ্ত দেবমূর্তিগুলির মধ্যে সূর্যের স্থান তৃতীয়।বেশিরভাগই স্বতন্ত্র মূর্তি। বাংলাদেশে প্রাপ্ত এই সমস্ত সূর্য মূর্তির বেশিরভাগই স্থানক বা দণ্ডায়মান মূর্তি। এই সমস্ত সূর্য মূর্তিই উদীচ্য পদাবরণ পরিহিত। গুপ্ত যুগের মূর্তিগুলি এক চক্র রথে সপ্তাশ্ব যোজিত থাকতো। সূর্যের হাতে অত্যন্ত সুন্দর ভাবে প্রস্ফুটিত দুটি সনাল পদ্ম থাকতো। গুপ্ত পরবর্তী যুগে সূর্য মূর্তি গুলির পরিবার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। দেবমূর্তির সামনে বা পাশে তাঁর সারথি অরুণ, মহাশ্বেতা বা পৃথিবী, রাজ্ঞী (সংজ্ঞা) , ছায়া, নিক্ষুভা ও সুর্বচসা নামক পত্নীগণ, দণ্ডী ও পিঙ্গল নামক অনুচর, অন্ধকার বিনাশকারী ঊয়া ও প্রত্যুষা দেবীদের প্রভৃতিকে দেখা যায়।



দক্ষিণ বঙ্গের বহু জায়গায় সূর্য মূর্তি পাওয়া গিয়েছে । মেদিনীপুরও তার ব্যতিক্রম নয়। এই জেলার নয়াগ্রামের কমলপুরে (বর্তমানে ঝাড়গ্রাম জেলার অন্তর্গত) সুবর্ণরেখা নদীর বালির চরে ১৯১৩ সালে সূর্য মূর্তি পাওয়া গিয়েছিল। দাঁতনে সূর্যপুত্র রেবন্তের মূর্তি দেখা যায়। খড়্গপুর থানার রাউতমণিতে এবং কেশিয়াড়ি থানার অন্তর্গত বেহেরাসাইতেও সূর্য মূর্তি দেখা যায়।

কেশিয়াড়ি থেকে হাতিগেড়িয়া হয়ে রোহিণী যাওয়ার পথে পড়ে বেহেরাসাই বাস স্টপ। এই বাস স্টপের পাশেই সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠের ধারে বট গাছতলায় রয়েছে আড়াই ফুট উচ্চতার পাথরের এক প্রাচীন সূর্য মূর্তি। বিশিষ্ট পুরাতত্ত্ববিদ তারাপদ সাঁতরা তাঁর "পুরাকীর্তি সমীক্ষা : মেদিনীপুর" গ্রন্থে বলেছেন, মূর্তিটি দশ বা এগারো শতকের অর্থাৎ এটি পাল পর্বের।



এই মূর্তিটি খুব ভালো করে দেখলে দেখা যায়, এটি স্থানক অর্থাৎ দণ্ডায়মান মূর্তি। তিনি পাতলা কাপড় পরিহিত। বুকের কাছে দুহাতে ধরা দুটি সনাল পদ্ম। তাঁর মাথায় মুকুট, কানে দুল , গলায় মণিহার, হাতে বালা, বাজুবন্ধ, বুকে উপবীত ও বর্ম। পাদুকা আছে কিনা সুস্পষ্ট নয়, তবে যেটা বিষ্ময়কর - মূর্তিটির কোমরে নাগ বন্ধনী! মূর্তিটির মাথার দুপাশে উড়ন্ত বিদ্যাধর সুস্পষ্ট। মূর্তিটির পায়ের কাছে বামে ও ডানে দুটি দণ্ডায়মান মনুষ্য মূর্তি দেখা যায়। এদের মধ্যে সূর্যের বামদিকের মূর্তিটির হাতে চামর জাতীয় জিনিস দেখা যায়। এ থেকে বোঝা যায় যে, এটি সংজ্ঞা-র মূর্তি। সংজ্ঞা সূর্যের স্ত্রী। তাঁর অন্য নাম সরণ্যু, সাবিত্রী ও অনসূয়া। তিনি ত্বষ্টা বা বিশ্বকর্মার কন্যা। তিনি সূর্যের বামে থেকে বালব্যজন করেন। সূর্যের ডান দিকের মূর্তিটির দুই হাত বুকের কাছে জড়ো করা ; কিন্তু হাতে কিছু আছে কিনা তা সুস্পষ্ট নয়। তবুও মনে হয়, ইনি সূর্যের পার্শ্ব দেবতা দণ্ডী বা কুণ্ডী। কেননা, অগ্নিপুরাণ অনুসারে, দণ্ডী সূর্যের দ্বারী। তিনি মসীপাত্র ও লেখনী হাতে (সূর্যের) ডান দিকে অবস্থান করেন। এই মূর্তিটির পাশে একটি ছোট শিবলিঙ্গ ও দেখা যায়। বহু বছর ধরে রোদ জল ঝড় সয়েও মূর্তিটির সিংহভাগ এখনো অক্ষত রয়েছে। এই মূর্তিটির আশেপাশে স্তম্ভাকারে পাথুরে সৈন্যদের উপস্থিতি দেখা যায়।

পাল ও সেন পর্বে দক্ষিণবঙ্গেও যে সূর্য পূজা সুপ্রচলিত ছিল এবং সুন্দর মূর্তি তৈরি হতো তার একটি উদাহরণ বেহেরাসাই এর এই সূর্য মূর্তিটি।


Surya Murti of Beherasai :: An Observation | বেহেরাসাই এর সূর্য মূর্তি :: একটি পর্যবেক্ষণ
Surya Murti of Beherasai :: An Observation | বেহেরাসাই এর সূর্য মূর্তি :: একটি পর্যবেক্ষণ

কিন্তু এই মূর্তিও প্রায় উপেক্ষিত। এই অঞ্চলে আরও অনেক প্রাচীন মূর্তি রয়েছে। স্থাপত্য বিদ্যার ছাত্রছাত্রীদের কাছে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হলেও রাজ্যের পুরাতত্ত্ব বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসন এগুলির সম্পর্কে উদাসীন । কিছু স্থানীয় মানুষের শ্রদ্ধায় ও ভক্তিতে মূর্তিগুলি এখনো অটুট। কিন্তু এভাবে কতদিন???


কিয়ারচাঁদ নিয়ে অন্যান্য প্রবন্ধ -

● কিয়ারচাঁদ- এক বিলুপ্তপ্রায় প্রত্নক্ষেত্র, চৈতালি কুণ্ডু নায়েক।
● উপেক্ষিত লোকেশ্বর বিষ্ণু, শুদ্ধসত্ত্ব মান্না।
● কিয়ারচাঁদ- অতীত বাঙলার এক প্রধান জৈনপীঠ।
● বেহেরাসাই এর সূর্য মূর্তি :: একটি পর্যবেক্ষণ।

midnapore.in

(Published on 05.11.2022)

তথ্য সহায়তা :
● বাঙালির ইতিহাস : আদি পর্ব - নীহাররঞ্জন রায়
● পঞ্চোপাসনা - জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
● হিন্দুদের দেবদেবী : উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ - হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য
● পুরাকীর্তি সমীক্ষা : মেদিনীপুর - তারাপদ সাঁতরা
● কিয়ারচাঁদ - এক বিলুপ্তপ্রায় প্রত্নক্ষেত্র - শ্রীমতী চৈতালী কুণ্ডু নায়েক
● কৌলাল পত্রিকা
● উইকিপিডিয়া ও অন্যান্য সাইট।।

ছবি :
● নিজস্ব।