কমলেশ নন্দ।
ন তচ্ছুতং ন তচ্ছিল্পং ন সা বিদ্যা ন সা কলা।।
ন স যোগো ন তৎকর্ম নাট্যেহস্মন্ষন্ন দৃশ্যতে।
সর্বশাস্ত্রাণি শিল্পানি কর্মাণি বিবিধানি চ।।
অস্মিন্নাট্যে সমেতানি তস্মাদেতন্ময়া কৃতম্।
নাট্যাচার্য ভরত মুনি নাটকের মধ্যে এই সমস্ত কিছু বিষয়ের মহামিলিত রূপের কথা তাঁর নাট্যশাস্ত্র গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। প্রকৃতই এমন কোনো জ্ঞান, শিল্প, কলা, যোগ, বিদ্যা বা কর্ম নেই যা নাটকের মধ্যে পাওয়া যায় না। এক কথায় নাটক আমাদের জীবনের দর্পণ। যে দর্পণে কেবল নিজের মুখ নয় বহু মুখ উদ্ভাসিত হয়ে সমাজ ও মনের উত্তরণ ঘটায়। আর সে কারণেরই সাহিত্যের অন্য সকল শাখাগুলির মধ্যে এই শাখাটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র হিসেবে বিবেচিত হয়। কেবল বিনোদনার্থে নয় সমাজ শোধনের ক্ষেত্রেও প্রত্যক্ষ ভাবে দৃশ্যকাব্যের ভূমিকার কথা স্বীকার করতেই হয়।
জীবনর বহু বিচিত্র রূপের এই শক্তিশালী দর্পণ-এর অভিনয় সাফল্যতার পেছনে রয়েছে নাট্যকার, অভিনেতা, প্রযোজক এবং দর্শকের সহৃদয় সহযোগিতা। কেননা নাটক একটি Composit Arts বা মিশ্র চারুকলা। সেখানে সকলের আন্তরিক সহযোগিতা ছাড়া তা কখনোই সাফল্যের রাজদ্বারে পৌঁছোতে পারে না।
দিনের ক্লান্তির অবসানে নীড়ে ফেরা পাখির মতো ঘরে ফেরা কর্মক্লান্ত মানুষের সাময়িক বিনোদনের জন্য বিদেশী শিল্প-সাহিত্য এবং শিল্পীর আদর্শে আদর্শায়িত হয়ে বিদেশী অভিনয় ধারাকে অনুসরণ করে এদেশের সখের থিয়েটারের আত্মপ্রকাশ। এতদিন বাঙালি কেবলমাত্র যাত্রা, পাঁচালি গান, কথকতা, কবিগান দেখে ও শুনে আনন্দ উপভোগ করতো। ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে প্রসন্নকুমার ঠাকুরের নারকেলডাঙার বাগানবাড়িতে বঙ্গীয় রঙ্গালয় হিন্দু থিয়েটার স্থাপনের মধ্য দিয়ে শৌখিন রঙমঞ্চে নাট্যাভিনয়ের পথচলা শুরু। এরপর ১৮৭২-এ শুধু বাংলায় নয় সমগ্র ভারতে সর্বপ্রথম সাধারণ রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠিত হোল। এই সাধারণ রঙ্গালয়েই ঐবছরের ৭ ডিসেম্বর দীনবন্ধু মিত্রের `নীলদর্পণ' নাটক অভিনয়ের মধ্য দিয়ে বঙ্গভূমিতে প্রথম পেশাদারী থিয়েটারের শুভসূচনা।
কোলকাতার নাট্য অভিনয়ের সফল প্রয়াস বাংলার প্রান্তে-প্রান্তরে লোকমুখে প্রচারিত হতে থাকল। নাট্যাভিনয়ের প্রভাব এসে পড়ল মেদিনীপুরেও। মেদিনীপুরের কয়েকজন যুবক কোলকাতার পেশাদারী থিয়েটারের এই অভিনয় দেখে নাটকের প্রতি মোহমুগ্ধ হয়ে যায়। যুবক মনে নাটকের এই অভিনয় বিচিত্র বর্ণের হীরকদ্যুতির মতো ছড়িয়ে পড়লো। ইতিমধ্যে বাংলার মনীষী ডাক্তার নীলরতন সরকার একান্তই বেড়ানোর সূত্রে মেদিনীপুরে উপস্থিত হন। স্যার নীলরতনের সহায়তায় কলাইকুণ্ডা গড়ের রাজা শ্রী নারায়ণ পাল বা রাজাজী, ভুতপূর্ব অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট মালুঞ্চা গ্রামনিবাসী প্রিয়নাথ রায়, উকিল নবকুমার মিত্র এবং মেদিনীপুরের স্বনামধন্য ব্যাক্তিত্ব ক্ষীরোদবিহারী দত্ত প্রমুখ কয়েকজন যুবক মিলে মেদিনীপুর শহরের বর্তমান বল্লভপুরে প্রিয়বাবুর বাড়িতে একটি অস্থায়ী দল গঠন করেন। শুরু হোল মেদিনীপুরে নাটকের চর্চা। প্রিয়বাবুর বাড়িতে চললো দুটি নাটকের মহড়া। অবশেষে ১২৮২ বঙ্গাব্দের (১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দ) রথের দিন রাতে মালুঞ্চায় (বর্তমান খড়গপুরের মালঞ্চ) প্রিয়নাথ রায়ের বাড়িতে `রামবনবাস' এবং পরেরদিন `মেঘনাদবধ' নাটক দুটি অভিনীত হোল। নাট্য গবেষক চারুচন্দ্র সেন-এর বক্তব্য অনুসারে `এই অভিনয়ই মেদিনীপুরের সর্বপ্রথম নাট্যাভিনয়।'
মেদিনীপুর শহরে ক্ষীরোদবিহারী দত্ত, অভয়চরণ নন্দী, রাখালচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রসন্নকুমার দত্ত, বৈকুণ্ঠনাথ দেব, রামরূপ চট্টোপাধ্যায়, চৌধুরী যজ্ঞেশ্বর মল্লিক, চৌধুরী যোগেন্দ্রনাথ মল্লিক এবং সর্বাগ্রে গোপালবাবু প্রমুখগণের উৎসাহে একটি নাট্য সম্প্রদায়ের জন্ম নিল। এই নাট্যগোষ্ঠীর উদ্যোগে বাংলার ১২৮৪, ইংরেজির ১৮৭৭-এ বর্তমান মেদিনীপুর শহরের চিড়িমারসাই-এর রামগোবিন্দ নন্দীর বাড়ির দোতলার হলঘরে দুটি নাটক ও একটি প্রহসন অভিনীত হয়। অভিনীত হয়েছিল `হরিশচন্দ্র' ও `রামাভিষেক' এই দুটি নাটক এবং `চক্ষুদান' নামে একটি প্রহসন। পরপর দু'রাত্রি নাটকের এই অভিনয় শহরের মানুষের মধ্যে সাড়া ফেলে দেয়। উল্লেখ্য এই দুটি নাটক ও প্রহসনই মেদিনীপুরের প্রথম রঙ্গাভিনয়।
দু'রাত্রি এই নাট্যাভিনয়ের পর শহরের মানুষের কাছে নাটক দেখার চাহিদা বেডে় যায়। অসংখ্য মানুষের নাট্যপ্রীতি ও নাট্যানুরাগকে উৎসাহ দিতে নতুন জন্ম নেওয়া নাট্য সম্প্রদায় নিয়মিত নাটকের মহড়া দিতে শুরু করে। ১৮৭৮ সালের গ্রীষ্মে মল্লিকবাড়ির নাটমন্দিরের আটচালায় `রামাভিষেক' ও `প্রভাবতী' নাটক দুটি অভিনীত হয়। মেদিনীপুরের নাট্যচর্চার ইতিহাসে এই দুটি নাটকের অভিনয় ছিল বিশেষভাবে স্মরণীয়। একদিকে এই অভিনয়ে প্রথম ফুটলাইটের (Foot Light) ব্যবহার এবং অন্যদিকে গোপালবাবুর ক্ল্যারিয়নেট-এর সুর দর্শকদের মুগ্ধ করেছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় অতি অল্পকালের মধ্যেই এই সম্প্রদায় ভেঙে যায়।
নাট্য সম্প্রদায়ের এই ভাঙনেও গোপালবাবু হার মানেন নি। গোপালবাবু জানতেন গোষ্ঠীর দীর্ঘস্থায়িত্ব নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। তাই গোষ্ঠীর ভাঙনের কথা মাথায় না রেখে তিনি নতুন করে আর একটি নাট্যদল গঠনের কথা ভাবতে শুরু করেন। মেদিনীপুর শহরেই চিড়িমারসাইতে হেমচন্দ্র সরকারের অধ্যক্ষতায় একটি জিমন্যাস্টিক পার্টি ছিল। গোপালবাবু হেমচন্দ্র সরকারের কাছে নাট্যদল গঠনের প্রস্তাব নিয়ে যান। তাঁর এই প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে হেমচন্দ্র সরকার ও আরো বেশ কয়েকজন নাট্যপ্রেমীদের সহযোগিতায় গোপালবাবু পুনরায় একটি দল গঠন করেন।
midnapore.in