মেদিনীপুর: নাটকের ইতিবৃত্ত  | Medinipur: History of Drama

মেদিনীপুর: নাটকের ইতিবৃত্ত | Medinipur: History of Drama

কমলেশ নন্দ।

১২৮৮ বঙ্গাব্দে (১৮৮১ খ্রিস্টাব্দ) রাসের সময় কলাইকুণ্ডাগড়ে নাটক `হরিশচন্দ্র' এবং `গুলিখোরের বিয়ে' নামে একটি প্রহসন অভিনীত হয়। দল গঠিত হচ্ছে, আবার নানা কারণে দল ভেঙেও যাচ্ছে এ নিয়ে গোপালবাবুর চিন্তার শেষ ছিল না। তিনি চাইছিলেন মেদিনীপুরে একটি স্থায়ী নাট্যদল গঠিত হোক। হেমচন্দ্রবাবু ও আরো কয়েকজন উৎসাহী যুবকদের নিয়ে যে নাট্যদল গঠিত হয়েছিল এবং তাদের উদ্যোগে একটি নাটক ও প্রহসন অভিনীত হওয়ার পর গোপালবাবু বুঝলেন এই দল নিয়েই গঠন করা যেতে পারে একটি স্থায়ী নাট্য সম্প্রদায়।

একটি নাটকের দৃশ্য (মিডনাপুর ডট ইন কর্তৃক সংগৃহীত)।
একটি নাটকের দৃশ্য (মিডনাপুর ডট ইন কর্তৃক সংগৃহীত)।

১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে হেমচন্দ্রবাবু সহ গোপালবাবুর উদ্যোগে যে নাট্যদলের জন্ম হয়েছিল তাদের সবাইকে নিয়ে কলাইকুণ্ডাগড়ে সম্প্রদায় `হিন্দু থিয়েটার' নাম নিয়ে `সীতাহরণ' নাটকটি অভিনয় করেন। এই `হিন্দু থিয়েটার'ই মেদিনীপুরের আদি রঙ্গালয়। `হিন্দু থিয়েটারে'র উদ্যোগে আরো বেশ কয়েকটি নাটক অভিনীত হল। গ্রাম-গ্রামান্তরে হিন্দু থিয়েটারের কথা ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময়ও লাগলো না।

গোপালবাবুর ইচ্ছানুসারে স্থায়ী নাট্যদল গঠন হোল ঠিক; কিন্তু তাতেও গোপালবাবুর মন ভরল না। তিনি বুঝেছিলেন নাট্য-অভিনয়কে যদি আরো রসপূর্ণ করে তুলতে হয় তাহলে স্ত্রী-চরিত্রের ভূমিকায় অভিনেত্রীর প্রয়োজন। হিন্দু থিয়েটারের সদস্যবর্গের কাছে গোপালবাবু প্রস্তাব দিলেন স্ত্রী-চরিত্রের ভূমিকার জন্য আমরা বারবণিতা বা বারাঙ্গনাদের দলে আনার ব্যবস্থা করতে পারি। কিন্তু দলের বেশকিছু সদস্য এবং ভদ্রসমাজের মধ্যে বারবণিতাদের দলে আনার কথা নিয়ে তুলকালাম ঘটে যায়। তাঁদের মত দলে পুরুষচরিত্রই মহিলা চরিত্রের ভূমিকায় অভিনয় করবে, সেখানে বারাঙনা আনবার দরকার কী ! তাছাড়া বারবণিতাদের দলে নেওয়া হলে মান-সম্মান নষ্ট হবে। গোপালবাবু তাঁর সিদ্ধান্তে অবিচল থাকলেন। আর তার ফল হোল দল থেকে বেশকিছু সদস্যের চলে যাওয়া।

দলের কিছু সদস্যের এই শুচিবাইকে উপেক্ষা করে গোপালবাবু, শরৎচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়, উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, সতীশচন্দ্র মিত্র, মহেশচন্দ্র মল্লিক প্রমুখের উদ্যোগে হিন্দু থিয়েটারে মহিলা চরিত্রের অভিনয়ের জন্য বারাঙ্গনাদের আনবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হোল। শ্রীমতী মাখনবালা, কুলবালা, প্রমোদসুন্দরী, মহমোহিনী, অম্বিকা সুন্দরী প্রমুখ অনেক অভিনেত্রীকে নিয়ে নাটকের মহড়া শুরু হয়। হিন্দু থিয়েটারে মহিলা অভিনেত্রীদের নিয়ে শুরু হোল আর এক নতুন অধ্যায়।

মহিলা অভিনেত্রীদের নিয়ে বেশ কয়েকমাস মহড়া চলবার পর নাটক মঞ্চস্থ করার উদ্যোগও নেওয়া হোল। কিন্তু তা নিয়ে দলে ও ভদ্রসমাজে নানান সমস্যার সম্মুখীন হতে হোল হিন্দু থিয়েটারকে। অবশেষে দীর্ঘ আলোচনার পর নাটক মঞ্চস্থ করার দিন স্থির করা হোল। কিন্তু সমস্যা হোল কোথায় হবে এই অভিনয়। অবশেষে বর্তমান মেদিনীপুরের কর্ণেলগোলায় গঙ্গারাম দত্তের বাড়িতে হিন্দু থিয়েটার অভিনয়ের দিন স্থির করলেন। একই সঙ্গে হিন্দু থিয়েটার আর একটি সিদ্ধান্তও গ্রহণ করলো, এই অভিনয় দেখার জন্য দর্শকদের টিকিট সংগ্রহ করতে হবে। অবশেষে ১৮৮৫ তে টিকিট বিক্রি করে গঙ্গারামবাবুর বাড়িতে একরাত্রি `শ্রীবৎসচিন্তা' এবং একরাত্রি `সীতাহরণ' ও `সুরুচির ধ্বজা' প্রসহন অভিনীত হয়। উল্লেখ মেদিনীপুরে পেশাদারী থিয়েটারের এটাই প্রথম অভিনয় রজনী।

হিন্দু থিয়টারের কথা শুধু শহরে নয় মেদিনীপুরের গ্রামগুলিতেও ছড়িয়ে পড়লো। গৌরবের সঙ্গে একের পর এক মঞ্চসফল অভিনয় তাঁরা করতে লাগলেন। ভদ্রসমাজের কাছে নানান সম্মানেও ভূষিত হলেন তাঁরা। কিন্তু এই সম্মান-গৌরবের মাঝে আর এক সমস্যার সম্মুখীন হতে হোল তাঁদের। এবার দলের মধ্যে নয় বাইরের থেকে আক্রমন এলো তাঁদের বিরুদ্ধে।

১৮৮৭ তে মেদিনীপুর শহরের বড়বাজারের বাসন্তীতলা গলির মধ্যে দত্তবাবুর বাড়ির প্রাঙ্গনে অভিনয় হচ্ছিল। সেখানে দর্শকদের মধ্যে ছিলেন স্থানীয় ও বাইরের বেশ কিছু লোক। অভিনয় চলা কালে স্থানীয় বড়বাজারের কিছু লোকের সঙ্গে হিন্দু থিয়েটারের কর্তৃপক্ষের এক-দুজনের সঙ্গে গোলযোগ দেখা দেয়। এই গোলমালের ফলস্বরূপ মেদিনীপুরে জন্ম নেয় আর একটি নাট্যদল। নববগঠিত নাট্যসংস্থার নাম হোল `নিউবেঙ্গল থিয়েটার' (১৮৮৭)। নবগঠিত নাট্যদল নিউবেঙ্গল থিয়েটারের উৎসাহ ও উদ্দীপনায় অভিনীত হোল দুটি নাটক— `নরমেধ যজ্ঞ' ও লক্ষ্মণ বর্জন'।

একদিকে বহু সম্মানিত হিন্দু থিয়েটার এবং অন্যদিকে নবগঠিত নিউবেঙ্গল থিয়েটার— শহরে দুটি নাট্যদল নাট্যমোদী দর্শকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। হিন্দু থিয়েটার এবং নিউবেঙ্গল থিয়েটার দুটি দলই তখন অভিনেত্রীদের নিয়ে বিভিন্ন স্থানে অভিনয় করে চলে। আর অভিনেত্রী সম্মিলিত এই অভিনয় দেখে শহরে অনেক শিক্ষিত পদস্থ ব্যক্তিরা তাঁদের পাশে এসে দাঁড়ান। শিক্ষিত ভদ্র সমাজের সহযোগিতায় দুটি নাট্যদলের এই ক্রমোন্নতি যখন চরম পর্যায়ে তখন শহরে বিরুদ্ধ দল হিসেবে আর একটি নাট্যসংস্থার জন্ম হয়। জন্ম নিল এ্যামেচার থিয়েটার।

চিড়িমারসাই-এর অধিবাসী নীলমণি ধর ছিলন দক্ষ উকিল। তিনি অত্যন্ত গোঁড়া এবং রুচিবাগীশ ব্যক্তি। নীলমণিবাবু অভিনেত্রী সম্মিলিত থিয়েটারের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তাঁর কাছে হিন্দু থিয়েটার এবং নিউবেঙ্গল থিয়েটারে অভিনেত্রী সমাবেশ ছিল অত্যন্ত গর্হিত বিষয়। তাই যুব সম্প্রদায়কে সঠিক পথে পরিচালনা করার এবং সুস্থ সংস্কৃতির লক্ষে Literary Club and Literary Entertainment নামে একটি ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে এই ক্লাবের উদ্যোগে `পলাশীর যুদ্ধ' নাটকটি অভিনীত হয়। পরে ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে ক্লাবের নাম পরিবর্তিত হয়ে `ডায়মণ্ড এ্যামেচার থিয়েটার' নাম গ্রহণ করে। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত এই দল গৌরবের সঙ্গে নাটক অভিনয় করে যান।

ডায়মণ্ড এ্যামেচার থিয়েটারের অভিনয় দেখে সারা শহর তখন মুগ্ধ। সাফল্যের সঙ্গে অভিনেত্রী বর্জিত নাটক তাঁরা করে যাচ্ছিলেন। তাঁদের এই অভিনয় দেখে কিছু নাট্যমোদী ও নাট্যরসিক ব্যক্তির মধ্যে আর একটি দল গঠনের উদ্যোগ দেখা যায়। নতুন এই নাট্যদলের নাম হোল `বান্ধব নাট্য সমাজ'। এঁদের উৎসাহ ও উদ্দীপনায় ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে দীপাবলীর রাতে রুদ্রনারায়ণ রায়ের বাড়িতে `মেঘনাদবধ' ও পরের দিন `পূর্ণচন্দ্র' নাটক দুটি অভিনীত হয়।

শহরে তখন মোট চারটি দল। একদিকে হিন্দু থিয়েটার ও নিউবেঙল থিয়েটার পেশাদারী থিয়েটার হিসাবে কাজ করে চলেছে এবং অন্যদিকে ডায়মণ্ড এ্যামেচার থিয়েটার ও বান্ধব নাট্য সমাজ এ্যামেচার গোষ্ঠীর ভূমিকা পালন করে চলেছে। হিন্দু থিয়েটারের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে যেমন নিউ বেঙল থিয়েটারের জন্ম হয়েছিল; ঠিক তেমনি ডায়মণ্ড এ্যামেচার থিয়েটােরর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল বান্ধব নাট্য সমাজ। এদের পরস্পরের এই প্রতিদ্বন্দ্বী মনোভাবের ফল হিসাবে পাওয়া গেল নতুন নতুন নাটকের মঞ্চসফল অভিনয়।

একটি নাটকের দৃশ্য (মিডনাপুর ডট ইন কর্তৃক সংগৃহীত)।
অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলায় অনুষ্ঠিত একটি নাটকের দৃশ্য (ছবির সৌজন্যে: সন্তু জানা।)

মেদিনীপুরে এই চারটি দল যেভাবে নাট্যমোদীদের মন ভরিয়ে তুলছিল তা আর বেশিদিন উপভোগ্যতার স্থানে থাকলো না। নাট্যদলগুলির উপর নেমে এলো একের পর এক আঘাত। সর্বপ্রথম সেই আঘাতের শিকার হোল নিউবেঙ্গল থিয়েটার। নিউবেঙ্গল থিয়েটার যে রঙ্গমঞ্চে তাদের অভিনয় করতো তা ছিল ফকিরচন্দ্র চাবড়ি মহাশয়ের অর্থে কেনা। তবে স্থানটি ফকিরবাবু কিনে দিলেও মঞ্চগৃহটি কিন্তু নির্মিত হয়েছিল নিউবেঙ্গল থিয়েটারের সদস্যগণের অর্থে। বিপত্তি ঘটলো ফকিরচন্দ্রবাবুর মৃত্যুতে। ফকিরবাবুর মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী নিউবেঙ্গল থিয়েটারের মঞ্চগৃহে চাবিতালা লাগিয়ে দিলেন। থিয়েটারের সেই চরম দুর্দিনেও সদস্যদের উদ্যোগে দু'একবার নাটক অভিনীত হলেও ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে পাকাপাকি ভাবে এই নাট্যগৃহ বন্ধ হয়ে যায়। নাট্যগৃহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরপরই দলের মধ্যেও ভাঙন দেখা দেয়। মেদিনীপুরে প্রতিষ্ঠিত পেশাদারী দল নিউবেঙ্গল থিয়েটার তাদের নাটক অভিনয়ে আর ফিরে আসেনি।

midnapore.in

(Published on 22.07.2020)