মেদিনীপুর: নাটকের ইতিবৃত্ত  | Medinipur: History of Drama

মেদিনীপুর: নাটকের ইতিবৃত্ত | Medinipur: History of Drama

কমলেশ নন্দ।

তমলুকের `আনন্দলোক নাট্য সংস্থা' মেদিনীপুরে নাট্য আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ১৯৭৫-এর ২৩ জুন এই নাট্যসংস্থার জন্ম। প্রতিষ্ঠাকালে ছিলেন রক্তকমল দাশগুপ্ত, ভবানী অধিকারী, তপন নন্দী, পঞ্চানন মাইতি প্রমুখ বিশিষ্ট নাট্যপ্রেমী ব্যক্তিবর্গ। আনন্দলোক অভিনীত প্রথম নাটক `বর্বরবাসী'। `উলগুলান' ও `রৃপোডাঙার সেই মানুষটি' নাটকদুটি প্রায় অর্ধ শতাধিক রাত্রি অভিনীত হয়েছে। এছাড়াও `একটি বাস্তব গল্প', `মৃতু্যহীন বেঞ্জামিন',`মারীচ সংবাদ' প্রভৃতি নাটকও আনন্দলোকের উল্লেখযোগ্য মঞ্চসফল নাটক।

একটি নাটকের দৃশ্য (মিডনাপুর ডট ইন কর্তৃক সংগৃহীত)।
অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলায় অনুষ্ঠিত একটি নাটকের দৃশ্য (ছবির সৌজন্যে: সন্তু জানা।)

১৯৭৩-এ পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতার আমলাগোড়ায় জন্ম নিয়েছিল `আশার আলো যুব নাট্য সমাজ'। সংস্থার সঙ্গে যুক্ত মলয় চক্তবর্তী, বসন্ত দে, উত্তম রায়, বাসুদেব রায় প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ। এলাকায় সুস্থ সংস্কৃতির প্রসারের লক্ষে বহু নাট্য প্রযোজনা করেছে এই নাট্যসংস্থা। সংস্থা অভিনীত কয়েকটি নাটক যেমন `কালা শের', `গোলাপে রক্ত', `নীড়হারা পাখি' উল্লেখের দাবি রাখে। অন্যদিকে এই গোষ্ঠী প্রযোজিত কয়েকটি একাঙ্ক নাটক `একটি অবাস্তব গল্প', `শটে শাঠ্যং', `ভোরাই খেয়া' প্রভৃতি জেলার বিভিন্ন স্থানে বহুবার অভিনীত হয়েছে।

অশোক প্রতিহার, সুভাষ চট্টোপাধ্যায়, সমীরণ ব্যাণার্জী প্রমুখের উদ্যোগে ১৯৬৯-এ গড়বেতায় ভারতীয় গণনাট্য সংঘের একটি শাখা হিসেবে `রঙ্গম' নাট্যগোষ্ঠীর জন্ম। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য রঙ্গম নাট্যসংস্থা প্রযোজিত `হাজার হাতের গল্প' নাটকটি প্রায় দেড় শতাধিক মঞ্চে অভিনীত হয়েছে। রঙ্গম নাট্যগোষ্ঠীর নাট্যপ্রয়াস এই অঞ্চলে আরো বেশ কয়েকটি নাট্যগোষ্ঠীর জন্ম দিয়েছে। গড়বেতার আর একটি নাট্যদল `আমরা নবীন'-এর প্রতিষ্ঠাকাল ১৯৭৬-এ। দেবাশিষ পলমল, মনোরঞ্জন পাল, বিজন মান্না, সত্য পাল প্রমুখের যৌথ উদ্যোগে আমরা নবীনের পথচলা শুরু। এই নাট্যগোষ্ঠী অভিনীত নাটকের মধ্যে `একধামা আলু', `চিকন সুতোর বাঁশি', `রথের রশি' প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। গড়বেতার `রঙ্গম' গণনাট্য সংস্থার আদর্শ গ্রহণ করে এই নাট্যগোষ্ঠী সামাজিক ব্যাধিগুলিকে মঞ্চে আনার প্রয়াসে বিশেষ উদ্যোগী।

একটি নাটকের দৃশ্য (মিডনাপুর ডট ইন কর্তৃক সংগৃহীত)।
একটি নাটকের দৃশ্য (মিডনাপুর ডট ইন কর্তৃক সংগৃহীত)।

১৯৭১ সাল বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যার্থে `জীবনান্ত' নাটক দিয়ে ঝাড়গ্রামের `বলাকা' সাংস্কৃতিক চক্রের পথচলা শুরু। এই সাংস্কৃতিক চক্র প্রায় শতাধিক নাটক খুব সাফল্যের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে অভিনয় করেছে। `কালিন্দী', `একটি অবাস্তব গল্প', `হ্যামলেট', `পদ্মানদীর মাঝি' ইত্যাদি নাটক বলাকার সফল প্রযোজনা। বলাকা প্রযোজিত `ওঝার ঘাডে় ভূত' নাটকটি প্রায় একশো রাত্রি অভিনয় সফলতা পেয়েছে। সংস্থার উদ্যোগে নির্মিত বলাকা মঞ্চ নামে একটি প্রেক্ষাগৃহও রয়েছে। চক্রের সঙ্গে যুক্ত প্রণব চক্রবর্তী, সাগর রায়, অভিজিৎ রায়, অঞ্জন মুখার্জী, সৌমেন্দুবিকাশ হোতা প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ।

মূলত শিশু নাটক অভিনয়ের মধ্য দিয়ে ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে ঝাড়গ্রামে `আনন্দন' নাট্যগোষ্ঠীর জন্ম। শুধু জেলা নয় রাজ্যে ও রাজ্যের বাইরেও আনন্দন বিভিন্ন সময়ে নাটক অভিনয় করেছে। সংস্থার উদ্যোগে বহুবার নাট্যমেলার আয়োজনও হয়েছে। উপল পাহাড়ী, শ্যাম বানার্জী, রথীন দাস, কুন্তল পাল, দেবলীনা পাল, মহুয়া ব্যানার্জী প্রমুখের উদ্যোগে সংস্থা প্রযোজিত নাটকের সংখ্যাও খুব একটা কম নয়। আনন্দন প্রযোজিত নাটকগুলির মধ্যে `রক্তকরবী', `নরক গুলজার' এবং একাঙ্ক নাটকের মধ্যে `কেন না মানুষ', `টাপুর টুপুর', `ব্যতিক্রম' বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে।

একটি নাটকের দৃশ্য (মিডনাপুর ডট ইন কর্তৃক সংগৃহীত)।
একটি নাটকের দৃশ্য (মিডনাপুর ডট ইন কর্তৃক সংগৃহীত)।

মেদিনীপুরে নাট্যচর্চার পূর্ণাঙ্গ আলোচনা একটি প্রবন্ধে অসম্ভব। এর জন্য একটি গ্রন্থের পরিসর দরকার। তাই জেলার আরো অনেক নাট্যসংস্থার কথা উল্লেখ করা গেল না। একসময় যে সমস্ত নাট্যদলগুলি সমগ্র জেলায় বিভিন্ন সময়ে নাটক অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে জেলার নাট্যপ্রেমীদের মনোরঞ্জন করেছেন আজ সেইসব নাট্যগোষ্ঠীর অনেকগুলিই সময়ের আঘাতে বন্ধ হয়ে গেছে। বিশ্বায়নের আলোয় নাট্যগোষ্ঠীগুলির নাট্যচর্চার কথা তরুণ সমাজের কাছে অজ্ঞাত হওয়ার কারণ যে কেবল উৎসাহ ও উদ্দীপনার অভাব তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এইসব নাট্যদলগুলির ভূমিকা সত্যিই অকল্পনীয়।

midnapore.in

(Published on 22.07.2020)