কমলেশ নন্দ।
মেদিনীপুর শহরকে কেন্দ্র করে যে নাট্যচর্চার সূত্রপাত তা যে কেবল শহরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়। সমগ্র মেদিনীপুর জেলায় নাট্যগোষ্ঠীগুলি নাট্যচর্চায় বিভিন্ন ভাবে নিজেদের নিয়োজিত করেছেন। অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার কয়েকটি নাট্যসংস্থার নাট্যচর্চার কথা না বললেই নয়। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে অরুণ মাইতি, কৃষ্ণপ্রসাদ দাস, নির্মলেন্দু মাইতি, বাসুদেব দাশগুপ্ত, রতন দাস প্রমুখের নাট্য-উদ্যোগে `রূপালী চাঁদ' নাটক দিয়ে `কৃষ্টি সংসদ'-এর পথচলা শুরু। পরবর্তীকালে কৃষ্টি সংসদ সত্তরের দশকের শেষে ভারতীয় গণনাট্য সংস্থার অন্তর্ভূক্ত হয় এবং একাধিক নাটক অভিনয়ের মধ্য দিয়ে সমগ্র জেলায় নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এই সংস্থার একজন একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন বাসুদেব দাশগুপ্ত। যদিও তিনি ছদ্মনাম শ্রীজীব গোস্বামী নামেই পরিচিত। বহু একাঙ্ক নাটক ও পূর্ণাঙ্গ নাটক তিনি রচনা করেছেন।
কৃষ্টি সংসদের সঙ্গে মতানৈক্যের কারণে মেদিনীপুরে `নিশান' নাট্যগোষ্ঠী জন্ম নেয়। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে সর্বমুক্তির কারণে ও নিজস্ব সত্তাকে প্রকাশের উদগ্রীবতায় ১৯৬৮-র ২৮ জানুয়ারি নিশান তার মঙ্গলঘট স্থাপন করে। দুলু মাইতি (নির্মলেন্দু), প্রশান্ত সান্যাল, গিরিধারী সেন, নির্মলেন্দু দত্ত প্রমুখের উৎসাহ-উদ্যোগে এই সংস্থার জন্ম। গ্রাম-গ্রামান্তরে বিভিন্ন বিষয়ে গণজাগরণের উদ্দেশ্য নিয়ে নিশান বহু নাটক মঞ্চস্থ করেছে। এই গোষ্ঠীর কয়েকটি মঞ্চসফল নাটকের মধ্যে `মারীচ সংবাদ' উল্লেখের দাবী রাখে। কেন না নাটকটি বাহান্ন বার মঞ্চস্থ হয়েছে। এর পাশাপাশি `কেন না মানুষ', `বিসর্জন', `গৃহদাহ' প্রভৃতি নাটকগুলিও এঁরা বহুবার অভিনয় করেছেন।
১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১ মে বর্তমান পশ্চিম মেদিনীপুরের মেদিনীপুর শহরের মীরবাজারে `ক্রান্তিক' নাট্যগোষ্ঠীর পথচলা শুরু। বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনের উৎস থেকেই ক্রান্তিকের জন্ম। পার্থ মুখোপাধ্যায়, প্রবীর দেবনাথ, জয়ন্ত চক্রবর্তী প্রমুখদের যৌথ উদ্যোগে এই গোষ্ঠী বহু নাটক অভিনয় করেছে। এই গোষ্ঠীর একটি সফল পথনাটক `মানুষ'। নাটকটি প্রথম অভিনীত হয় ১৯৯৩-এর ১ জানুয়ারিতে। এরপর প্রায় অর্ধ-শতাধিক বার এই নাটক অভিনীত হয়েছে। এছাড়াও বেশ কয়েকটি একাঙ্ক নাটক ও পথ নাটক এঁরা জেলার বহু স্থানে বহুবার অভিনয় করেছেন।
মেদিনীপুর শহরের আর একটি নাট্যসংস্থা `উদয়ন'। ২৩ মে ১৯৮৫-তে এই সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। সংস্থা প্রতিষ্ঠার সময় ছিলেন নরেন্দ্রনাথ মল্লিক, শ্যামলেন্দু ঘোষ, গৌতম চক্রবর্তী, সুরজিৎ সেন প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ। এঁদের কয়েকটি মঞ্চসফল নাটকের মধ্যে একাঙ্কিকা `পাগল', `অনুবর্তন', `দুইমেরু'; পূর্ণাঙ্গ নাটক `কেনারাম বেচারাম', `গুলশন' এবং পথ নাটক `মড়া' `অভিযান' ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
রেল শহর খড়গপুরে নাট্যচর্চার ইতিহাস বেশ পুরোনো। ১৯৩৯-৪০ সালে সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরী, বিমল দত্ত, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, রঘুনাথ ঘোষ ও প্রণব শর্মা-র উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল `গোপালের হাট' নামে একটি সংস্থা। অন্যদিকে ঐএকই সালে শিক্ষাবিদ মহাদেব রায় ও খড়গপুরের দুর্গামন্দিরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে একটি আলোচনা চক্র। `বাল্মীকি প্রতিভা', `শ্রীমতী' প্রভৃতি নৃত্যনাট্য এঁদের প্রযোজনায় অনুষ্ঠিত হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এঁরাই প্রথম খড়গপুরে স্ত্রী ভূমিকায় মেয়েদের দিয়ে অভিনয় করান। তার জন্য অবশ্য বহু সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। এই দুটি সংস্থা ছাড়াও ১৯৪০-এ গড়ে ওঠা `ইউনাইটেড এ্যামেচার আর্টিস্ট', ১৯৪৪ সালে গঠিত `মিলন মন্দির', `সান্ধ্য সম্মিলনী' `দক্ষিণী সমাবেশ' প্রভৃতি নাট্যগোষ্ঠী খড়গপুরে নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
গত শতকের চল্লিশের দশকের শেষের দিকে খড়গপুরের ডেভেলপমেন্ট -এর রেলওয়ে কলোনিতে কয়েকজন নাট্যপ্রেমীকে নিয়ে অনিল গাঙ্গুলির নেতৃত্বে শুরু হয় `উদয় সংঘ'-এর নাট্যচর্চা। অতুল চট্টোপাধ্যায়, টি.পি. সরকার, টি.পি. ভট্টাচার্য প্রমুখ নাট্যরসিক এই গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পঞ্চাশের দশকে উদয় সংঘের বেশ কিছু মঞ্চসফল প্রযোজনার মধ্যে `সাজাহান', `টিপু সুলতান' প্রভৃতি খুবই উল্লেখযোগ্য। সত্তরের দশকে এই সংঘের নাট্যচর্চায় সাময়িক ছেদ পড়লেও আটের দশকে পুনরায় নাট্যচর্চায় গতি আসে। এই সংঘের উদ্যোগেই জেলায় প্রথম সারা বাংলা একাঙ্ক নাটক প্রতিযোগিতা শুরু হয়। বিভিন্ন সময়ে উদয় সংঘের নাট্যচর্চায় প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হলেও সংঘের উৎসাহীগণ পুনরায় নাট্যোদ্যোগে সক্রিয় হন।
গত শতকের পাঁচের দশকের শেষের দিকে বহিরাগত কয়েকজন নাট্যানুরাগী রেলকর্মচারীর উদ্যোগে খড়গপুর শহরে গড়ে উঠেছিল `মশাল' নাট্যগোষ্ঠী। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে এই নাট্যসংস্থার আত্মপ্রকাশ। আলকাপের মতো মশালও সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে বহু নাটক অভিনয় করেছে। আসলে নতুন নাটক, নতুন আঙ্গিক ও বিশেষ কিছু চিন্তাভাবনার দিক থেকে মশাল নাট্যগোষ্ঠী শুধু খড়গপুরে নয় সারা বাংলার নাট্যরসিকগণের কাছে বিশেষ সম্মান অর্জন করে। এই সংস্থার কয়েকটি মঞ্চসফল নাটক বহু পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য `ন্যাশানাল পার্ক', `ওরা দুইজন', `রক্তের রঙ', `বাণিজ্যে বসতি' প্রভৃতি নাটক। আলকাপ নাট্যগোষ্ঠীর অরুণ মাইতি, বিভূতি ভট্টাচার্য, আনন্দময় ঘোষাল,রমাপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়,সুলেখা গুপ্ত, অসিত সিংহ রায় প্রমুখ অভিনেতা-অভিনেত্রীর অভিনয় সারা বাংলায় সাড়া ফেলেছিল।
১৯৭৭ সালের জানুয়ারিতে বর্তমান পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদলে `সমকাল' নাট্যগোষ্ঠীর জন্ম। সুখেন্দু বেরা, আলোক সান্যাল, প্রভাত বেরা, অমর ভট্টাচার্য, দেবাশিষ সরকার প্রমুখগণের নাট্যোদ্যোগে সমকালের পথচলা শুরু। এই গোষ্ঠী অভিনীত `চুক্ শক্তি বলছি', `কাল বিহঙ্গ', `ক্রীতদাস' প্রভৃতি নাটক বহু মঞ্চ সফলতা পেয়েছে। নাটকের মধ্য দিয়ে বহুজনের সর্বাত্মক কল্যাণ সাধন এঁদের মূল লক্ষ। মহিষাদলের কাছাকাছি শিল্পশহর হলদিয়ার `প্রতিধ্বনি' নাট্যসংস্থার জন্ম ১৯৯২-এর মার্চে। প্রতিধ্বনি প্রতিষ্ঠার সময় ছিলেন সুধাংশুশেখর দাস, সুকেশচন্দ্র পাত্র, দেবাশিষ সিংহ রায়, দীপ্তি পট্টনায়েক প্রমুখ। এঁদের অভিনীত কয়েকটি নাটকের মধ্যে `রোগ নির্ণয়', `উৎসেচক', `উজান তরীর যাত্রী' প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
midnapore.in