রাকেশ সিংহ দেব।
মেদিনীপুর টাউনের ধর্মা এলাকায় একজনের বাড়িতে সাপ উদ্ধার করতে গিয়ে সাপসহ কিছু সাপের ডিম খুঁজে পান মেদিনীপুরের অনুজপ্রতিম সর্পবন্ধু দেবরাজ চক্রবর্তী। প্রথমে তিনি অন্ধকারে বাড়ির অব্যবহৃত ইঁট কাঠের স্তূপ থেকে দ্রুত সাপটিকে উদ্ধারের সময় সেটিকে গোখরো ভেবে বসেন। পরে রিলিজের সময় দেখা যায় সেটি কেউটে ছিল। কিন্তু বৃষ্টির জল লেগে আর পিঁপড়ের আক্রমণে অধিকাংশ ডিম ফুটো হয়ে তার ভেতরের তরল বেরিয়ে এসেছিল। কিছু ডিম ভালো অবস্থায় উদ্ধার করা গেলেও পরবর্তী সময়ে Fungal Infection এর কারণে ডিমগুলো নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। মানুষের বসতির এত কাছে ডিমসহ কেউটের অবস্থান আমাদের কাছে একটা অন্যরকম অভিজ্ঞতা ছিল।
কেউটে শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ ‘কালকূট’ থেকে, যার অর্থ তীব্র মারণ বিষ। কেউটে সাপের ইংরেজি নাম –Monocled Cobra, Monocellate Cobra বৈজ্ঞানিক নাম – Naja kaouthia (Lesson, 1831)। পশ্চিমবঙ্গে কেউটে সাপ বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন নামে পরিচিত – আল কেউটে, কাল কেউটে, পদ্ম খরিস, কালো খরিস, শামুকভাঙা, গেঁড়িভাঙা, তঁপ ইত্যাদি। ভারতের অন্যতম বিষধর এই সদস্যের হরিয়ানা থেকে গাঙ্গেয় উপকূলবর্তী এলাকা (পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা) হয়ে উত্তর পূর্বের আসাম, সিকিম, অরুণাচল প্রদেশ পর্যন্ত (৩২০০ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত) অবাধ বিচরণ। এলাপিডি (Elapidae) গোষ্ঠীর অন্যতম সদস্য কেউটে তার সুদৃশ্য ‘ফণা’-র জন্য পরিচিত। এদের চওড়া মাথায় ঘাড়ের কাছে যে হাড় থাকে প্রয়োজনে তা সম্প্রসারণ এর মাধ্যমে এরা ফণা মেলে ধরে। কেউটের ফণা গোখরো থেকে ছোটো এবং আকারে গোল। ফণার পিছনে ইংরেজি ‘O’ বর্ণের মতো বা চোখের মতো কালো গোলাকার একটি চিহ্ন আছে, চিহ্নটির বাইরের দিকে হালকা হলুদ বা কমলা রঙের গোলাকার দাগ বর্তমান। কোন কোন ক্ষেত্রে চিহ্নটি কালচে বাদামীও হতে পারে!
ফণার নিচে সামনের দিকে কালো ও পিছনের দিকে হলুদাভ সাদা রঙের চওড়া দাগ দেখতে পাওয়া যায়, এই লক্ষণটি দেখেও গোখরো থেকে কেউটে সাপকে পৃথক করা সম্ভব। এর নিচে পেটের দিকে কালো রঙের আরো একটি বা দুটি চওড়া ব্যান্ড এর মতো দাগ লক্ষ্য করা যায়। পেটের দিকের রঙ পিঠের তুলনায় হালকা। অপ্রাপ্তবয়স্কদের রঙ কালো থাকে কিন্তু বয়সের সঙ্গে সঙ্গে এই রঙ পরিবর্তিত হয়ে জলপাই, কালচে হলুদ বা বাদামী হয়ে যায়। পশ্চিমবঙ্গ এবং গাঙ্গেয় উপকূলবর্তী এলাকায় ফণার কিছুটা দূর থেকে লেজের শেষপ্রান্ত পর্যন্ত হলুদ-কালো ডোরাকাটা দাগ দেখা যায়। কেউটের বিষদাঁত কুলকাঁটার মতো ভেতরের দিকে বাঁকানো। কোন কোন কেউটের বিষদাঁত বিষ ছেটানোর জন্য অভিযোজিত। এরকম এক কেউটের বিষ ছেটানোর ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেন খড়্গপুরের অগ্রজ সর্পবন্ধু কৌস্তভ চক্রবর্তী।
কেউটে মূলত নিশাচর, তবে সন্ধ্যা এবং ভোরের সময়ে বেশী সক্রিয় থাকে। এরা খুব দ্রুত এবং সজাগ সাপ। বিপদ অনুভূত হলে বা ভয় পেলে কেউটে তার স্বরূপ প্রকাশ করে, ফণা ফুলিয়ে জোরে হিস্হিস্ শব্দ করে সামনের দিকে বার বার সজোরে ছোবল মারে। প্রয়োজনে সামনের শরীর খাড়া করে দেহের এক তৃতীয়াংশ দাঁড় করিয়ে দিতে পারে। খুব প্রয়োজন না পড়লে মানুষকে কামড়ায় না। দেখা গেছে এদের কামড়ের প্রায় ৫০-৬০ শতাংশ শুকনো কামড় (Dry Bite)। এরফলে এরা অনেক মানুষকেই কামড়ায় কিন্তু তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক মানুষেরই মৃত্যু ঘটে। এদের প্রধান খাবার মাছ এবং শামুকের মতো জলজ প্রাণী হওয়ার কারণে স্বাভাবিকভাবেই কেউটে দক্ষ সাঁতারু। হামেশাই সাঁতরে পুকুর পার করতে দেখা যায়। জমির আলে ইঁদুরের সন্ধানে ঘুরতে দেখা যায়, তাই এদের ‘আল কেউটে’ বলা হয়। বাচ্চা কেউটে সাপেরা প্রধানত ছোট ব্যাঙ খেয়ে জীবনধারণ করে। পূর্ণবয়স্ক কেউটেরা ইঁদুর, ব্যাঙ, সাপ, শামুক, মাছ শিকার করে। এরা বছরে একাধিকবার নিজেদের পুরোনো খোলস পরিবর্তণ করে।
কেউটে ওভিপেরাস, অর্থাৎ এরা ডিম পাড়ে। জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসের মধ্যে ইঁদুরের গর্তে, মাটির গর্তে, পাথরের খাঁজে বা গাছের কোটরে একসাথে ১০ থেকে ২০টা ডিম পাড়ে। বর্তমানে বিভিন্ন জায়গায় জনবসতিপূর্ণ এলাকায় বাড়ির মধ্যে এদের ডিম দিতে দেখা যাচ্ছে। প্রায় ৬০ দিনের ইনকিউবিশন পিরিয়ডের পরে ডিম ফুটে বাচ্চা বেরোয়। বাচ্চা না বেরোনো পর্যন্ত মা কেউটে ডিম পাহারা দেয় ও ডিমে তা দেয়। ডিম ফোটা পর্যন্ত এরা ডিমের সাথে থাকে। এসময় এরা খুব সজাগ থাকে। ডিমের নিরাপত্তার জন্য আক্রমনাত্মক হয়ে পড়ে। বাচ্চাগুলো লম্বায় ২০-৩০ সেমি আকারের হয়। জন্মের পর থেকেই তাদের বিষগ্রন্থি কার্যকরী হয়ে পড়ে এবং শিকার ধরতে সক্ষম হয়।
কেউটের কামড়ের জায়গায় জ্বালা যন্ত্রনা হবে। ক্ষতস্থান চুঁইয়ে রক্তরস বের হয়। ধীরে ধীরে যন্ত্রনা বাড়বে এবং শরীরের অন্য অংশে ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু নিউরোটক্সিন বিষের ক্রিয়াশীলতার কারণে পরবর্তীতে জ্বালা যন্ত্রনা কমতে থাকবে। কারণ স্নায়ুবিষের প্রভাবে স্নায়বিক শিথীলতা দেখা দেবে। কামড়ের জায়গা ধীরে ধীরে ফুলতে পারে। বমি অথবা বমি বমি ভাব হবে। মুখ থেকে লালা বা গ্যাঁজলা নিঃসরণের ফলে অসুস্থ অবস্থায় শুয়ে থাকা রোগীর শ্বাসনালী বন্ধ হয়ে যেতে পারে। গলায় ব্যাথা হবে, ফলে ঢোক গিলতে কষ্ট হবে। ধীরে ধীরে চোখের পাতা পড়ে আসবে (শিবনেত্র)। তীব্র শ্বাসকষ্ট শুরু হবে, ধীরে ধীরে রোগী অজ্ঞান হয়ে যাবে। ‘কার্ডিওটক্সিন’ এর প্রভাবে হৃৎপিণ্ডের স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হতে থাকবে। হৃদ্পেশী শিথিল হয়ে আসবে। রোগীর প্যারালাইসিস হতে পারে।
গোখরোর মতোই কেউটের বিষ প্রকৃতিতে ‘নিউরোটক্সিন’ এবং ‘কার্ডিওটক্সিন’। স্নায়ুর উপর গোখরোর বিষ ক্রিয়াশীল হয় বলে পেশীর কার্যকলাপ বন্ধ হয়ে যায়, পরবর্তীতে শ্বাসকষ্ট এবং হৃদযন্ত্র এর ক্রিয়াকলাপ বন্ধ হয়ে যায়। কেউটে সাপের বিষে Citotoxin বা কোষতান্ত্রিক বিষও থাকে, যা কোষকে নষ্ট করে দেয় ফলে ক্ষত অঙ্গে শুষ্ক পচন হতে পারে। দংশনের পরে সঠিক চিকিৎসা শুরু না হলে সাপ কামড়ের ৪ থেকে ৬ ঘন্টার মধ্যে রোগী মৃত্যু হতে পারে। কেউটের বিষের মারণ ক্ষমতা ০.২৮ মিলিগ্রাম/কেজি [*Ernest and Zug]। অর্থাৎ একটি ৬০ কেজি ওজনের পূর্ণবয়স্ক মানুষকে মেরে ফেলার জন্য মাত্র ১৫ থেকে ১৬ মিলিগ্রাম বিষ যথেষ্ট। কেউটের বিষ বেদনানাশক ওষুধ তৈরীতে ব্যবহার করা হয় ক্যান্সার এর ওষুধ তৈরীতে বিষ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে। কেউটের ফণার পেছনের বিশেষ চিহ্নটির জন্য ব্যাগ, জ্যাকেট প্রস্তুতির জন্য নির্বিচারে কেউটে সাপ মারা পড়ছে, যা অত্যন্ত হতাশাব্যাঞ্জক।
আমরা প্রায় প্রত্যেকেই কল্প কাহিনীতে শুনে এসেছি সাপের মাথায় মনি হয়। কোনোভাবে তা পাওয়া সম্ভব হলে অফুরাণ ধনসম্পত্তির মালিক হওয়া যায়। এই ভুল ধারণাট বহুকাল থেকে চলে আসছে। তার উপর টেলিভিশন চ্যানেলগুলো এবিষয়ে টেলিসোপের নামে নানা উদ্ভট গল্প দেখিয়ে মানুষকে দিনের পর দিন বিভ্রান্ত করে চলেছে। এমনকি বেদে ও সাপুড়িয়ার দল সাপ খেলা দেখাবার সময় সাপের মনি বলে ছোট মুক্ত বা চকচকে পাথর বিক্রি করে লোকেদের বোকা বানিয়ে আসছে। কেউটে সাপের মাথায় ফনার ওপর আঠা দিয়ে এগুলোকে আটকে 'সাপের মনি' বলে ক্রেতাদের কাছে চড়া দামে বিক্রি করে আসছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাপ এর মাথার দিক চিরে সেখানে লাল, হলুদ পাথর আগে থেকে রেখে পরে দর্শকের সামনে সেই পাথর বের করে বহুমূল্য দিয়ে তা বিক্রি করা হয়। যদিও এর ফলে সাপ টি অসুস্থ হয়ে মারা পর্যন্ত যেতে পারে। আসলে সাপের মাথায় মনি বা এ জাতীয় পাথুরে জিনিস কখনো তৈরী হয় না। একটু বাস্তববোধ নিয়ে ভাবলেই বোঝা যায়, সত্যিই সাপের মনি বলে কিছু থেকে থাকলে সাপুড়েরা নিজের কাছে না রেখে তা বিক্রি করে দিচ্ছে কেন?
ওঁ দেবীমম্বামহীনাং শশধরবদনাং চারুকান্তিং বদন্যাম্।
হংসারূঢ়মুদারামসুললিতবসনাং সর্বদাং সর্বদৈব ।।
স্মেরাস্যাং মণ্ডিতাঙ্গীংকনকমণিগণৈর্মুক্তয়া চ ।
প্রবালৈর্বন্দেহ হংসাষ্টনাগামুরুকুচগলাংভোগিনীং কামরূপাম্ ।।
(এর ভাবার্থ - সর্পদিগের মাতা, চন্দ্র বদনা, সুন্দর কান্তি বিশিষ্টা, বদন্যা, হংস বাহিনী, উদার স্বভাবা, লোহিত বসনা, সর্বদা সর্বঅভিষ্ট প্রদায়িনী, সহাস্য বদনা, কণক মনি মুক্তা প্রবালাদির অলঙ্কার ধারিনী, অষ্ট নাগ পরিবৃতা, উন্নত কুচ যুগল সম্পন্না , সর্পিণী, ইচ্ছা মাত্র রূপ ধারিনী দেবীকে বন্দনা করি।)
নদীমাতৃক বঙ্গভূমিতে সর্পদেবী মনসার পূজা সর্বাধিক জনপ্রিয়। অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলা এর ব্যতিক্রম নয়। মেদিনীপুর অঞ্চলে বেশীরভাগ জায়গায় মনসার দেবীর মূর্তির পরিবর্তে মনসা গাছের ডাল বা মনসা ঘটে পূজা হয়। তবে অনেক জায়গায় মনসার মূর্তিও পূজিত হয়। এই মূর্তি ভালোভাবে লক্ষ করলে দেখা যাবে চতুর্ভূজা দেবীর পদতল আলো করে রয়েছে ফণাধর কেউটে। প্রধানত সর্পদংশনের হাত থেকে রক্ষা পেতে দেবী মনসার পূজা করা হয়। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার জকপুরের বিখ্যাত শ্রী শ্রী মনসা মাতার মন্দিরে সারা বছর ধরে বিধিপূর্বক মনসা দেবীর পূজা হয়। মঙ্গল কাব্যধারার সবচেয়ে জনপ্রিয় কাব্য ‘মনসামঙ্গল’। সর্পদেবী মনসার মাহাত্ম্য, স্তুতি ও কাহিনি নিয়ে রচিত ‘মনসামঙ্গল’।
প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় হায়ারোগ্লিফিক লিপিতে সৃষ্টি এবং জন্মের প্রতীক হিসেবে কেউটে সাপের প্রতীক দ্বারা লিপিবদ্ধ হত।
ইংরেজি সাহিত্যের মহাকবি উইলিয়াম শেক্সপীয়ার রচিত নাটক ‘অ্যান্টনি ও ক্লিওপেট্রা’- এর শেষ দৃশ্যে দেখা যায়। হতাশ, অপমানিত, বিধ্বস্ত মিশরীয় রানী ক্লিওপেট্রা তার নিজের জন্য নির্মিত সমাধিসৌধে সমস্ত ধন সম্পদ এবং বিশ্বস্ত দুই সহচরীকে নিয়ে স্বর্নমন্ডিত পোষাক আর অলংকারে অবর্ননীয় ও অপরূপ সাজে সেজে শেষ শয্যায় শায়িত হন। কোমল বুকের উপর সযত্নে ধারন করেন কালসর্প। বলা হয়ে থাকে নীলনদের এক ধরনের প্রচন্ড বিষাক্ত ছোটো ভাইপার জাতীয় সাপের কামড়ে তার ও সহচরীদের মৃত্যু হয়েছিল যা সে নিজেই ফলের ঝুড়িতে করে লুকিয়ে বয়ে নিয়ে গিয়েছিল সেখানে। আবার কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বলে থাকেন কেউটে সাপের বিষ ছিলই তাদের মৃত্যুর কারণ।
বাংলা সাহিত্যের ‘বিদ্রোহী কবি’ কাজী নজরুল ইসলামের লিখিত ছোটগল্পসমূহের মধ্যে ‘পদ্ম-গোখরো’ অন্যতম। রসুলপুরের মীর বংশের সন্তান আরিফের স্ত্রী জোহরাকে কেন্দ্র করে ‘পদ্মগোখরো’র কাহিনী আবর্তিত হয়েছে। ক্ষয়িষ্ণু জমিদার বংশের হতশ্রী দশা কেটে সুদিন ফিরে আসে জোহরার এই বাড়ির বধূরূপে আসার পরে। গ্রামময় এই কথা প্রচার হয় যে, মীর সাহেবদের সৌভাগ্য-লক্ষ্মী আবার ফিরেছে। প্রকৃতপক্ষে জঙ্গলাকীর্ণ জীর্ণ জমিদার বাড়িতে পিতলের কলসী ভরা বাদশাহী মোহর প্রাপ্তি ছিল মীর সাহেবদের ভাগ্য পরিবর্তনের প্রকৃত কারণ। এই গুপ্তধন আগলে ছিল একজোড়া সর্পযুগল। সাহস করে দুধের বাটি সামনে এগিয়ে দিয়ে তাদের বশে এনেছিল নববধূ জোহরা। এই বাস্তুসাপ পদ্মগোখরো দুটি এরপর জোহরার অনুরাগী হয়ে পড়ে এবং জোহরাও এদের সন্তানবৎ স্নেহ-ছায়ায় লালন-পালন করতে থাকে। আপতদৃষ্টিতে এই ঘটনা উদ্ভট প্রতিয়মান হলেও, জোহরার এই প্রাণী-বাৎসল্যের অন্তরালে লুকিয়ে রয়েছে এক মর্মস্পর্শী অতীত কাহিনী। জোহরার বিবাহের এক বৎসরের মধ্যে তাহার দুটি যমজ সন্তান আঁতুড় ঘরেই মারা যায়। এই জোড়া পদ্মগোখরো যুগলকে দেখে জোহরার স্মৃতিপটে তার সেই মৃত শিশুদের স্মৃতি জেগে উঠে। তার ক্ষুধাতুর মাতৃচিত্ত মনে করে তার সেই দুরন্ত শিশু-যুগলই যেন অন্য রূপ ধরে তার সামনে এসেছে। স্নেহ-বুভুক্ষু তরুণী মাতার সমস্ত হৃদয় মন করুণায়, মমত্বে, স্নেহে আর্দ্র হয়ে ওঠে। তার ভয় ডর কোথায় উধাও হয়ে যায়। আবিষ্টের মতো সে ঐ সর্প শিশুদের আদর করে, ঘুম পাড়ায়, সস্নেহ তিরস্কার করে। বিষধর সাপ ও মানুষের এই পারস্পরিক ভালোবাসা, একত্রবাস নিশ্চয়ই স্বাভাবিক বলা যাবেনা। কিন্তু সন্তানহারা মায়ের দৃষ্টিকোণ এবং ইতর প্রাণীও যে স্নেহাতুর হতে পারে- বিষয়টি এভাবে বিবেচনা করতে পারলে ‘পদ্ম-গোখরো’ হয়ে ওঠে এক মহৎ মানবিক চেতনা উদ্ভূত প্রথম শ্রেণির সাহিত্যকর্ম। কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কালজয়ী ছোটগল্প ‘মহেশ’-এর মতো মনুষ্যতর প্রাণীর প্রতি স্নেহময় বাৎসল্য রসের গল্পের সাথে বাংলা সাহিত্যে আমরা ইতিপূর্বে পরিচিত হলেও বিষধর সাপকে নিয়ে এমন অভিনব গল্প বাংলা সাহিত্যে বিরল। বাৎসল্য গল্পটির মুখ্য ‘থিম’ হলেও ‘রূপকথা-উপকথা’-এর ঢঙে বলা এই কাহিনীতে সাধারণ মানুষের স্নেহ, বাৎসল্য, বিশ্বাস, লোভ, কামনা-বাসনাই ফুটে উঠেছে।
‘হেলে ধরতে পারেনা, কেউটে’ একটা অতি-প্রচলিত বাংলা প্রবাদ। কোনও মানুষ যখন তার সাধ্য ও ক্ষমতার বাইরে কাজ করার চেষ্টা করে তখন তার বোধহীনতার তিরস্কারস্বরূপ এই প্রবাদের ব্যবহার হয়ে থাকে।
সাধারন বাংলা নাম – কেউটে।
অন্যান্য প্রচলিত নাম – কাল কেউটে, আল কেউটে, পদ্ম খরিস, কালো খরিস, গেঁড়িভাঙা, তঁপ ইত্যাদি।
ইংরেজি নাম – Monocled Cobra
বৈজ্ঞানিক নাম – Naja kaouthia (Lesson, 1831)
আয়তন –৩৯ ইঞ্চি থেকে ৯১ ইঞ্চি ।
সনাক্তকরণ বৈশিষ্ট্য – কেউটে সাপের আঁশ মসৃন এবং চকচকে, চওড়া গলা ও মাথা বিশিষ্ট। শরীরের রং জলপাই, কালো বা ধূসর কালো। কেউটের ফণা গোখরো থেকে ছোটো এবং আকারে গোল। ফণার পিছনে ইংরেজি ‘O’ বর্ণের মতো বা চোখের মতো কালো গোলাকার একটি চিহ্ন আছে, চিহ্নটির বাইরের দিকে হালকা হলুদ বা কমলা রঙের গোলাকার দাগ বর্তমান।
চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য – –এরা প্রধানত রাতে সক্রিয় থাকে। বিশেষ করে সন্ধ্যা এবং ভোরের সময়। এরা খুব ভালো সাঁতারু।
বাসস্থান – চাষের জমি, ইঁদুরের গর্ত, বাঁশ বাগান, ছায়াঘেরা ঝোপঝাড়, ঘরের ফাটল, পাথরের স্তূপ, জলাভূমি, জলার ধার, শহরতলি এলাকা।
খাদ্য – ইঁদুর, ব্যাঙ, অন্যান্য সাপ, মাছ, শামুক, পাখি ও তাদের ডিম।
প্রজনন – ডিম পাড়ে।
বিষের প্রকৃতি – কেউটের বিষ প্রকৃতিতে নিউরোটক্সিন এবং কার্ডিওটক্সিন। সঠিক চিকিৎসার অভাবে পরবর্তীতে প্যারালাইসিস, শ্বাসকষ্ট এবং হৃদযন্ত্রের ক্রিয়াকলাপ বন্ধ হয়ে মৃত্যু।
বিষের লক্ষণ – দংশনের পরে কামড়ের জায়গায় তীব্র জ্বালা যন্ত্রনা হবে। ক্ষতস্থান থেকে চুঁইয়ে রক্তরস বের হবে, ধীরে ধীরে যন্ত্রনা বাড়বে এবং ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু নিউরোটক্সিন বিষের ক্রিয়াশীলতার কারণে পরবর্তীতে জ্বালা যন্ত্রনা কমতে থাকবে।
সংরক্ষণ – তফশিল ২ (Wildlife Protection Act 1972)
বিপদ - ওষুধ প্রস্তুতিতে বিষের ব্যবহার, চামড়ার জন্য চোরাশিকার এর জন্য এরা বর্তমানে বিপন্ন। কেউটের সুদৃশ্য চামড়া এবং বিশেষ করে ফণার চিহ্নটির জন্য ব্যাগ, জ্যাকেট প্রস্তুতির জন্য নির্বিচারে কেউটে সাপ মারা পড়ছে যা অত্যন্ত হতাশাব্যাঞ্জক। কেউটে সাপুড়েদের খুব পছন্দের সাপ। কিন্তু খেলা দেখানোর আগে এরা সাপের বিষ দাঁত উপড়ে ফেলে দিয়ে নির্বিষ করে রাখে এরফলে অচিরেই সাপটি মারা যায়।
সাপ আমাদের পরিবেশের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধি। বাস্ততন্ত্রে সাপের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। সাপ মারবেন না। সাপ বাঁচান। বাড়িতে বা এলাকায় সাপ ঢুকে পড়লে সাপ না মেরে সাহায্য নিন এলাকার সাপ উদ্ধারকারী সর্পমিত্রদের।
মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর এলাকার জন্য - দেবরাজ চক্রবর্তী (যোগাযোগঃ ৮৯৭২১৭৪০৯৩)
খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর এলাকার জন্য - কৌস্তভ চক্রবর্তী (যোগাযোগঃ ৯৪৭৫৫৯৯৩২২)
ঘাটাল, পশ্চিম মেদিনীপুর এলাকার জন্য – মেহেবুব আলম (যোগাযোগঃ ৯৪৭৪৬২৩৬২০/৯৭৩৫৭৩৮৫৩৩)
ঘাটাল, পশ্চিম মেদিনীপুর (দাসপুর) এলাকার জন্য – গৌর মাজী (যোগাযোগঃ ৯৬০৯১১৯১১৪)
ঘাটাল, পশ্চিম মেদিনীপুর (ক্ষীরপাই) এলাকার জন্য – মলয় ঘোষ (যোগাযোগঃ ৯৬৩৫৯৩৫০২৮)
রামনগর, পূর্ব মেদিনীপুর এলাকার জন্য – উমেশ গুঁই (যোগাযোগঃ ৯৮০০৮০০৫৮৯)
এগরা, পূর্ব মেদিনীপুর এলাকার জন্য – অর্ধেন্দু দাস মহাপাত্র (যোগাযোগঃ ৭৫৫১০০৭৩৩৬/৭৯০৮৫১৩৪৯৬)
পটাশপুর/এগরা, পূর্ব মেদিনীপুর এলাকার জন্য – সোমনাথ দাস অধিকারী (যোগাযোগঃ ৯৭৩৫২০৩৬২৪)
midnapore.in