Goddess of Than: Hariti or Shasthi | থানের দেবী : হারীতী অথবা ষষ্ঠী

থানের দেবী : হারীতী অথবা ষষ্ঠী

Goddess of Than: Hariti or Shasthi

শুদ্ধসত্ত্ব মান্না।


অধ্যাপক নীহাররঞ্জন রায় তাঁর 'বাঙালীর ইতিহাস : আদি পর্ব' গ্রন্থে বলেছেন, বাংলার পাড়া গাঁয়ে সর্বত্রই 'থান' বা 'স্থান' বলে একটা জায়গা নির্দিষ্ট থাকে। কোথাও কোথাও এই থান উন্মুক্ত আকাশের নীচে বা গাছের ছায়ায়। এই থান বা স্থানে কোথাও মূর্তিরূপী কোনো দেবতা অধিষ্ঠিত থাকেন, কোথাও বা থাকেন না। কিন্তু তিনি থাকুন বা নাই থাকুন - সর্বত্রই গ্রামবাসীরা তাঁর নামে মানত করে থাকেন, তাঁকে ভয়-ভক্তি করেন, যথারীতি তুষ্ট করে রাখার চেষ্টা করেন। সাম্প্রতিক বাংলার কোথাও তিনি কালী, কোথাও ভৈরব ভৈরবী, কোথাও বনদুর্গা বা চণ্ডী, কোথাও বা অন্য কোনো স্থানীয় নামে পরিচিত। শীতলা, মনসা, বনদুর্গা, ষষ্ঠী, নানাপ্রকার চণ্ডী, কালী, শিব, পর্ণশবরী, জাঙ্গুলী প্রভৃতি অনার্য গ্রাম্য দেবদেবীরা এভাবেই ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ ধর্মকর্মে স্বীকৃতি লাভ করেছিল বলে মনে হয়।

সুদূরে বৌদ্ধ যুগে মেদিনীপুর জেলায় বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তার ঘটেছিল। তাম্রলিপ্ত, মোগলমারী, বাহিরী, তিলদাগঞ্জ প্রভৃতি জায়গায় তার প্রমাণ পাওয়া যায়।



পঞ্চম শতকের গোড়ায় চীনা বৌদ্ধ শ্রমণ ফা হিয়েন বাংলাদেশে এসেছিলেন ও তাম্রলিপ্ত বন্দরে বছর দুই ছিলেন। সেসময় দক্ষিণ বঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মের সমৃদ্ধি ছিলো খুব। এই সমৃদ্ধির কিছু প্রমাণ রয়েছে প্রায় সমসাময়িক কিছু বৌদ্ধ মূর্তিতে।



শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক নীহাররঞ্জন রায় বলেছেন, পাল পর্বে বৌদ্ধ দেবীদের মধ্যে তারা সর্বশ্রেষ্ঠা। এসময়, অন্যান্য দেবীদের মধ্যে মারীচি, পর্ণশবরী, হারীতী ও চুন্ডাই প্রধান ছিলেন। এদের মধ্যে হারীতী ধনৈশ্বর্যের দেবী।



বৌদ্ধ তন্ত্র সাহিত্য ও পুরাণে কুবেরের স্ত্রী হারীতী 'যক্ষিণী' বলে উল্লেখিত হয়েছেন। কিন্তু যক্ষিণী হলেও কালক্রমে তিনি দেবীর মতো বৌদ্ধ সমাজে পূজা পেতে থাকেন। নেপালের কাঠমান্ডুতে তিনি 'মা হারীতী' নামে পরিচিত। সেখানে বুদ্ধ বা ধর্ম ঠাকুরের মন্দিরের পাশেই হারীতীর মন্দির দেখতে পাওয়া যায়। অবশ্য, কোন বৌদ্ধ মন্দির বা মঠের ভেতরে তাঁর স্থান হয়নি।



বৌদ্ধ সাহিত্যে হারীতী শব্দের যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, তা হলো - যিনি হরণ করেন তিনিই হারীতী। এই হরণ বৃত্তান্ত নিয়ে চিনা বৌদ্ধদের মধ্যে একটি গল্প প্রচলিত আছে। গবেষকদের অনেকে মনে করেন যে, গল্পটির উৎপত্তি ভারতেই। গল্পটি অনেকটা এরকম, - রাজগৃহে এক যক্ষিণী বাস করতেন। এই যক্ষিণী সমস্ত মগধের রক্ষাকর্ত্রী রূপে কল্পিত হতেন। কালক্রমে, এই যক্ষিণী মগধ নগরের শিশুদের অপহরণ করে খেতে আরম্ভ করেন। এই জন্য মগধবাসীরা তার নাম দেন, "হারীতী" বা হরণকারিণী। বুদ্ধের কাছে তাঁরা এ বিষয়ে অভিযোগ জানালে বুদ্ধের কৌশলে হারীতী তাঁর 'জাতাপহরণবৃত্তি' পরিত্যাগ করে শান্ত জীবন আরম্ভ করেন। বুদ্ধ তাঁকে বৌদ্ধ মঠ ও মন্দিরের রক্ষাকর্ত্রী রূপে নিয়োগ করেন।


Goddess of Than: Hariti or Shasthi | থানের দেবী : হারীতী অথবা ষষ্ঠী
Goddess of Than: Hariti or Shasthi | থানের দেবী : হারীতী অথবা ষষ্ঠী

আগেই বলা হয়েছে, হারীতী যক্ষিণী ও যক্ষপতি কুবেরের স্ত্রী; তাই, বৌদ্ধ ভাস্কর্যে হারীতীর যে সকল মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে সেগুলোর মধ্যে কুবেরের মূর্তির পাশেই আসীনা হারীতীর মূর্তিও আবিষ্কৃত হয়েছে। এছাড়াও পশুপরিবৃতা হারীতীর স্বতন্ত্র দন্ডায়মানা মূর্তিও দেখা গেছে। সেই মূর্তি গুলির গঠনভঙ্গি অনুপম ও উন্নত শিল্প জ্ঞানের পরিচায়ক। তাতে তাঁর স্কন্ধারুঢ় দুই শিশু, অঙ্কে স্তন্যপানরত এক শিশু; পায়ের নীচে ক্রীড়ারত আরও দু-একটি শিশু দেখতে পাওয়া যায় । তাঁর মুখে প্রসন্ন হাসি, দেবীর সর্বাঙ্গে অলঙ্কার সম্ভার ও পরিধানে বিচিত্র বসন।



পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার কেশিয়াড়ি থানা এলাকার একটি সীমান্তবর্তী গ্রাম রাণা। এখানে গ্রামের ভেতরে শিব মন্দিরের পাশে একজনের বাড়ির সামনে ললিতাসনে উপবিষ্ট একটি নারী মূর্তি দেখা যায়। মূর্তিটি মুগনি পাথর বা মাকড়া পাথরে নির্মিত। মূর্তিটির কোলে একটি শিশুকে উপবিষ্ট দেখা যায়। অন্য একটি শিশুকে মূর্তিটির পাশে দন্ডায়মান দেখা যায়। এটি আনুমানিক দশম-একাদশ শতকের হারীতী মূর্তি। বিশিষ্ট গবেষিকা শ্রদ্ধেয়া চৈতালী কুণ্ডু নায়েক জানিয়েছেন, কিন্তু এই মূর্তিটিকে গ্রামবাসীরা চণ্ডী হিসেবে পূজা করেন। আষাঢ়ে শনি মঙ্গলবারে বড় পূজা হয়।



চণ্ডী পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম জনপ্রিয় লৌকিক দেবী। তিনি সৌভাগ্যের দেবী । সুখ সমৃদ্ধি, সন্তান, বিজয় ইত্যাদি কামনায় তাঁর পূজা করা হয় । গ্রাম বাংলার সঙ্গে তাঁর বড় যোগ আছে। বহু গ্রাম নামের সঙ্গে চণ্ডী শব্দের যোগ রয়েছে। বহু জায়গায় তিনি মঙ্গলচণ্ডী, সঙ্কট মঙ্গলচণ্ডী, রণচণ্ডী, কুলুইচণ্ডী, গণ্ডকীচণ্ডী, ওলাইচণ্ডী, বনচণ্ডী, নাগ মঙ্গলচণ্ডী ইত্যাদি নামে পূজিত হন। দেবীমাহাত্ম্যম্ অনুসারে, তিনি অষ্টাদশভুজা। কিন্তু জয়চণ্ডী রূপে তিনি দ্বিভুজা, ত্রিনয়না, গৌরবর্ণা, বরাভয়হস্তা, পদ্মোপরি দণ্ডায়মানা। লোকসমাজেও তিনি বিভিন্ন রূপে কল্পিত। শেওড়া গাছে অধিষ্ঠিত হলে বনদুর্গা, পাকুড় গাছে অধিষ্ঠিত হলে দেবী ষষ্ঠী।



ষষ্ঠী দেবী বঙ্গীয় ও বহির্বঙ্গীয় এক পৌরাণিক দেবী। ইনি মূলতঃ সন্তানদাত্রী ও তার রক্ষয়িত্রী দেবী। তাঁর অন্য নাম কৌমারী। অষ্টম ও নবম শতকের গ্রন্থে এঁর উল্লেখ পাওয়া যায়। এঁর বাহন রত্নবিমান বা বিড়াল। এঁর ধ্যান মন্ত্রগুলি থেকে জানা যায় যে, ইনি গৌরবর্ণা, দ্বিভুজা; উত্তম বসন ও অলঙ্কার পরিহিতা, চন্দ্রাননা, পীনোন্নত পয়োধরা, কোলে একাধিক শিশুপুত্র। ইনি মান্ধাতার আমলের লোকদেবী। পরবর্তীকালে দেবী দুর্গার সাথে তাঁকে একীভূত করা হয়েছে।



আগেই বলা হয়েছে, ষষ্ঠী দেবী সন্তান দায়িনী ও সন্তান পালিনী। প্রখ্যাত লোকসংস্কৃতিবিদ আশুতোষ ভট্টাচার্য ও মনে করেন, সুদূর প্রাচীন কাল থেকেই সমাজে শিশুরক্ষক দেবীর অস্তিত্ব ছিল। হরপ্পা সভ্যতায় কতকগুলি ক্ষুদ্রাকৃতি মাতৃমূর্তি পাওয়া গেছে। এই দেবীরা ছিলেন মূলত গৃহদেবী, অন্যদিকে নবজাত শিশুর রক্ষয়িত্রী। পরবর্তীকালে এই সমস্ত মাতৃকা মূর্তি থেকেই ষষ্ঠীর উদ্ভব। অনেকে আবার বৌদ্ধ হারীতীর সঙ্গে ষষ্ঠীকে একাত্ম করে দিয়েছেন। কিন্তু হারীতী এককালে ছিলেন শিশু নিধনকারী, ষষ্ঠী শিশুর রক্ষয়িত্রী, কল্যাণকারী মাতৃমূর্তি। শিশুকে কেউ আঘাত করলে, অপমান করলে ইনি ভয়ংকর রেগে ওঠেন। জৈন ধর্মের শিশু রক্ষক নৈগমেসার সঙ্গে অদ্ভুত মিল রয়েছে ষষ্ঠীর। ইনিও শিশু কল্যাণকারী দেবী। কিন্তু পার্থক্য একটাই - তিনি ছাগল বা হরিণের মতো মস্তক বিশিষ্ট!



ষষ্ঠী দেবীর কোনো প্রতিমা পূজার প্রচলন ব্রাহ্মণ্য ধর্মে নেই। অধ্যাপক নীহাররঞ্জন বাবুর মতে, বৌদ্ধ প্রতিমা শাস্ত্র ও ধর্মানুষ্ঠানে ষষ্ঠী দেবীর মানস কল্পনাই বোধহয় হারীতী দেবীর রূপকল্পনায় বিবর্তিত হয়েছে। চীনা সূত্রপিটক গ্রন্থের সংযুক্তরত্নসূত্র ও ক্ষেমেন্দ্রের বোধিসত্ত্বাবধান কল্পলতা গ্রন্থে হারীতীর জন্মকাহিনী অনুসরণ করলে স্পষ্টতই বোঝা যায়, ষষ্ঠী ও হারীতীর জন্ম একই মানস কল্পনায় ও দুয়ের মূলে প্রজনন শক্তিতে ও মারী নিবারক যাদু শক্তিতে বিশ্বাস প্রচ্ছন্ন। বৌদ্ধ ধর্মাচারে হারীতী দেবীর মূর্তি পূজা সুপ্রচলিত ছিল কিন্তু ষষ্ঠী পূজায় আজও কোনো মূর্তি পূজা নেই। শেষোক্ত পুজা এখনও নারী সমাজেই সন্তান কামনা ও সন্তানের মঙ্গল কামনাতেই সীমাবদ্ধ।


Goddess of Than: Hariti or Shasthi | থানের দেবী : হারীতী অথবা ষষ্ঠী
Goddess of Than: Hariti or Shasthi | থানের দেবী : হারীতী অথবা ষষ্ঠী

সুতরাং রাণা গ্রামের ললিতাসনে উপবিষ্টা নারী আসলে দেবী হারীতীই, সময়ের বিবর্তনে যিনি গ্রামবাসীদের কাছে হয়ে উঠেছেন চণ্ডী - ষষ্ঠী যাঁর মধ্যে রয়েছেন প্রচ্ছন্ন।।


সংলগ্ন অঞ্চল নিয়ে অন্যান্য প্রবন্ধ -

● কিয়ারচাঁদ- এক বিলুপ্তপ্রায় প্রত্নক্ষেত্র, চৈতালি কুণ্ডু নায়েক।
● উপেক্ষিত লোকেশ্বর বিষ্ণু, শুদ্ধসত্ত্ব মান্না।
● কিয়ারচাঁদ- অতীত বাঙলার এক প্রধান জৈনপীঠ।
● বেহেরাসাই এর সূর্য মূর্তি :: একটি পর্যবেক্ষণ।
● থানের দেবী : হারীতী অথবা ষষ্ঠী।

midnapore.in

(Published on 12.11.2022)

তথ্য সহায়তা :
● কিয়ারচাঁদ - চৈতালী কুণ্ডু নায়েক
● বাঙালীর ইতিহাস : আদি পর্ব - নীহাররঞ্জন রায়
● বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস - আশুতোষ ভট্টাচার্য।
● পুরাকীর্তি সমীক্ষা : মেদিনীপুর - তারাপদ সাঁতরা
● উইকিপিডিয়া ও অন্যান্য সাইট।।

ছবি :
● নিজস্ব।