সত্য ঘোষাল, Satya Ghosal, Chandrakona, Medinipur


চন্দ্রকোনার মুকুটহীন সম্রাট শ্রী সত্য ঘোষাল এর স্মৃতিচারণায় দৌহিত্রী (দশম পর্ব)


Granddaughter reminisces about the uncrowned emperor of Chandrakona, Shri Satya Ghoshal


দেবলীনা মজুমদার।




Home » Medinikatha Journal » Debalina Mazumdar » চন্দ্রকোনার মুকুটহীন সম্রাট শ্রী সত্য ঘোষাল এর স্মৃতিচারণায় দৌহিত্রী



দাদা,


তুমি শুধু আমাদের বাড়ির মধ্যমণি ছিলে তাই নয় , তুমি ছিলে পুরো চন্দ্রকোনার প্রাণবায়ু। চন্দ্রকোনার যা কিছুর সূচনা সব ই তোমার হাত ধরে। পরিবারে দুই দিদি শ্রীমতি উমা রাণী দেবী আর শ্রীমতী রেণুকাবালা দেবীর পর তুমি ই পুত্র সন্তান। সেই সন্তানের পড়াশোনার জন্য সবরকম ব্যবস্থা বাবা করবেন এ তো ঠিকই। নীতি,আদর্শ , আর ত্যাগ , জীবনের ‘so called’ প্রতিষ্ঠা অর্থাৎ কোনো প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়ার,অধ্যাপক বা বড়ো কোনো ব্যবসায়ী না হতে পারায় তোমার মা বাবা কতোটা খুশি হয়েছিলেন বলতে পারব না, কারণ অভাব একসময়ের নিত্যসঙ্গী ছিল আমাদের পরিবারে কিন্তু তোমার মতো মানুষ যারা সমাজ বদলের ডাক দেয় নির্দ্ধিধায়, কোনো কিছু পাবার আশা না করে, তাঁরা সমাজে নমস্য।


সত্য ঘোষাল, Satya Ghosal, Chandrakona, Medinipur
সত্য ঘোষাল এবং শিশিরকণা ঘোষাল(আমার দিদা)।

তোমাকে নিয়ে লিখতে লিখতে, আর যে মানুষ টির নাম না করলে লেখাটা অসম্পূর্ণ থেকে যায় তিনি হলেন আমার দিদা শিশির কণা ঘোষাল। অবিভক্ত মেদিনীপুরের প্রান্তিক গ্রাম দাঁতন থেকে এক বুক স্বপ নিয়ে আসা মেয়েটির সব ইচ্ছে পূরণ হয়েছিল কিনা স্বামীর কাছে সেটা হয়তো ধোঁয়াশা। কিন্তু অত্যন্ত সহজ সরল নির্লোভ মানুষ টি সারাজীবন তোমার সহধর্মিনী হিসেবে তোমার সব কাজের উপর আস্থা রেখেই সাদামাটা জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। বারে বারে তোমার কারাবাস, আত্মগোপন থাকা, ওনার মনে কতোখানি ঝড় তুলেছে, তা আন্দাজ করতে পারি বৈকি এই মধ্যবয়সে এসে। তবু ও ঐ মানুষ টিই ১৯৬২ সালে চীন ভারত যুদ্ধের সময় নিজের বিয়ের সোনা র আংটি দান করেছিলেন নির্দিধায় এবং এর জন্য ওনার মনে খেদ আমি কখনো দেখিনি। যখনই গল্প টা করেছেন সানন্দে বলেছেন। বারে বারে বাড়িতে পুলিশের অত্যাচার, রেড হওয়া, মা ও স্ত্রীর সামনে পুলিশের ভয় দেখানো, শাসানো এগুলো একসময় আমাদের বাড়ির নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা ছিল তা আমি তোমার আর দিদার কাছে বহুবার শুনেছি। কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি ঘোষণা হবার পর বহু দিন তোমাকে রাজ্য ছেড়ে চিল্কায় আত্মগোপন করে থাকতে হয়েছে, এবং দীর্ঘদিন বাড়িতে কোনো যোগাযোগ ছিল না। এমনকি চিঠি পত্রের যোগাযোগ ও বন্ধ রাখতে হয়েছিল। এরকম পরিস্থিতিতে, বাড়িতে বৃদ্ধ মা,বাবা, সদ্য বিবাহিত স্ত্রীর মনে কি ঝড় বয়ে যেতে পারে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না! তারপরেও তোমাকে আত্মগোপন করে থাকতে হয়েছে বহুদিন , তখন হাওড়ার বালিতে লুকিয়ে একটি গার্লস স্কুলে শিক্ষকতার কাজ ও নিতে হয়েছিল। এই কথাটা বলার সময় আর একজন মানুষের কথা আমাকে বলতেই হয় ! তিনি আমার বাবা শ্রী সরোজ মজুমদার। ওনার কথা আগে ও কিছু বলেছি। জোতদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে ভগলুশোলের একটি ঘটনায় আমার বাবার ও ৭ বছরের কারাদণ্ড হয়। মেদিনীপুরের জেলখানায় যুবক বয়সের স্বপ্ন জেলখানার অন্ধকারেই হারিয়ে গেছে। তবে আমার বাবা কেও দেখেছি এখনো আদর্শে অটল। গড়বেতার বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা শ্রী সরোজ রায় (সরোজ দাদু যিনি ব্রিটিশ শাসনকালে আন্দামানের জেলবন্দী ও ছিলেন) বাবাকে তাঁর মন্ত্রশিষ্য বলতেন। বাবার পায়ের সেই ভগলুশোলের লড়াই তে তীরের দাগ এখনো দগদগ করে । ছাত্র আন্দোলনের সময় পুলিশের লাঠিচার্জের ক্ষত সারাজীবন বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি ও। আসলে এমন একটা পরিবেশেই আমার জন্ম ও বড়ো হয়ে ওঠা। শৈশবে বা কৈশোরে যা বুঝতে পারি নি, এখন তা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার!! অনেক বক্তব্য, অনেক আলোচনায় তুমি বারবার বলতে, তোমার এই প্রিয় লাইন অবশ্যই রবি ঠাকুরের " ঝড় উঠেছে ওরে এবার, ঝড়কে পেলেম সাথী ..." ঝড়ের সাথে ই তোমাদের বসবাস।


সত্য ঘোষাল, Satya Ghosal, Chandrakona, Medinipur
সরোজ মজুমদার (আমার বাবা)।

সত্যি ই তোমার জীবনকথা আমার কাছে মহাসাগরের মতো। কতো কতো ঘটনা যে তোমার জীবন জুড়ে! একবার সাম্প্রদায়িকতা র উপর একটা বক্তব্য বোঝানোর সময় এই গানের একটা পঙক্তি বলেছিলে, এবং পরে কমরেড এস . এ . ডাঙগের মৃত্যুর পর এক টা শোকসভা য় বলেছিলে "এক দিন যারা মেরেছিল তারে গিয়ে, রাজার ও দোহাই দিয়ে..." "এযুগে তারাই জন্ম নিয়েছে আজি" ... বুঝিয়ে ছিলে,যীশু খ্রীষ্ট , সক্রেটিস, গ্যালিলিও র কথা! আরো বলেছিলে মুখোশধারী মানুষের দল কিভাবে ধর্মের নামে ধ্বজা উড়িয়ে যুগে যুগে হত্যা করেছে ঘুণ ধরা সমাজের পরিবর্তন আনতে চাওয়া মানুষেদের । বিপ্লবের ভাষা বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে এভাবে ই। অতো দিন আগে বলে যাওয়া তোমার সেই কথা গুলো আজকেও বড়ো বাস্তব! এ্যাতো বাস্তব মুখী চিন্তা ছিল তোমার! স্বপ্ন তুমি দেখতে, কিন্তু কখনো অলীক স্বপ্নের পিছনে দৌড়াও নি তুমি! দুর্ভাগ্য, তোমার মূল্যায়ন ঠিক মতো করতে পারি নি।


(ক্রমশ ...)





M E D I N I K A T H A J O U R N A L

Edited by Arindam Bhowmik

(Published on 16.07.2023)




নিচে কমেন্ট বক্সে আপনার মূল্যবান মতামত জানান।