জীবনের যতোগুলো দিন পেরিয়ে এসেছি, শিক্ষা অনেকের কাছ থেকেই লাভ করেছি , কিন্তু আমার কাছে তুমি পরিপূর্ণ শিক্ষক। যে সময়ে তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গেছো , ভাগ্যের কি নিষ্ঠুর পরিহাস দ্যাখো, ঠিক ঐ সময়েই তোমাকে আমার খুব প্রয়োজন ছিল। এ্যাতো কথা এ্যাতো গল্প তুমি আমার শৈশব, কৈশোরে শুনিয়েছো , তখন তো এসবের অর্থ খুব কম বুঝেছি!! এখন বুঝি কি হারিয়েছি!! প্রতিবছর রবীন্দ্র জয়ন্তী উদযাপন, তোমার প্রিয় রবীন্দ্র স্মৃতি পাঠাগারে , সেখানে তোমার পাশে বসে একসাথে অনুষ্ঠান!! তখন তো বুঝি নি তোমার মতো প্রতিভাধর মানুষ পৃথিবীতে বারবার আসে না!! আমার বেশ মনে আছে রবীন্দ্রনাথের " দুই পাখি" কবিতা টা আমাকে আবৃত্তি করা শেখাতে তুমি আমাকে বলেছিলে, আগে ভাবো , তোমাকে বাড়ি তে সাত দিন আটকে রাখা হয়েছে, কোথাও যেতে দেওয়া হচ্ছে না, আরো ভাবো , তোমার বন্ধুরা মাঠে খেলছে, তারপর আবৃত্তি করো!! সেই বয়সে এ্যাতো কিছু বুঝতে পারি নি!! এখন বুঝি বন্ধনের যন্ত্রণা!!! তোমার 'ন ' আর 'ণ' র উচচারণ শেখানো!! এটা কিন্তু বেশ মনে রেখেছি। এই তো সেই বছর , " আমি চিত্রাঙ্গদা" আর " নহ মাতা, নহ কন্যা, " এই দুটো গান আমাকে অনুষ্ঠানে গাইতে বলেছিলে!! তা , আমি তো গেয়েছিলাম !! কিছুই বুঝি নি !! যখন জিজ্ঞেস করেছিলে বলো , " যদি পার্শে রাখো মোরে , সঙ্কটে সম্পদে " ... অর্থ বলো !! আমার মনে আছে আমি অর্থ টা বলেছিলাম, কিন্তু এটা ও মনে আছে, তুমি বলেছিলে, জীবন দেখে বুঝিয়ে বলো, আমি বলতে পারি নি, কিন্তু তোমার সেই শিক্ষা, যা সেদিন তুমি বলেছিলে, কেন নারী কে পা শে রেখে, একসাথে চলতে হবে, ; কেন সে শুধু মা , শুধু মেয়ে , শুধু পুরুষের মন ভোলানো সুন্দরী নয় , সব বুঝতে পেরেছি আজ !! সেই সময় ৮ ই মার্চ নারী দিবস এ্যাতো ঘটা করে পালন হতো না। কিন্তু তোমার পাশে বসে, তোমার কাছে থেকে, বুঝতে পেরেছি, প্রতিটা দিন তুমি নারী দের জন্য ই লড়াই করেছো। আমার জন্মের পরেও আমি শুনেছি, বাড়ির গুরুজনদের দের মুখে, আমার দিদা মেয়ে বলে একটু বিমর্ষ হয়েছিলেন , কিন্তু তুমি ই বলতে পেরেছিলে, " মেয়ে তো কি! ওই আমাদের সব " ।
চন্দ্রকোনার মুকুটহীন সম্রাট শ্রী সত্য ঘোষাল এর স্মৃতিচারণায় দৌহিত্রী।
এরকম আরো অনেক ঘটনা তোমার বৈপ্লবিক সিদ্ধান্তের অনেক কাহিনী আমি শুনেছি!! বিধানসভায় বিধায়ক থাকাকালীন, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী র আদর্শ নীতি "হাম দো , হামারে দো " এর উপর তোমার বক্তব্য চলাকালীন, বিরোধী পক্ষ থেকে প্রশ্ন এসেছিল" আপনি যে এ্যাতো বলছেন আপনার কয়টি সন্তান? " (এই কথাটা টা তুমি আমাকে বহুবার বলেছিলে,) যেখানে তুমি উত্তরে বলেছিলে , "আমার একটি মেয়ে" তোমাকে বুঝতে পেরেছি অনেক পরে!! তুমি ই আমার কাছে বিপ্লবের বাণী!! বাড়িতে আর্থিক অবস্থা কোনো দিন ভালো ছিল না জানি। কিন্তু তুমি আমাকে কোনদিন সেটা বুঝতে দাও নি তখন! কিন্তু তোমার ওষুধ না কিনে খেতে পারার যন্ত্রণা আমি দেখেছি!! আমার গৃহশিক্ষক কোনো দিন ছিল না। গৃহশিক্ষক রাখার ক্ষমতা আমাদের ছিল না। তাও জানি। কিন্তু তুমি তো আমাকে আগলে রেখেছিলে !! বুঝতেই পারিনি কিছু!! তোমার পড়ানো, তোমার লেখা, পড়েই তো বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়ে গেছি!! ( পরে একদিন এই নিয়ে লিখবো)।
খুব মনে আছে, আমাকে আমাদের সিলেবাসে একাদশ , দ্বাদশে , "অন্ন চাই প্রাণ চাই" বিজন ভট্টাচার্যের লেখা পড়াচ্ছিলে!! তোমার সাথে আমার পড়ার সময় তো সেই গভীর রাত !! এটা ও মনে আছে, সেদিন খুব উসখুস করছিলাম!! তুমি হঠাৎ করেই শুরু করেছিলে " নবান্ন" নাটকের গল্প, সেই সময়ের প্রেক্ষাপট। তারপর শেষে যেটা বলেছিলে, তাতে আমার ঘুম ছুটে গিয়েছিল !! বলেছিলে, খেয়ে দেয়ে পড়ছো , বুঝতে পারছো না! জানো এই নাটক কখন সাফল্য পায়!! সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এক বিন্দু জল না খেয়ে রাতের বেলা পড়ো , মঞ্চে অভিনয় করো , তখন জানবে খিদের জ্বালা কি!! শম্ভু মিত্রের মতো মহান নাট্যব্যক্তিত্ব রা তাই করেন !! শ্রদ্ধা করতে শেখো!! সত্যি বলছি, সেদিন ওই বয়সেও আমার ঘুম ছুটে গিয়েছিল!! আর এখন তোমার সেই গলার স্বর ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয় ! ঘুম আর আসেই না! সেই তুমি সত্যি আমায় ভুলে গেছো!! আরো একবার কোনো একটা প্রশ্নের উত্তর আমি বলেছিলাম কিছু তেই মনে রাখতে পারছিলাম না!! তুমি পর পর দুটি কবিতা একসাথে আবৃত্তি করেছিলে "কচ ও দেবযানী" আর "কর্ণ কুন্তী সংবাদ" এক লাইন না দেখে! ঐ আমাকে বলতে বলতে ই !! দাদা, বড়ো কষ্ট হয় তোমার জন্য!! জানো, তোমার বাবু অর্ধেক কথা ভুলে ই যায়!! তোমার কাছ থেকে তোমার মানসিক স্থিরতার শিক্ষা টাও নিতে পারি নি!! তবে বুঝি , বিখ্যাত শিল্পী শ্রী সবিতাব্রত দত্ত আমাদের ঐ চন্দ্রকোনার বাড়িতে কেন নিজে এসেছিলেন, তোমাকে রবীন্দ্র নাথের "রক্তকরবী " নাটকে রাজার ভূমিকায় অভিনয় করানোর জন্য!! যেখানে নন্দিনীর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন মহান শিল্পী শ্রীমতী তৃপ্তি মিত্র। অনেক কথা মনে ভিড় করে আসছে জানো!! সকলের প্রিয় সত্য দা তুমি, তোমার কথা কি আর এইটুকুতে শেষ হয়!! আবার অন্য দিন ! ... তোমার বাবু।