তোমাকে নিয়ে লিখতে লিখতে কতো মানুষের শুভেচ্ছা পাচ্ছি!! আমি আপ্লুত। আমি প্রথিতযশা লেখিকা ন ই , তবু ও মনের কথা গুলো, তোমার সাথে কাটানো দামী মূহুর্ত গুলো খুব সাধারণ ভাবে বলছি। !!
চন্দ্রকোনার মুকুটহীন সম্রাট শ্রী সত্য ঘোষাল এর স্মৃতিচারণায় দৌহিত্রী।
বিশ্বকবিকে নিয়ে ইতি উতি ছড়িয়ে থাকা তোমার নানা লেখা নানা মন্তব্য বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তোমার বক্তব্য এখনো মনকে নাড়া দেয়। ছেলেবেলা থেকেই দেখেছি, আমাদের বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ শুধু ২৫ শে বৈশাখ আর ২২ শে শ্রাবণের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। যে কোনো দিন যে কোনো সময়ে অতি সহজেই হঠাৎ করে তোমাকে বলতে শুনেছি, 'আজ আমার প্রণতি গ্রহণ করো পৃথিবী " । তারপর পুরো কবিতা টা ই বলে যেতে অনর্গল। সঞ্চয়িতা আলমারি থেকে বের করে আনতে আনতে তোমার অন্তত দুটো কবিতা বলা হয়ে যেতো। সবচেয়ে সেই দিন গুলো,যখন অসুস্থ ছিলে দেখেছি তুমি কবিতা বলছো এক লাইন ও ভোলো নি। । শুধু কি তাই! বেশ মনে আছে হঠাৎ হঠাৎ ইংরেজি হোক বা বাঙলা হোক যে কোনো কবিতা অথবা গল্পের চার লাইন বলে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জিজ্ঞেস করতে ' বল দেখি কি অর্থ '। মঞ্চে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বক্তৃতা দিয়েছো রবিঠাকুরের উপর , ' দেনা পাওনা ' র নিরুপমা , ' শাস্তি ' গল্পের সেই লাইন টা " ব উ মরিলে ব উ পাওয়া যায়..." তার সাথে মহাভারতের পাঞ্চালির জীবন এক সুরে যখন মিলিয়ে দিতে সত্যি বলছি, এখনো প্রতি মুহূর্তে শিহরিত হ ই যখন ভাবি তোমার সেই বাচনভঙ্গি আর বিশ্লেষণ ! মহাকবি কীটসের Ode to a Nightingale পড়াতে গিয়ে রবিঠাকুরের কবিতার মেলবন্ধন!! তুমি " আমার জীবনের ধ্রুবতারা!" একটা কবিপক্ষের অনুষ্ঠান পেরোলেই পরের বছর কবিপক্ষের অনুষ্ঠানের ভাবনা তোমার শুরু হয়ে যেতো!! তোমার প্রাণের রবীন্দ্র স্মৃতি পাঠাগার , চন্দ্রকোণায়, যেটা প্রতিষঠা করেছিলে তুমি, শরী কৃষ্ণ কারক, রতন চন্দ্র মল্লিক আর শ্রদ্ধেয় শ্রী সতীশচন্দ্র দাস আরো কিছু মহান শুভানুধ্যায়ীরা, ওখানে র ঐ ছোট্ট মঞ্চে একেক বার মঞ্চস্থ করেছো এক একটি নাটক। কখনো "রক্তকরবী " , কখনো " রাজা " !! আমি কিন্তু তখন খুব ছোট!! কিন্তু তোমার সেই রিহার্সাল দেখতে দেখতে বিশ্বাস করো কতো লাইন যে মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল আমার!! তোমার মনে প্রাণে জীবন জুড়ে রবীন্দ্র ভাবনা। এ্যাতো উদ্যম কোথা থেকে পেতে তুমি! আগে বুঝিনি!! এখন বুঝি !! আমরা যখন কোনো কিছু পড়ি সেটা পড়ার জন্য ই পড়ি!! কিন্তু তুমি সেটাই গ্রহণ করেছিলে জীবনে! ফরাসি বিপ্লবের বাণী, সাম্য , মৈত্রী, স্বাধীনতা তুমি গ্রহণ করেছিলে জীবনে!! মহাকবি শেলী র " If winter comes can spring be far behind " ! এই কবিতা টা তুমি কম করেও ১০ বার আমাকে বুঝিয়েছো ! জানি এখান থেকেই তুমি তোমার জীবনী শক্তি খুঁজে পেয়েছো! বিপ্লব তোমার জীবনে , মননে । তোমার ছাত্র জীবন থেকেই তোমার সেই পথ চলা শুরু! বাঁকুড়া খ্রীষ্টান কলেজে স্নাতক স্তরে পড়াকালীন একটা ঘটনার কথা তুমি অনেক বার বলেছো। তখন ব্রিটিশ শাসনকাল। একবুক স্বপ্ন নিয়ে বাঁকুড়া খ্রীষ্টান কলেজে তোমার পড়তে আসা। ম্যাট্রিক আর I. A. তে অসম্ভব ভালো রেজাল্ট করে এসেছিলে বাঁকুড়ায়। তোমার বাবা আমার কর্তাদাদুর চাকরি সূত্রে তার আগে বেশিরভাগ সময় টাই তোমার কেটেছিল বিহারে। আর জন্ম ও তো তোমার বিহারের পানপোষে। ( সে কাহিনী অন্য এক দিন) কলেজে ভর্তি হবার সাথে সাথেই তোমার পশ্চিম বঙ্গে বসবাস শুরু। কলেজে সেই সময় সবাই ইংরেজ অধ্যাপক। সেই সময় ওখানে বাইবেল পড়া সমস্ত ছাত্রদেরকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। তুমি তখন স্বপ্নে ভরপুর তরতাজা যুবক। তুমি ই প্রথম প্রতিবাদ করেছিলে জোর করে বাইবেল পড়ানো হবে কেন? অন্যান্য ছাএদের নিয়ে দিনের পর দিন আন্দোলন চালিয়েছো। হোস্টেল সুপার ঘেরাও, অতো নামী দামী ব্রিটিশ অধ্যাপক দের চোখে চোখ রেখে লড়াই , কম সাহসের কথা নয়! তখন তুমি ই প্রতিবাদের মুখ ছিলে। এবং শেষ মেষ তুমি ই জয়ী হয়েছিলে ! সেই আদেশনামা কলেজ কর্তৃপক্ষ তুলে নিয়েছিলেন। তবে, তোমার ওপরে শাস্তির একটা খাঁড়া নেমে এসেছিল! ইংরেজি অনার্স তোমাকে পড়তে দেওয়া হয় নি! তাই বোধহয় অনেক বছর পরে তোমার সেই সুপ্ত বাসনা পূরণ করেছিলে আমাকে দিয়ে! প্রতিবাদ করার শিক্ষা দিয়েছো অনেক, মহাকবি শেলী র "Ode to the West Wind " পড়াতে গিয়ে বহুবার বলেছ ঝড়ের কার্যকলাপ, ভঙ্গুর ঘুণধরা সমাজের পরিবর্তনে প্রতিবাদ যে দরকার, তা বলতে গিয়ে কতো উদাহরণ দিয়েছো , বাস্তিল দূর্গের পতন , ভিন্ন দৃষ্টিতে মেরী এ্যানটোয়নেটের জীবন কতো ভাবে বুঝিয়েছো ! কিন্তু ঐ যে বললাম তোমার সঙ্গে থেকেইছি শুধু, প্রতিবাদী চরিত্র গড়ে তুলতে পারি নি গো ! আরো একটা কথা মনে পড়ে গেল। পরীক্ষা র আগে খুব টেনশন করতাম ! যতদূর মনে আছে স্নান, খাওয়া বন্ধ ই হয়ে যেত আমার! আমার মন হালকা করতে খুব সিনেমার গল্প করতে,! কি রাগ যে হতো আমার , যখন বলতে তুমি নাকি পরীক্ষার আগে র দিনে সিনেমা দেখতে! তেমনি একদিন বলেছিলে, I A পরীক্ষা র সময় ইতিহাস পরীক্ষার আগের দিন তুমি সিনেমা গিয়েছিলে ! সিনেমা র নাম ' নেপোলিয়ন ' । সিনেমা র একটা দৃশ্য তুমি যে কতো বার আমায় বলেছো ! একা নেপোলিয়ন হেঁটে যাচ্ছেন ঘন বরফাচ্ছাদিত অঞ্চলে ! বারবার শিখিয়েছো, ঘন বরফেও সোজা হয়ে পথ চলবি । তুমি তো তাই চলেছো!! কোনো দিন মাথা নিচু করো নি ।
"Impossible is the word to be found in the dictionary of fools " যখন বারবার এই কথা টা বলতে বিশেষতঃ পরীক্ষা র আগে, বুঝতে পারতাম না তখন , কিন্তু এখন বুঝি, কি উঁচু মানের শিক্ষক ছিলে তুমি!! কোনো দিন কোনো মহাবিদ্যালয় বিশ্ব বিদ্যালয়ে প্রথা গত পদ্ধতিতে শিক্ষা দান করো নি তুমি ; কিন্তু এই শিক্ষা!! কতো জন দিতে পারে!! আর আগের দিনে ' নেপোলিয়ন ' সিনেমা দেখে পরের দিন ইতিহাস পরীক্ষা দিয়ে ২০০ নম্বরের মধ্যে ১৯৮ !!