সত্য ঘোষাল, Satya Ghosal, Chandrakona, Medinipur


চন্দ্রকোনার মুকুটহীন সম্রাট শ্রী সত্য ঘোষাল এর স্মৃতিচারণায় দৌহিত্রী (সপ্তম পর্ব)


Granddaughter reminisces about the uncrowned emperor of Chandrakona, Shri Satya Ghoshal


দেবলীনা মজুমদার।




Home » Medinikatha Journal » Debalina Mazumdar » চন্দ্রকোনার মুকুটহীন সম্রাট শ্রী সত্য ঘোষাল এর স্মৃতিচারণায় দৌহিত্রী



দাদা,


আজ একটানা সাতদিন তোমার সাথে আছি। তোমার হাতটা সরিয়ে নিয়েছো অনেক বছর আগে। ছুঁতে চাইলে ও পরশ পাই না আর! কিন্তু জানো, আজ একটা হঠাৎ করে তোমার পরশ পেলাম মনে ! পারাং নদীর সেতু র উপর দিয়ে আসছিলাম বাসে। এক ঝটকা হিমেল হাওয়ায় তোমার ছোঁয়া পেলাম জানো! এ তো তোমার কাছে গল্পে শোনা সেই পারাঙ নদী! সেই যে বিদ্রোহী রাণী শিরোমণি! সেদিন কাগজে দেখলাম রাণী শিরোমণি র গড় কর্ণ গড়ে খননকার্য চালিয়ে পুরানো রাজপ্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। মেদিনীপুর আমাদের বিপ্লবের শহর। বিদ্রোহী রাণী শিরোমণিকে নিয়ে প্রথম কাজ তোমার ই ছিল। মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ব্রিটিশ সরকারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে যে চোয়াড় বিদ্রোহ হয়েছিল তার ইতিহাস (এখন সবার ই জানা ) তার প্রধান নেতৃত্বে ছিলেন রাণী শিরোমণি, আর গোবর্ধন দিকপতি, সে ইতিহাসের আলোকপাত তুমি ই করেছিলে প্রথম ! লিখে ছিলে যাত্রা পালা! রাণী শিরোমণি। নিরক্ষরতা দূরীকরণ সমিতির সম্পাদক ছিলেন তখন শ্রী পার্থ সেনগুপ্ত । বর্ণপরিচয় গোষ্ঠী নিবেদন করেছিল " রাণী শিরোমণি" যাত্রা পালা ! যা চন্দ্রকোনার মানুষ ভোলে নি আজও ! সেই সময় "আগুনের পরশমণি" বলে একটা ব ই লিখে ছিলে, যেখানে অনেক গুলো ছোট গলপ ছিল, রাণী শিরোমণির গল্পটা ও ছিল, যেটা সেই সময় বহু স্কুলে পাঠ্যবই হিসেবে পড়ানো হতো। 'তোমার আগে কর্ণগড় মহামায়ার মন্দিরের মধ্যে ই সীমাবদ্ধ ছিল। আগুনের পরশ ' তোমার প্রাণেই ছিল। তাই বোধহয় " আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে..." গানটা এ্যাতো প্রিয় ছিল তোমার! আরো একটা কথা মনে পড়ছে , ছোট বেলায় নাচ ভালো বাসতাম খুব। ভরতনাট্যম শিখতাম। একদিন রবীন্দ্রসঙ্গীত " নৃত্যের তালে তালে হে নটরাজ" গান টা আর নাচটা একসাথে করতে বলেছিলে ! বলতে লজ্জা নেই একটা স্টেপ, একটা expression ও তোমার পছন্দ হয় নি। তখন খুব রাগ হয়েছিল!! কিন্তু সৃষ্টি, স্থিতি , লয় নিয়ে যা বুঝিয়েছিলে ঘণ্টা খানেক ধরে এখন ভাবি কি হারিয়েছি!! এরকম মানুষ বোধহয় কিংবদন্তি তেই শোনা যায়!!


সত্য ঘোষাল, Satya Ghosal, Chandrakona, Medinipur
চন্দ্রকোনার মুকুটহীন সম্রাট শ্রী সত্য ঘোষাল এর স্মৃতিচারণায় দৌহিত্রী।

আমাদের বাড়িতে সকাল হতো প্রায় ৫ ৩০ টায়। তোমার প্রিয় সদর ঘরের দরজা তোমার ইচ্ছে অনুসারে সবার আগে ই খুলে দিতে হতো! তুমি অনেক বার ই বলতে বাইরের খোলা হাওয়াকে বন্ধ করতে নেই। আর একটা কথা ও বলতে, সব মানুষের জন্য আমার দুয়ার খোলা সবসময় !! কর্তা দাদু শ্রী কালী কিঙকর ঘোষালের খুব শখ ছিল তুমি যাতে ডাক্তার হ ও। কিন্তু সাহিত্যের প্রতি আকর্ষণের জন্য তুমি হয়তো ওনার সেই ইচ্ছেতে সাড়া দিতে পারো নি!! কিন্তু এমন একটা সময় ছিল যখন শয়ে শয়ে মানুষ তোমার কাছে এসেছেন সু চিকিৎসা পাবার জন্য!! অনেক সময় আমিই দেখেছি, কোলকাতা তো বটেই বাইরের রাজ্যে চিকিৎসা করিয়ে সুরাহা হয়নি এমন মানুষ ও তোমার কাছে ছুটে এসেছেন! তোমার দেওয়া ওষুধ খেয়ে সুস্থ হয়ে আবার তোমাকে প্রণাম করতে এসেছেন। টাকা পয়সা নেওয়ার কোনো ব্যাপার ছিল না, অনেকেই দেখতাম সুস্থ হয়ে আবার এসেছেন শুধু তোমার কাছ থেকে আশীর্বাদ পাওয়ার জন্য। এখন যখন অনেক বড়ো বড়ো হাসপাতাল দেখি মুমূর্ষু রোগীদের লম্বা লাইন দেখি , ডাক্তারদের দেখি তোমার কথা খুব মনে হয় ! মানুষের জন্য সেবার মনোভাব তোমার অন্তরে ই ছিল । তোমার কাছে ই শুনেছি যখন উনপঞ্চাশের ঝড় আর পঞ্চাশের মন্বন্তর হয়েছিল সেইসময় তুমি একদম তরতাজা যুবক। তুমি অনেক বার ই বলেছো সেই সময় বহুদিন তুমি ও আরো কয়েকজন মিলে লঙ্গরখানা চালাতে। ঐ সময়ের সামাজিক পরিস্থিতি যা ছিল, তা তে বহু মানুষ আসতেন, শুধু একটু খাবার পাবার আশায়। সেই গল্প করতে গিয়ে বহুবার দেখেছি তোমার চোখ চকচক করে উঠতো!! আর ঐ কথা টা ও বারবার বলতে, " ,মানুষ কে দু মুঠো খাবার দিতে পারার কি যে আনন্দ সেটা বুঝতে শেখো। " তখন কি বুঝতে পেরেছিলাম জানি না। তবে তোমার এই বাস্তব উদাহরণ দিয়ে শিক্ষাদান !! ভুলি নি আজও। আমি আর কোনোদিন খাবার নিয়ে বায়না করি নি! শুধু একটা খেদ মনে থেকেই গেছে, তোমার নিজের অসুখের ওষুধ কিনতে পারো নি তুমি! তোমার সেবা , তোমার চিকিৎসা , প্রচণ্ড আর্থিক অভাবে হয় নি ঠিক মতো! তবে পেয়েছো অগণিত মানুষের ভালোবাসা! তাই বোধহয় মাঝে মাঝে ই এই গান টা খুব শুনতে চাইতে "আকাশ ভরা সূর্য তারা বিশ্বভরা প্রাণ..." গোটা বিশ্ব সংসার ছিল তোমার একান্ত আপনার !

আমাদের পরিবারের অতীত টা খুব ভেসে উঠছে মনে। এর বেশী র ভাগ টাই আমি শুনেছি তোমার মা কুন্দননদিনী ঘোষাল আর আমার মা জয়শ্রী মজুমদারের কাছে। কর্তা দাদু, তোমার বাবা শ্রী কালী কিঙকর ঘোষালের নির্মাণ করা বাড়ি ই আমাদের "কালী কুটির" । ওনার ছেলেবেলা ও হারিয়ে গিয়েছিল চরম অভাবে। ছোট বয়স থেকে মা বাবা হারানো দুই ভাই দিদিমা র কাছে মানুষ। ওনার ও ছিল পড়াশোনার স্বপ্ন। কিন্তু প্রবল আর্থিক সঙ্কটে ওনাকে লোকের বাড়িতে খুব শিশু বয়স থেকে কাজ করতে হতো। গোরু, ছাগল চরাতেও হয়েছে তাঁকে। মাত্র আট আনা পয়সা র অভাবে স্কুলে ভর্তি হতে পারেন নি তিনি। কিন্তু ঐ যে, অদম্য ইচ্ছে। যা তুমি পেয়েছিলে পিতৃ সূত্রে সেই ইচ্ছে শক্তি দিয়ে ই অনেক কষ্টে জোগাড় করেছি লেন আট আনা, ততদিনে স্কুলে ছয় মাস ক্লাস হয়েই গিয়েছে!! আর বাকি ছয় মাসে এক বছরের সিলেবাস শেষ করে লোকের বাড়ি কাজ করে পাশ করেছিলেন। তারপর অবশ্য জীবনে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন, হয়েছিলেন পোস্টাল ইন্সপেক্টর, চাকরি সূত্রে পশ্চিম বাংলার বাইরে ই ছিলেন বেশিরভাগ সময় ! বুঝতে পারি, এই মনোবল তোমার উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া! তাই বোধহয় বড়ো বড়ো বিপদেও তুমি অবিচল থাকতে পারতে !


সত্য ঘোষাল, Satya Ghosal, Chandrakona, Medinipur
শ্রী কালীকিঙ্কর ঘোষাল (সত্য ঘোষাল এর বাবা)।

অনেক ছোট বেলায় একবার জন্মদিনে " জোয়ান অব আর্কের " জীবনী টা পড়তে দিয়েছিলে , বোধহয় চেয়েছিলে এরকম মানসিক শক্তি জাগ্রত হোক, আমার মধ্যে ! সব বেড়াজাল ভেঙে যাক্!

নূতন দেশের ' নূতন যৌবনের দূত ' হয়ে তুমি ফিরে এসো বার বার! এ সমাজের তোমাকে বড়ো দরকার!!


(ক্রমশ ...)





M E D I N I K A T H A J O U R N A L

Edited by Arindam Bhowmik

(Published on 21.05.2023)




নিচে কমেন্ট বক্সে আপনার মূল্যবান মতামত জানান।