অনেকটা পথ এগিয়ে এলাম তোমাকে নিয়ে। চলার পথে পাচ্ছি বহু মানুষের অকুণ্ঠ ভালোবাসা। তোমাদের মতো মানুষের কাছে থেকে কি গ্রহণ করতে পেরেছি জানি না, তবে সেকাল আর একাল , ত্যাগ আর ভোগ এর তফাৎ টুকু করতে পারি।
তোমাদের মতো মানুষ , তুমি, বাবা, আরো আরো কতো শ্রদ্ধেয় মানুষ জন যেমন ভুপাল পাণ্ডা, কামাখ্যা ঘোষ , বিশ্বনাথ মুখার্জি, গীতা মুখার্জি, ইলা মিত্র , নারায়ণ চৌবে এইসব প্রাতঃস্মরণীয় মানুষ যাঁদের সাহচর্য আমি পাইনি ঠিক ই কিন্তু এনাদের আমাদের ঐ জৌলুস হীন বাড়িতে প্রতিনিয়ত আসা , থাকা , অনাড়ম্বর ভাবে, অতি সাধারণ খাবার খাওয়া, তাতে ই বুঝতে পারি কমিউন এর ধারণা আসলে কি? এ্যাতো বড়ো মাপের রাজনৈতিক মানুষেরা ও যে কতোটা সামাজিক ছিলেন, কতটা আপনার জন ছিলেন, সেটা আমি বাড়িতে গল্প শুনে ই বুঝে যাই। অনেক বার তুমি অ্যারিস্টটল পড়িয়েছো। বলেছো বার বার 'Man is a social animal ' এই কথা তোমারাই মনে প্রাণে গ্রহণ করেছিলে। মানুষের থেকে দূরে থেকে মানুষের সেবা করা যায় না। সমাজের সকল স্তরের মানুষকে নিয়ে ই সমাজ বদলের ডাক দিতে হয় এই শিক্ষা তোমার আর বাবার কাছে ই শিখেছি।
চন্দ্রকোনার মুকুটহীন সম্রাট শ্রী সত্য ঘোষাল এর স্মৃতিচারণায় দৌহিত্রী।
বাবা র কাছে গল্প শুনেছি মাইলের পর মাইল হেঁটে বা সাইকেলে গিয়ে প্রত্যন্ত গ্রামের সাধারণ মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার কথা, মানুষের বিপদে আপদে ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা। নিজের বাড়ি আর অন্যের বাড়ির মধ্যে তফাৎ না করার কথা ! এখন কার দিনের থেকে সে দিন অনেক আলাদা! এখন কার রাজনৈতিক সভায় স্করপিও,ফর্চুনার গাড়ি র লাইন দেখলে বুঝি দিন এগিয়েছে, কিন্তু নূতন দিন আনার ভাবনায় বোধহয় তোমরাই এগিয়ে! শিউরে উঠি এখনো যখন ভাবি খিদে কে আয়ত্তে রাখতেও তোমাদের একটা শিক্ষা দেওয়া হতো! বাবা র কাছ থেকেই শুনেছি শুধু ভাত , আলু সেদ্ধ তাও আবার সাধারণ মানুষ ভালোবেসে দিতেন , এই দিয়ে গোটা দিন এবং সেটা দিনের পর দিন! আর আজকের দিনে বিরিয়ানি র প্যাকেট কি সহজলভ্য না ! কি স্বপ্ন পূরণ হলো তোমাদের! কি পেলে জীবনে! আর নিজেদের সাফল্য গুলো যদি শুধু কাজে লাগাতে কেরিয়ার গড়তে, কোন্ জায়গায় পৌঁছতে পারতে!
তোমার একটি বই ' অতীশ দীপঙ্কর ' লেখার সময় কার কয়েক টি টুকরো টুকরো ঘটনার কথা হঠাৎ মনে এসে গেল । আসলে তুমি আলাদা করে বসিয়ে শিক্ষা কখনোই দাও নি। প্রতি দিন, প্রতি মূহুর্তে যা বলে গেছো, তার কিছু টাও যদি লেখা হয় তাহলে ও কয়েক খণ্ড ব ই প্রকাশ হয়ে যাবে! তা যাইহোক, তুমি একবার বলেছিলে যে সময় তোমার চন্দ্রকোণায় আসা তখন ম্যালেরিয়া বিধ্বস্ত অঞ্চল চন্দ্রকোনা। সেই রোগের ভয়ে চন্দ্রকোনা রোড দিয়ে যখন ট্রেন যেতো ইংরেজ সাহেব রা ট্রেনের কামরার জানালা ঝপাঝপ বন্ধ করে দিত ঐ ম্যালেরিয়া জ্বরের ভয়ে ! ঝোপঝাড় ঘেরা, অশিক্ষায় আর দারিদ্রে ঘেরা সেই চন্দ্রকোনা!
চন্দ্রকোনার মুকুটহীন সম্রাট শ্রী সত্য ঘোষাল এর স্মৃতিচারণায় দৌহিত্রী।
কিন্তু ঐ রুক্ষ মাটি , অনুন্নত অঞ্চলকে ভালোবেসে থেকে গেলে আজীবন! মুক্তির দূতের মতো চন্দ্র কোণায় মুক্ত আলো ও মুক্ত বাতাস ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলে তুমি! তাই, মেয়েদের স্কুল থেকে শুরু করে সার্বজনীন পূজো, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভিন্ন বিষয়ে তোমার প্রয়াস ই প্রথম। এমনকি চন্দ্রকোনা হয়ে কোলকাতায় যাবার স্টেট বাস ও বিধায়ক থাকাকালীন তোমার প্রচেষ্টাতেই প্রথম চালু হয়।
" পূজারিণী' " কবিতা টা বড্ড লাগতো জানো। ঐ শ্রীমতী র প্রদীপ জ্বালানো, রাজার অনুশাসন না মানা , বুদ্ধদেবের জ্ঞানের আলো দিকে দিকে ছড়িয়ে দেওয়া, সেই সময়ে অন্যান্য ধর্মের অত্যাচার, সব কিছু মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে তোমার ঐ 'অতীশ দীপঙ্কর ' বই তে। আর আমি যেন সব কিছু খুঁজে পাই তোমার মধ্যে!!
সারা জীবন জুড়ে তোমার অব্যাহত কাজের ধারা, কতো টা বলতে পারলাম জানি না। তবে আমি যা দেখেছি, বাড়িতে সবার কাছে যা শুনেছি, আর তুমি যেমন আমাকে বলেছো বা শিখিয়েছো, সেটা ই আমি প্রকাশ করছি আমার লেখা র মাধ্যমে।
মনে প্রাণে নূতন কিছুর জন্য স্বপ দেখা মানুষ টি যেদিন চন্দ্র কোণা ছেড়ে, মানুষের ছোঁয়া ছেড়ে, চিরদিনের মতো পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছো অনন্তলোকে সেদিন এ্যাতো মানুষের ঢল দেখে বুঝতে পেরেছিলাম তুমি সব ছেড়ে গেলেও মানুষ তোমায় ছাড়ে নি। সেদিন এটাও বুঝেছিলাম কেন তুমি লিখেছিলে " শমীগর্ভের মৃত্যু নেই" ।
চন্দ্রকোনা জুড়ে তোমার কাজ, সেই কাজের মধ্যে ই তুমি অমর । প্রাচীন তম স্কুল চন্দ্রকোনা জিরাট হাইস্কুলে সেক্রেটারি থাকাকালীন পুরাতন মাটি র স্কুল বাড়ি থেকে নতুন ভবন তৈরি করার জন্য কম পরিশ্রম করতে হয় নি তোমাকে। বহু যাত্রানুষ্ঠানের আয়োজন করতে হয়েছে। কারণ তখন সত্যিই এ্যাতো সরকারি গ্র্যান্টের ব্যবস্থা ছিল না!
“কবি”, “একটি পয়সা”, “জুলিয়াস সিজার” ইত্যাদি যাত্রাপালা আয়োজিত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। বিখ্যাত চলচ্চিত্র শিল্পী মলিনা দেবী, গুরুদাস দাশগুপ্ত,বিজু ভাওয়াল ( যিনি ব্রুটাসের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন জুলিয়াস সিজার যাত্রা পালায় ) , ছন্দা চ্যাটার্জি এঁদের মতো শিল্পী রাও এসেছেন শুধু তোমার প্রতি আস্থা রেখেই। সেখানের টিকিট বিক্রির টাকায় চন্দ্রকোণার গর্ব জিরাট হাইস্কুলের নতুন কিছু ভবন নির্মাণ করা হয়েছিল। তোমার এই প্রয়াসে জিরাট হাইস্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক মাননীয় শ্রী দেবী প্রসাদ দুবে মহাশয়ের অবদান ও চিরস্মরণীয়।আসলে কাজ ছাড়া তুমি থাকতে ই পারো নি কোনো দিন!
একসময় চন্দ্রকোণা পৌরসভার ভাইস-চেয়ারম্যান ও নির্বাচিত হয়েছিলে শুধু মানুষের ভালোবাসায়।ছোট থেকে একটা ব্যাপার খুব দেখতাম, সব মানুষেরাই তোমাকে অভিভাবকের মতো মানতেন। ব্যাক্তিগত প্রয়োজন থেকে শুরু করে সব রকম সমস্যায় দৌড়ে তোমার কাছেই আসতেন কিছু সমাধানের আশায় ! আর সেখানেও কখনো দেখিনি তুমি একটু ও বিরক্ত বোধ করেছো।
তোমার শেষ যে গল্পগুলো ব ই আকারে বেরিয়ে ছিলো সেটি হল 'পার্সিফাল ও অন্যান্য গল্প ' । সত্যি ই তোমার প্রিয় চরিত্র পার্সিফাল। একাকী নুতনের স্বপ্ন নিয়ে হেঁটে চলা মানুষ তুমি যার মন শুধু সৃষ্টিতে ভরপুর ।