একটু একটু করে এই কদিনে তোমার অনেক কিছু কথা লিখে ফেললাম। তোমার সাথে সময় কাটানো, তোমার কাছ থেকে শোনা অনেক ঘটনা লিখলাম। এই চলার পথে পেয়েছি অনেক মানুষের শুভকামনা।
বাঁদিকে শ্রীমতি কুন্দনন্দিনী ঘোষাল (সত্য ঘোষাল এর মা)।
বাঁকুড়া খ্রীষ্টান কলেজে পড়াকালীন ই তোমার রাজনৈতিক দীক্ষা। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো , কলেজ জীবনের পর থেকে আমি রাজনীতি থেকে অনেক দূরে অবস্থান করি। কিন্তু তোমার মতাদর্শ, তোমার র ত্যাগ, আমার বাবা শ্রী সরোজ মজুমদার যাঁদের মাঝে আমি বড়ো হয়েছি , তোমাদের সততা , ত্যাগ , লড়াই সবসময় আমাকে নাড়া দেয়। তোমাদের সাথে সাথে আরো অনেক অনেক মানুষ দের জানি ( ওনাদের নিয়ে অন্য একদিন বলবো) যাঁদের ত্যাগ আজকের রাজনৈতিক জগতের কর্ম কাণ্ড কে লজ্জা য় ফেলতে বাধ্য। বাঁকুড়ায় তৎকালীন অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক মাননীয় শ্রী উদয় ভানু ঘোষের নজরে পড়েছিলে তুমি। আর সেখানেই তোমার রাজনৈতিক দীক্ষা। ঘুণধরা সমাজের পরিবর্তন এনে সমাজতন্ত্রের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে পরিবর্তনের ডাক দিয়েছিলে সেই যুবক বয়স থেকেই। তখনের রাজনীতি র জগৎ এখনের মতো ছিল না। খুব শিক্ষিত , বুদ্ধি মান , মানুষেরাই সমাজ বদলের ডাক দিত , রাজনীতি কে নিজেদের ফায়দা তোলার কাজে ব্যবহার করতো না। আমার বাড়িতেই দুজন মানুষ। তুমি আর তোমার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ! চোখধাঁধানো পরীক্ষা র ফলাফল ! একবারো ভাবো নি শুধু নিজে কি করে গোছাবো! আমার বাবা শ্রী সরোজ মজুমদার অত্যন্ত গরীব বাড়ি র ছেলে। সাতভাই বোনের সংসার ! গড়বেতা হাইস্কুলে ইতিহাস বিষয়ে হায়ার সেকেন্ডারি ( তখন ইলেভেন ক্লাসে হতো) পরীক্ষায় রেকর্ড নম্বর পাওয়া মানুষ, চাকরি ছেড়ে, ভাইবোনেদের কথা বিন্দু মাত্র চিন্তা না করে শুধু সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখেছিল ; সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন যেখানে সবাই সমান ভাবে বাঁচবে,আর্থিক ভেদাভেদ থাকবে না। আর একজন মানুষ কেও দেখেছি খুব সামনে থেকে তোমার ছায়া সঙ্গী মাননীয় শ্রী কৃষ্ণ কারক মহাশয়কে , যিনি ৫০ বছরের ও বেশি পঞ্চায়েত প্রধান থেকেও আজীবন কাটিয়েছেন অতি সাধারণ জীবন । আরো অনেক মানুষের কথা তোমার কাছে শুনেছি, চোখে র সামনে দেখেছি, সেরকম মানুষ আজ আর নেই। সত্যি বলছি দাদা, আমাকে একটা লাইন বারবার হাতের লেখা য় লেখাতে ..."Nothing human is alien to me " একটু ও বুঝতে পারতাম না কেন যে বলো লিখতে! এখন মানবতার অভাব যতো দেখি তত বুঝি তোমার ভাবনা কি ছিল! আর কেনই বা আমাকে ওটা প্রায়ই লেখাতে! আজকে একটা ঘটনা বলবো, যেটা তুমি বলেছিলে ; আবার এই ঘটনার কথা আমি খুব ছোট বেলায় শুনে ছিলাম দেবেন দাদু র কাছে ( শ্রী দেবেন দাশ ) আর এটা আমাকে ভীষণ ভাবে মনে করিয়ে ছেন আমার বাবা শ্রী সরোজ মজুমদার। সুবক্তা সত্য ঘোষাল এটা সবার জানা। কমিউনিস্ট ভাবনা তোমার মন প্রাণ জুড়ে। সেই সময় বলাইপন্ডা য় নির্বাচনী জনসভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে ছিলে তুমি। তখন একই মঞ্চে বিভিন্ন দলের নেতা নেত্রী রা মিটিং এ বক্তব্য রাখতেন। সেই মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন জনসংঘ-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ডঃ শ্রী শ্যামা প্রসাদ মুখোপাধ্যায় । সুবক্তা হিসেবে ও জ্ঞানী পণ্ডিত হিসেবে ওনার নাম বিশ্বজুড়ে। উনি সেই সভায় বক্তব্য রাখার সময় কমিউনিস্ট মতাদর্শের বিরুদ্ধে বেশ কিছু কথা বলেছিলেন। বিশেষতঃ কমিউনিস্ট রা মহিলা দের সম্মান রাখতে জানে না, এরা ভুল পথ দেখায় , এরা শাঁখা সিঁদুরে বিশ্বাসী নয় , এরকম আরো কিছু কথা ওনার বক্তব্যে ছিল। উনি ওনার বক্তব্য শুরু করেছিলেন সন্ধ্যেবেলা. এবং শেষ করেছিলেন রাত্রি ৯ টা নাগাদ। তখন তুমি তরতাজা এক যুবক,চোখ ভরা স্বপ্ন আর মনভরা সাহস আর উদ্যম। ওনার বক্তব্যে র পর তুমি উঠেছিলে মঞ্চে । ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তখন মঞ্চে উপস্থিত। প্রথমেই বক্তব্য শুরু করেছিলে নারী দের সম্মান এই বিষয়ে, অতো বড়ো জনসভায় দাঁড়িয়ে বলতে পেরেছিলে শাঁখা, সিঁদুরে মেয়েদের দাসত্ব কমিউনিস্ট রা মানে না। এই আদর্শ তুমি অবশ্য আমাকে ও প্রতি পদে শিখিয়েছো, একজন পুরুষের নামে যখন একজন নারী কে শাঁখা, সিঁদুর পরতে হয় তখন প্রতি পদে সমাজের প্রতিটি মানুষের কাছে এটা প্রমাণ দেওয়া হয় ঐ নারী কোন এক জন পুরুষের ভোগ্য। এ্যাতো আধুনিক মনা মানুষের কাছে থেকে কোনো শিক্ষা আমি নিতে পেরেছি কিনা জানিনা! সমাজতন্ত্রের যে স্বপ্ন তুমি দেখেছিলে সেই স্বপ্ন দিয়ে ইতিহাস রচনা করেছিলে সেদিনের সেই জনসভায়; সৃষ্টি করে ছিলে এক অমর ইতিহাস। কারণ ঐ বক্তব্য তুমি শুরু করেছিলে রাত ৯ টা র কিছু পরে
আর শেষ করেছিলে পরের দিন সকাল ৭ টা য়। স্বয়ং ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তোমাকে মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করেছিলেন, বলেছিলেন এই ছেলে অনেক দূরে যাবে। একে আটকানো অসম্ভব!! ওনার আশীর্বাদ বিফলে যায় নি! তোমার এই দুর্বার গতি সত্যি ই আর থামে নি কখনো। তুমি মহামানব নাকি অতিমানব জানি না। শুধু এটা জানি এমন আধুনিক তম পুরুষ সমাজে বিরল! সেই দিন ই সম্ভবতঃ তুমি বুঝে গিয়েছিলে আগামীদিনে সমাজ কোন্ পথে চলতে পারে! অনেক দূরে কি ঘটবে তা তুমি অনেক আগেই বলে দিতে পারতে। তুমি আমার কাছে একজন মহান দার্শনিক !
তখন সেই ছোট্ট বয়সে, তোমাকে আমি ঠিক মতো বুঝতে ই পারি নি বোধহয়! তবে আর একটা ঘটনার কথা ও খুব মনে পড়ছে! ছেলে মানুষী মনে খুব উল্টো পাল্টা সিনেমা দেখতাম। একদিন রাতে আমাকে তুলে এনে দেখিয়ে ছিলে ' মুঘল-ই–আজম। ' চিনিয়ে ছিলে মহান অভিনেতা পৃথ্বীরাজ কাপুর কে। তারপর গল্প করেছিলে পাঁচ খুরিতে হ ওয়া সেই বিখ্যাত কৃষক সম্মেলনের কথা, যেখানে এসেছিলেন স্বয়ং পৃথ্বী রাজ কাপুর, আরো আরো কতো মহান শিল্পীরা! সেদিন ই বলেছিলে IPTA সম্পর্কে । কতো রাত যে তোমার সাথে এই সব আলোচনা হয়েছে আমার! এখন কি তোমার এই কথা গুলো একদমই মনে পড়ে না! আর আমার সেই প্রশ্ন টা মনে আছে তোমার! বলেছিলাম " ঐ রকম সম্মেলন আর একবার করাও না! সত্যি কি বোকাই ছিলাম আমি! তার পর তোমার সাথে সেই যে দেখেছিলাম 'জাগতে রহো ' । বুঝিয়েছিলে সমাজের চালচিত্র।তুমিই চিনিয়েছিলে আরেক মহান শিল্পী শ্রী প্রমথেশ বড়ুয়া কে। আবার তুমি ই শুনিয়েছিলে অমর শিল্পী শ্রী শম্ভু মিত্রের " চাঁদ বণিকের পালা " । আলাদা করে বুঝিয়েছিলে মনসা দেবী আসলে কে , বুঝিয়েছিলে চাঁদ সওদাগরের চরিত্র, শিখিয়ে ছিলে সত্যের জন্য লড়াই করতে! সেখান থেকে একটানে বলে গিয়েছিলে Alfred Tennyson এর 'Ulysses ' এ্যাতো কথা বলে গেছো , বুঝিয়ে গেছো, অত্যন্ত দূর্বোধ্য ছিল সেগুলো আমার কাছে তখন! আমি শুধু একটা কথাই বলতে পারি, তোমার শিক্ষা কতটুকু নিতে পেরেছি জানি না, শুধু এটুকু অনুভব করতে পারি " আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে, দেখতে আমি পাইনি" ।